রক্তে-জ্বলে-একাত্তর-শেষ-পর্ব
এ কে আজাদ দুলাল (গল্প),  গল্প,  মুক্তিযুদ্ধ,  সাহিত্য

রক্তে জ্বলে একাত্তর (শেষ পর্ব)

রক্তে জ্বলে একাত্তর (শেষ পর্ব)

এ কে আজাদ দুলাল

 

হঠাৎ রাশেদ এসে ঢুকে দেখে, তার মা একজন অপরিচিত লোকের সাথে কথা বলছে। ইতোপূর্বে এ ধরনের লোককে এ এলাকায় কখনো নজরে পড়েনি। তার মা-র চোখে চোখ পড়তেই বলল,
── তোমাদের সভার কাজ শুরু করো। এই ভদ্র লোকের সাথে কথা বলে আসছি। একটু সময় লাগবে।
রাশেদ কোন কথা না বাড়িয়ে বের হয়ে গেল। পঁত্রিশ বছর পর রাশেদার জীবনে কি ঘটেছিল, সে সব ঘটনা মাহি সুলতানের জানা ছিলো না। দীর্ঘ দশ বছর বিদেশে কাটিয়ে দেশে ফিরে গার্মেন্টস ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। সময়ের সাথে সাথে ভুলে যায় অতীতের অনেক ঘটনা। একজন মানুষের জীবনে তো কত রকমের ঘটনা ঘটে থাকে। মনে উদয় হয় ফেলে আসা জীবনের মধুময় দিনগুলো। কিন্তু জীবনের অনেক কিছু ঘটনা স্মৃতি হয়ে থাকে, তা কখন ভুলবার নয়। সেই স্মৃতিগুলো আজীবন জীবন নদীতে তরঙ্গ হয়ে চলতে থাকে। দুরন্ত যৌবনের কথা মাহি সুলতানের মনে জেগে উঠে। কি দুরন্ত ছিল সেই দিনগুলো!

আরও পড়ুন গল্প অতিথি আসন

মেঝ ছেলে-মেয়েরা নাকি একটু বেশি জেদী হয়। সেই জেদ তার ভেতরে ছিল এবং এখন বিদ্যমান। সে কি মনে প্রাণে রাশেদা ওরফে রুশোকে ভালবাসত, নাকি রুশোর নিটোল শরীর এবং কাঁচা হলুদ মাখা গায়ের রঙের সাথে মায়াবী চেহারার প্রতি শহরে বড় হওয়া মাহির নজর ছিলো। যদি ভালবাসার প্রবল আকাঙ্ক্ষা মনে ধারণ করতো, তাহলে কেন এতদিন নীরব থেকে আজকে নতুন ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে এসেছে? অনেক প্রশ্ন দু’জনের মধ্যে তোলপাড় করছে। কত সময় দু’জন নীরব ছিল কেউ বুঝ উঠতে পারেনি। মাহি সুলতান নিজেই নীরবতা ভেঙ্গে বলল,
── রুশো, কেমন আছো? তোমাকে এভাবে দেখা পেয়ে যাবো, ভাবতে পারিনি।
── কেন, ভেবেই রেখেছিলে রুশো নামের সেই মেয়েটি ইজ্জত হারানোর ভয়ে আত্মহত্যা করেছে?
──দেখ, আমি ষড়যন্ত্রের শিকার। মেজ চাচা-চাচী যে একটা ফাঁদ পেতে রেখেছিল আর তুমি-আমি দু’জনে সেদিন ফেঁসে গেলাম। আর সেই রাতের আঁধারে শিমুকে দিয়ে, আমাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল।
── আমি তো জবাবদিহি করতে বলিনি। আমার সংসার আছে, আমি সন্তানদের মা এবং একজন শিক্ষক। দোহাই আমার মান-ইজ্জত আর নষ্ট করো না। জনগণ আমার ছেলেকে ভালোবেসে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেছে। আমার ছেলে রাশেদ হাসান বিসিএস প্রশাসন ক্যডারের চাকরি পেয়েছিল। আমি তাকে যোগদান করতে দেইনি। সে আমার কথা রেখেছে। তার যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবে।

