রক্তে জ্বলে একাত্তর (১ম পর্ব)
রক্তে জ্বলে একাত্তর (১ম পর্ব)
এ কে আজাদ দুলাল
গাজীপুরের কোনাবাড়ি পোশাক শিল্প এলাকা বলে খ্যাত। রাস্তার দুপাশ দিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীগুলো। পরপর নামগুলো পড়ে যাচ্ছে শমসের সুলতান ওরফে শমু সুলতান। একটা চারতলা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীর সামনে এসে থমকে দাঁড়ায় সে। এখানে তার প্রথম আগমন। ঢাকায় বেশ কয়বার এসেছে কিন্তু কোনাবাড়িতে এই প্রথম পদার্পণ। বিপদে পড়ে এই খাটাস টাইপের লোকের কাছে আসা। সম্পর্কে আপন চাচাতো ভাই। এক কালে প্রাণের বন্ধু ছিলো। প্রায় ত্রিশ-পঁত্রিশ বছর পর দেখা হবে। চেহারা কেমন হয়েছে কে জানে। গার্মেন্টসের মালিক। ভবনের ওপর লেখা আছে মাহি গার্মেন্টেস ফ্যাক্টরী। সহজেই মিলে গেল সোনার চাঁদ হরিণ। আসার আগমন বার্তা আগেই মোবাইলে জানিয়েছিল শমু সুলতান। বংশের মানসন্মানের প্রশ্ন জড়িত। পুরাতন ঐতিহ্য ধরে রাখতে হবে। বৃটিশ বুনিয়াদী বংশ তাদের। আগে উপাধি কি ছিল তা এ প্রজন্মের কেউ জানে না। তা নিয়ে কারোও কোন মাথা ব্যথা নেই। এক ডাকে সুলতান পরিবারের সবাইকে চেনে। সবার নামের শেষে সুলতান।
সুলতান পরিবাবের বর্তমান বয়োজেষ্ঠ্য মুরুব্বী গাজী সুলতান। বয়স পঁচাশির ওপর তো হবেই। বয়সে বৃদ্ধ হলে কি হবে ইহজাগতিকের সকল সুখ-শান্তি তার চাই এবং লোভ-লালসা কোনটাই কমতি নেই। সঙ্গে থাকে তার মেজ ছেলে শমসের সুলতান। বাকি ছেলে-মেয়েরা ঢাকা শহরে স্থায়ী। মান্য করে এলাকার লোকজন। ব্যতিক্রম তো আছেই। সুলতান পরিবারের প্রয়াত বড় ছেলের মেঝ ছেলে মাহি সুলতান। বড় ভাইয়ের দুই ছেলে-দুই মেয়ে। মেজ ছেলে ছাড়া অন্য তিনজন প্রবাসী। দীর্ঘ বছর ধরে এলাকার লোকজন বড় সুলতানের এই তিন সন্তানকে কখনো চাক্ষুস দেখেনি। আরব্য রজনীর গল্পের মত তাদের কাছে। বুড়ো সুলতান সম্পর্কে নানান রকমের কিচ্ছা-কাহিনী শোনায় গ্রামের আধা এবং অশিক্ষিত গরীব শ্রেণির মানুষকে। পুরানো খানদানি পরিবারের লোক বলে সমাজে গর্বে বুক ফুলিয়ে চলে এই সুলতান পরিবার।
আরও পড়ুন গল্প পেতনি
সুলতান পরিবার বৃটিশ-পাকিস্তানিদের গোলামী করেছে। আবার এটাও শোনা যায়, গোপনে পাকিস্তানিদের সহযোগিতা করেছিলো। তারপর ভন্ডামীর খোলস খুলে পাকিস্তানিদের খেদমতে নতুন করে যাত্রা শুরু করেছে। এখন নতুন ধান্দায় চলছে। মদ ঠিক আছে শুধু গ্লাস পরিবর্তন। দেশে স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচন শুরু হয়েছে। দীর্ঘদিন যাবত সুলতান পরিবারের লোক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হতে বঞ্চিত। বুড়ো মেঝ সুলতানের জীবনের শেষ খায়েশ, সুলতান বংশের একজন চেয়ারম্যান হোক। পাকিস্তান আমলে ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান পদটি ছিলো সুলতান পরিবারের আয়ত্বে। তাদের ভাষায় চাষা-ভুষারা সবকিছু দখল করে রেখেছে। স্থানীয় পর্যায়ে বর্তমান সরকার দলের মধ্যে রয়েছে দলাদলি-কোন্দল। চলছে টাকার খেলা।
মরহুম বড় ভাইয়ের ছেলে-মেয়ের কাছে বিস্তারিত বলা হয়েছে। তারা রাজী হয়েছে পুরানো ইমেজকে পুনরুদ্ধার করার জন্য। ডলার পাঠাবে মরহুম বড় ভাইয়ের মেঝ ছেলের কাছে। তাই নিজের মেঝ ছেলেকে পাঠিয়েছে তার সাহায্য-সহযোগিতার জন্য। মোবাইলে শুধু অতীতের একটা ঘটনার কথা মাহি সুলতানকে স্মরণে দিয়েছে। তাতেই গোখরা সাপের মতো ফনা নিচু করেছে। তাই মাহির বাল্যবন্ধু চাচাতো ভাই সশরীরে মাহি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে হাজির।
─ এটা কি মাহি সুলতান সাহেবের ফ্যাক্টরী?