আরও পড়ুন গল্প সোনালী

──দয়া করে বলবে, সে দিন রাতে আর কি ঘটেছিল?
── তুমি যখন জানতে চাইছো, বলি। তবে বেশি সময় দিতে পারব না। তোমার মেজ চাচা-চাচী মিথ্যে রটিয়েছিল যে আমরা খারাপ কাজে লিপ্ত ছিলাম। সেটা তোমার বাবা-মাকে আমার মাকে জানিয়ে, সেই দিন রাতেই তোমাদের বাড়ি হতে চিরদিনের জন্য বের করে দিয়েছিল। শুধু এখানেই তোমার মেজ চাচা-চাচী ক্ষান্ত হয়নি। মাকে সাত দিনের সময় দিয়েছিল আমাকে বিয়ে দেয়ার জন্য। আমার মা এতটাই উচ্চাকাঙ্ক্ষী মহিলা ছিল যে, তার স্বামীকে অপমান করতে দ্বিধাবোধ করেনি। আমিও মা’র মানসিকতায় বড় হতে চলেছিলাম। কিন্তু একদিনের ঝড়ে সব তচনচ হয়ে গেল। আমার ভাই বাবার আদর্শ নিয়ে মানুষের মত মানুষ হয়েছে। বিধাতার লেখন কেউ বদলাতে পারে না। অন্যায়ের ফসল জীবন দিয়ে প্রতিশোধ করতে হয়। আমি আর মা তাই করেছিলাম।

আমার বাবার ফুফাতো ভাইয়ের ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। তিনি ছিলেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা। আমার চেয়ে বয়সে দশ-বারো বছরের বড়ো। যে পরিবারকে আমার মা কখনো মেনে নিতে পারেনি, সেই পরিবার আমার ইজ্জত বাঁচাতে এগিয়ে এলো বিনা দ্বিধায়। কারণ তারা জানে তাদের বংশের মেয়ে কোন অপরাধ করতে পারে না। স্বামীর ইচ্ছেই লেখাপড়া শিখেছিলাম আর মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসেবে শিক্ষকের চাকরি পেয়েছিলাম। আমি অহংকার করে বলতে পারি আমার স্বামী এবং তার চার ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা। আমার সন্তান দুটো বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। এই যে স্কুল এন্ড কলেজ দেখছো, এর নাম কি জানো? গর্বের সাথে বলতেই পারি ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা স্কুল অ্যান্ড কলেজ’।
এক নাগারে কথা বলতে বলতে রাশেদা বেশ ক্লান্তিবোধ করছে। এত সময়ে সে দাঁড়িয়ে কথা বলে যাচ্ছিল। বসে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার আরম্ভ করে।
── সেই দিন রাতেই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম জীবনে যদি কোন দিন কোন সুযোগ পেয়ে যাই, তাহলে সকড়ায় গণ্ডায় প্রতিশোধ নেবো। তবে সেটা কারো ইজ্জতহানী করে নয়। যারা মিথ্যে অহংকার আর অভিজাত নিয়ে মানুষকে মানুষ ভাবে না আর কথায় কথায় চাষাভুষা বলে মুখ ভেঁককিয়ে গালি দেয়, তাদের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ। এবাবের যুদ্ধে জয়লাভ করেছি। আগামী দিনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি।

আরও পড়ুন গল্প অচেনা

গভীর মনোযোগ সহকারে রাশেদা ওরফে রুশোর কথা শুনে যাচ্ছিল এককালের বংশীয় অভিজাত শ্রেণির ঘরের ছেলে মাহি সুলতান। ভাবছে সেই চৌদ্দ-পনেরো বছরের মেয়ে আজ পরিণত বয়সের একজন আদর্শবাদী নারী। চোখে-মুখে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে। কিন্তু সে আগুনের তাপে পুঁড়িয়ে ধ্বংস করার নয়। তাপ মানুষকে জাগিয়ে তোলে। এমন নিবেদিত মা তো বাংলার ঘরে জন্ম নিবে বারবার।
── রুশো, আমার জীবনের শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে চাই। আশা করি তুমি সেই সুযোগটা দিবে।
──এমন কিছু আশা করবে না। আমাকে অপমানিত হতে না হয়। ইতিমধ্যে জেনে গিয়েছো তোমার চাচা-চাচাতো ভাইয়ের অবস্থান কোথায়।
── জানি বলেই ঢাকা হতে আসার আগে ভাই-বোনদের সাথে পরামর্শ করেই এসেছি। শুধু তাই নয় ভূমি অফিসের লোকজনের অবগতি করেই এসেছিলাম। আমাদের পৈতৃক সম্পত্তি বুঝে নিয়েছি। আর সেটা সৎকাজে ব্যবহার করতে চাই। তবে ভেবো না, প্রতিদানে কিছু দাবি করবো না। আমাদের পৈতৃক সম্পত্তি এই কলেজের নামে লেখে দিতে চাই। কাগজপত্র তেরি করে এনেছি। আমাদের রহিম মাস্টার সব জানেন। জানি তিনি তোমাকে সব কাছে উৎসাহ দিয়ে থাকেন।
── তোমাদের সম্পত্তি এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দান করতে চাইছ ভাল কথা। তুমি তো জেনেছ এই স্কুল-কলেজটির নাম কি। এটা আমার শ্বশুর বাড়ির চিন্তার ফসল। এখানে অন্য কারো সাহায্য সহযোগিতা নিবে কিনা জানি না। বরং এখানে তোমার বাবা-মায়ের নামে একটা হাসপাতাল নির্মাণ করতে পারো। তোমার ভাই-বোনেরা বিদেশে থাকেন। প্রচুর অর্থের মালিক। গ্রামের জন্য একটা কিছু করো যাতে গরীব মানুষের উপকারে আসে। তোমাদের মত অভিজাত শ্রেণির মানুষের ছেলে-মেয়েরা ইংলিশ মিডিয়ামে লেখাপড়া শিখে বিদেশে চলে যায়। কারণ কৃষক-শ্রমিকের ছেলে-মেয়েরা শিক্ষিত হয়ে বড় বড় পদে চাকরি করছেন আর এতে তোমাদের মানসম্মানে ব্যাঘাত ঘটছে।