পাশে দাঁড়ানো সিকিউরিটিরি অপরিচিত আগন্তুকের আপদমস্তক এক নজরে দেখে নিলো। আকীর্ণ বেশভুষায় খুব একটা পছন্দ হলো না তার। তবে সিকিউরিটি হেড আগেই বলে রেখেছিল গ্রাম থেকে বড় সাহেবের একজন আত্মীয় আসবেন। তাকে যেন সসম্মানে ওয়েটিং রুমে বসানো হয় এবং খায়খাতির করা হয়।
─ আপনি কি বড় সাহেবের বন্ধু?
বন্ধু সর্বনামটা শুনে সম্মানে একটু আঘাত লাগলো এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদের সুরে জবাব দিলো,
─ না, না। মাহি আমার আপন চাচাতো ভাই এবং সমবয়সী।
আরও পড়ুন গল্প মরিচপোড়া
এক মিনিট দেরি না করে ইন্টারকমে আগন্তুকের পরিচয় জানা হলো। পাঁচ মিনিটের মধ্যে অল্প বয়সী সুদর্শন স্মার্ট একজন যুবক এসে সালাম দিয়ে ভেতরে যাওয়ার অনুরোধ করলো। শমসের সুলতান বাঁকা চোখে পাশে দাঁড়ানো সিকিউরিটির দিকে তাকিয়ে একফালি গর্বের হাসি দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
ঢুকেই মাথা চক্কোর দিয়ে উঠলো শমসের সুলতানের। চোখ বাঁধানো আলো ঝলমল করছে সারা ভবন। এলাহী কাণ্ডকারখানা। এত সুন্দর অফিস! কি জানি কত টাকার মালিক এই মাহি সুলতান। একটু দয়া করলে ভোটে জেতার কোন অসুবিধা হবে না। দোতলার সিঁড়ি বেয়ে সোজা একটা রুমে ঢুকলো সমু সুলতান। এটা যেন রুম না, জান্নাতখানা। এত সুন্দর করে সাজানো। ঠান্ডা ঠান্ডা মৃদু হাওয়া বইছে। শরীরটা ফুর ফুর মেজাজে ভরে উঠলো। আবার ভাবছে আলাদিনের প্রদীপ পেয়েছে না-কি মাহি।
ছেলেটির ডাকে হুস ফিরে পায় শমসের সুলতান।
─ স্যার, আপনি ফ্রেস হয়ে বসুন। চা-নাস্তা আসছে।
সালাম দিয়ে বিদায় নিলো ছেলেটি।
ফ্রেস হওয়ার জন্য ওয়াসরুমে ঢুকেই আবার মাথা চক্কোর খেলো। এটা কি বার্থ রুম না-কি অন্য কিছু! ব্যবহার পদ্ধতি তার জানা নেই। কি করবে সে? মান সম্মানের প্রশ্ন। ওয়াশরুম হতে বের হয়ে সোফায় বসে পড়লো। ট্রে-ভর্তি নাস্তা নিয়ে অন্য এক যুবক সামনে রাখা একটা টেবিলের উপর রেখে শমসের সুলতানের চোখের দিকে তাকালো।
─ স্যার, আপনার নাস্তা। ঠিক বারোটায় বড় সাহেব আসবেন। কফি-নাস্তা খেয়ে নিন। আমি দরজার বাইরে আছি।
─-শোনো, তোমাদের অন্য কোথায় বাথ রুম আছে?
─ কেন স্যার, আপনার কি অপছন্দ?