আরও পড়ুন গল্প তৃতীয় স্বাক্ষী

ঐ যে তোমাদের ভাষায় চাষাদের সন্তান লেখাপড়া শিখে উপরে উঠতে শুরু করেছে। অভিজাত শ্রেণির ভদ্র লোকের বসবাসের অযোগ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এ দেশ। শুনতে খারাপ লাগছে। এখন এটাই বাস্তবতা। আর এর বিরুদ্ধে আমার সংগ্রাম। একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হয়ে সেই কাজটাই করে যাব। শুধু তাই নয়, একমাত্র সন্তানকে এ পথে নামিয়েছি। জানি অনেক বাধা আসবে। রাজনীতি এখন বেচাকেনা হয়। যেমন তোমার চাচাতো ভাই টাকার বিনিময়ে নেতা হয়েছ। তারপর ফলাফল তো ভাল করেই জেনে যাচ্ছো। কিন্তু জনগণ তো আর ভুল করতে পারে না।

সুলতান বংশের ছেলে মাহি সুলতান। এককালে এলাকায় তাদের উপরে কেউ কথা বলতে সাহস পেতো না। তাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় রুশোর মা। বলতে গেলে তাদের আশ্রয়ে বড় হয়েছে। রুশোর মা’র বিয়ে হয়েছিল মাহির মায়ের এক আত্মীয়ের সাথে। কিন্তু অহংকারী আর অত্যন্ত জেদী মহিলা খ্যাত মেয়েকে নিয়ে বিধবা মায়ের সংসারে ওঠে। তার স্বামীর পরিবার ছিল অত্যন্ত স্বজন ও ভদ্র। রুশো তার মা’র কার্যকলাপ অনুসরণ করে চলতো। সেই মায়ের মেয়ের মুখে আজ এ কি শুনছে! শুনেছে ছেলেটা খুব মেধাবী এবং সৎ। সরকারি দলের উপজেলা পর্যায়ের নেতা। নমিনেশন না পেয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে দাঁড়িয়ে জয়লাভ করেছে। মাহি সুলতান শুধু চুপচাপ শুনে যাচ্ছে, এই বাংলাদেশের একজন সাধারণ সাহসী নারীর কথা। রুশোর পাশাপাশি হেঁটে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মাহি সুলতান আর মাইকে রাশেদ হাসানের কণ্ঠে ভেসে আসছে…..

“আমরা একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরাধীকারী। আমাদের রক্তে জ্বলে একাত্তর। তাদের স্বপ্নকে এ দেশে প্রতিষ্ঠিত করবো ইন-শা-আল্লাহ। জয় বাংলা।”

আরও পড়ুন রক্তে জ্বলে একাত্তর-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব

 

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

রক্তে জ্বলে একাত্তর (শেষ পর্ব)

Facebook Comments Box

এ কে আজাদ দুলাল মূলত একজন গল্পকার। এছড়াও তিনি কবিতা ও উপন্যাস লিখছেন। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: বিবর্ণ সন্ধ্যা, তুমি রবে নীরবে; উপন্যাস: জোছনায় ভেজা বর্ষা। তিনি ১৯৫১ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালী ইউনিয়নের নুরুদ্দীনপুর গ্রাম তাঁর পৈতৃক নিবাস ।

error: Content is protected !!