কথা শুনে শমসের সুলতানের মাথা গরম হয়ে উঠলো। কিন্তু উপায় নেই।
─ না, তা নয়। থাকলে বলো।
ছেলেটি বুদ্ধিমান। বুঝেছে গোলমাল কোথায়। কোন কথা না বাড়িয়ে অন্য একটা সাধারণ টয়লেটে নিয়ে গেল। শমসের মনে মনে খুব খুশি হলো। প্রায় আধা ঘন্টা ধরে ফ্রেস হওয়ার পর বের হলো। ওয়েটিং রুমে গিয়ে মনের মতো কফি-নাস্তা খেয়ে সোফায় গিয়ে বসলো। ভাবছে এখানে তার বড় ছেলে চাকরি করে। কিন্তু তাকে কিছু বলা ঠিক হবে না। সে যে এখানে এসেছে তাও গোপন রাখতে হবে।
আরও পড়ুন গল্প পাথরে শৈবাল খেলে
ঠিক বেলা বারটায় ওয়েটিং রুমে ঢুকলেন মাহি সুলতান। ঢুকেই চোখে পড়লো অর্ধেক টাকওয়ালা একজন বয়স্ক লোকের দিকে। এই কি তার চাচাতো ভাই শমসের সুলতান! তার প্রিয় শমু ভাই। বাবা-মার সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে গেলে সমবয়সী শমু তার সার্বক্ষণিক ছায়া হয়ে থাকতো। চষে বেড়াতো গ্রামের আনাচে-কানাচে। মাহি ছোটবেলায় বেশ ডানপিটে এবং একরোখা চরিত্রের যুবক ছিল। গ্রামের উঠতি বয়সের মেয়েদের দেখলে খারাপ ইঙ্গিত করতে দ্বিধাবোধ করতো না। সুলতান পরিবারের ছেলে বলে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পেত না। অন্য তিনটি ছেলে-মেয়ে ছিল ঠিক তার বিপরীত চরিত্রের। দীর্ঘ পঁত্রিশ বছর পর সাক্ষাৎ হচ্ছে। কি আশ্চর্য দু’জন দু’মেরুর বাসিন্দা! সে আজ সমাজে নামকরা গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। সামাজিক অবস্থান শীর্ষে। সকল দলের নেতাদের সাথে উঠা বসা। মেধাবী হলেও একাডেমিক কোন বড় ডিগ্রী নেই। টাকাই তার মূলধন। সব শ্রেণির মানুষের সাথে উঠাবসা করে। আর তারই আপন চাচাতো ভাইয়ের কি বিক্ষিপ্ত চেহারা! অথচ তার অন্য আপন ভাই-বোন মানুষ হয়েছে। এর ভেতরে ছিল একটা অহংকার, সুলতান বংশের ছেলে বলে।
শুনেছে ভাই-বোনেরা আর্থিক সাহায্য করে থাকে শামুক। জীবিত একমাত্র চাচা ব্লাকমেইল করছে তারই মরহুম বড় ভাইয়ের সঙ্গে। এই চাচা তো আগাগোড়াই একটু লোভী চরিত্রের লোক। নিজের অসহায়ত্বের কথা বলে বাবার কাছ হতে অতিরিক্ত জমিজমা আদায় করে নিয়েছে। আবার নতুন ফাঁদ পেতেছে। প্রবাসী ভাই-বোনদের পর্যন্ত হাত বাড়িয়েছে। ভদ্র সন্তান বলে আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। একটা সিদ্ধান্ত ভাল নিয়েছে, তাহলে টাকা পয়সা মাহির মাধ্যমে খরচ হবে। কেমন চেহারা হয়েছে। মেলাতে পাড়ছে না মাহি। বেশি সময় হাতে নেই। বিদেশী বায়ারের সঙ্গে বিশেষ মিটিং আছে। চাচার উঠকো আব্দার। সরকারি দলের স্থানীয় পর্যায়ে নেতা হয়েছে তার চাচাতো ভাই শমু।
আরও পড়ুন গল্প স্বপ্ন গোধূলি
বর্তমান রাজনৈতিক দলের সব খোঁজ-খবর রাখে মাহি। স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকাররা দল বদল করে নেতা হওয়ার জন্য সরকারি দলে যোগদান, তারপর বড় পদ বাগিয়ে নিচ্ছে। এ সব হচ্ছে অঢেল অর্থের বিনিময়ে। একাত্তরের তার নামে প্রচুর দুর্নাম আছে। শুধু বড় সুলতানের ভাই বলে কেউ কোন কথা বলেনি। আবার নতুন খেলা শুরু করেছে। তাদের অবশিষ্ট সম্পত্তি তো ছোট চাচার ভোগ দখলে। আর তার জন্য রাতে আঁধারে গ্রাম ত্যাগ করতে হয়েছিল মাহির। ফেলে আসতে হয়েছিল ভালবাসার মানুষটিকে। আজ সব অতীত। মনে রাখতে চায় না। মানুষের জীবনে অনেক কিছুই ঘটে থাকে। তাই বলে জীবন তো আর কারো জন্য থেমে থাকে না। নৌকা তো কোন না কোন ঘাটে ভিড়বেই।
─ কিরে শমু, বুড়ো হয়ে গেছিস?
এত সময়ে চিন্তার সাগরে হাবুডুবি খাচ্ছিল শমসের সুলতান। সামনে কাকে দেখছে? পঁত্রিশ বছর আগে যাকে দেখেছিল, এই কি সেই মাহি সুলতান ওরফে মাহি? তার যৌবনকালের খেলার সাথী ছিল। একটা ঘটনার অপরাধে রাতের অন্ধকারে বাড়ি ছাড়া হয়েছিল। আর এর পিছনে হাত ছিল তার বাবা গাজী সুলতানের। কেমন করে বড় চাচার সম্পদ হাতিয়ে নেয়া যায়, সেই সুযোগ খুঁজে বেড়াতো গাজী সুলতান। শয়তান মানুষের সুযোগ নাকি দ্রুত হাতে এসে যায়। বাবার বেলায় তাই হয়েছিল। বাবা আবার নতুন একটা দাবার চাল দিয়েছে বুড়ো বয়সে। তার ছেলেকে চেয়ারম্যান দেখতে চায়।
বড় চাচা তার পরিবারসহ ঢাকা শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন। বছরে একবার শীতের সময় ছেলে-মেয়েদের নিয়ে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে আসতেন। তবে তার বড় ছেলে কখনো গ্রামের বাড়িতে পা রাখেনি। মেজ ছেলেসহ দুই মেয়েকে নিয়ে আসতেন। মাহির ঘটনার পর সেই যে বড় চাচা–চাচী বাড়ি ছেড়েছিলেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার পরিবারের কেউ গ্রামমুখী হয়নি। শমু বিশ্বাস করে, যত রকমের কুবুদ্ধি আছে, সব তার বাবার মাথায় কচুরিপানা ফুলের মতো সাজানো। মৃত্যুর মুখে পা রেখে নতুন খেলায় মেতেছে। পিছনে কি মতলব আছে কে জানে। সামনে যে মানুষটি দেখছে সে কি মাহি!
আরও পড়ুন গল্প সোনালি সকাল
বয়সে তার সমবয়সী কিন্তু কি সুন্দর তরতাজা দর্শনধারী সুপুরুষ! সাহেবী পোশাক পরিহিত। ছোটবেলায় বর্ষার সময় দেখেছে, শেষ বিকেলে পড়ন্ত সুর্য যখন ধীরগতিতে একটু একটু করে হলুদ আভা ছড়িয়ে ডুব দিতো, আর সেই হলুদ আভা এসে পড়তো বিলের শান্ত স্বচ্ছ পানির ওপর। কি সুন্দর না দেখাতো! ঠিক সেই রকম হলুদ আভা পড়েছে মাহি সুলতানের মুখমন্ডলে। অভিভূত হয়ে পলকহীনভাবে তাকিয়ে আছে মাহির দিকে। মাহির প্রশ্ন শুনে চমকে উঠে জবাব দিলো,
─ না। গ্রামে থাকলে যা হয়।
জবাবে অসহায় বার্তা।
─ তুমি কেমন আছো?
বেশ ভাল আছি। ছোট চাচা সব বলেছে। তুমি নির্বাচন করবে। এখন কোন কথা হবে না। আমার গেস্ট হাউস আছে, সেখানে গিয়ে বিশ্রাম করো। সব ব্যবস্থা করা আছে। সন্ধ্যার পর বিস্তারিত আলোচনা হবে।
কি আলোচনা হয়েছিল, তা জানা যায়নি। তবে খুশি হয়ে বাড়ি ফিরেছিল শমসের সুলতান।
আরও পড়ুন রক্তে জ্বলে একাত্তর-
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
রক্তে জ্বলে একাত্তর (১ম পর্ব)