মাধবী নিশীথিনী (১ম পর্ব)
মাধবী নিশীথিনী (১ম পর্ব)
‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না?
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না?
ক্ষণিক আলোকে আঁখির পলকে তোমায় যবে পাই দেখিতে
হারাই-হারাই সদা হয় ভয়, হারাইয়া ফেলি চকিতে॥’
সত্তর দশকের গোড়ার কথা।
রুদ্র শাওন গুনগুন করতে করতে হনহন করে হাঁটছে। তার হাঁটার গতি দেখে যে কেউ বলবে, কোনো জরুরি কাজে বহুদূর পথ পেরবে। অবিশ্যি যারা চেনে, তারা বলবে না। দৈবাৎ দেখা হলে বরং পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াবে। রুদ্র শাওন খান পরিবারের একমাত্র বংশধর। এই তরুণ যুবক যে বদ্ধ পাগল, তাতে ঐ তল্লাটের কারও বিন্দুমাত্র সংশয় নেই।
রুদ্র শাওন অনেকটা রাতচোরা পাখির মতো। অনেকটা নয়, আসলে পুরোপুরিই। পার্থক্য শুধু, নিশাচর পাখিরা উড়ে উড়ে এগাছ-সেগাছ বিচরণ করে; কখনো পিলে চমকানো ডাক দেয়, আর সে মেঠোপথ ধরে হাঁটে, কখনো ঘোরের ভেতর দিয়ে, কখনো রবীন্দ্র সংগীতের ঐ চার লাইন গুনগুন করে গাইতে গাইতে। সে গলা ছেড়ে গায় না, কারণ গলায় সুর নেই। তবে পঙ্ক্তিটি তার অসম্ভব প্রিয় এবং জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
আরও পড়ুন গল্প সাদা মেঘের তুলো
তার দেখা পেতেই রুদ্র শাওনের নিশ্চিব্রত পালন। ‘তার’ মানে সেই মেঘতরুণীর। সেই নিশীথিনীর। রুদ্র শাওন যার নাম দিয়েছে চন্দ্রকন্যা মাধবী নিশীথিনী। শরৎ মেঘের মতো শুভ্র বসনা এক অপূর্ব রূপবতী তরুণী। চাঁদের নরম আলোয় প্রসাধিত যে মেয়েটি তাকে ইশারায় ডাকে। কেন যেন খুব চেনা মনে হয়! অতি আপন, খুব কাছের কেউ। চাঁপা ফুলের মতো গায়ের রং, মৃণালনিন্দিত হাত, কাজলের চেয়েও ঘন কালো চুল—কে সে, কাছে ডাকে, অথচ ধরা দেয় না! খুব চেনা ভঙ্গি। স্পর্শের অনুভব পর্যন্ত ইন্দ্রিয়গম্য হয়ে ওঠে বুকের চাতালজুড়ে। আলোড়িত করে বুকের ভেতরটা।
রুদ্র শাওন এর আগে তিনবার তার দেখা পেয়েছিল। তিনবারই তাকে হাতছানি দিয়ে ডেকে খিলখিল হাসির শব্দে বাতাসে রিনিঝিনি তরঙ্গ তুলে খিড়কি দুয়ার দিয়ে অন্তঃপুরে পালিয়ে যায়। কী এক দুর্বার টানে শাওন তার পিছু নিয়ে পোড়ো জমিদার বাড়ির সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। অতঃপর ফিরে আসে। আজ সে তার পিছু পিছু অন্দরমহলে ঢোকে। নূপুরের নিক্বণের মতো এঘর থেকে ওঘরে আলতো পায়ে হেঁটে যাওয়ার মিষ্টি আওয়াজ আর শরতের নরম বৃষ্টির মতো হাসির রিনিরিন শব্দ স্পষ্ট শুনতে পায়। এমন কি অন্তঃপুরে ঢোকার সময় খিড়কি দরজায় কড়ার মৃদু দোলাও তার নজরে পড়ে। সে যে এইমাত্র ভেতরে ঢুকেছে তাতে যৎসামান্য সন্দেহও নেই। সে জানে, সে আছে। তবু কেন এই ছল?
মধ্যরাত। পঞ্চমীর চাঁদ ডুবে গেছে অনেক আগে। রুদ্র শাওন এক সময়ের পরাক্রান্ত জমিদার মোহিত মোহন সামন্তর বিশাল উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। তার সম্মুখে জংধরা লোহার বিরাট তোরণ। প্রায় অর্ধশত বিঘার ওপর নির্মিত ব্রিটিশ আমলের এই জমিদার বাড়ির পুরোটাই উঁচু পাঁচিলে ঘেরা। লালচে দালানগুলো কালের আবর্তে ক্ষয়ে-ক্ষয়ে প্রেতের মতো শত-সহস্ৰ খয়েরি চক্ষু মেলে যেন রুদ্র শাওনের দিকে ক্রূর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। স্যাঁতসেঁতে দালানগুলোর এখানে ওখানে আসশেওড়ার ঝোপ। ভেজা ভেজা বাদামি ঝরা পাতার রাশির মধ্যে ছড়িয়ে আছে খসে পড়া পুরনো ইট, বিধ্বস্ত থাম আর ভাঙা প্রতিমা। সামন্ত জমিদার বাড়ির প্রকাণ্ড বাগানের লোহার ফটক মস্ত হাঁ করে যেন তাকেই দেখছে। একটিও পাল্লা নেই।
আরও পড়ুন গল্প মৃতবৃক্ষ
রুদ্র শাওন উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দাঁতালো ছুরির মতো ধারালো পৌষের হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডায় ঠক ঠক করে কাঁপছে। তার চারপাশে কুয়াশার কুণ্ডলী যেন মৃতের মতো ধূসর অবয়ব নিয়ে ক্রমাগত পাক খাচ্ছে। আর সে দাঁড়িয়ে আছে সবকিছুর মাঝখানে সমস্ত কিছু তুচ্ছ করে এক ভৌতিক আবহের অশরীরী স্পর্শের ভেতর। লোকালয় থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরের এই পোড়ো জমিদার বাড়ির কোথাও কোনো শব্দ নেই। নির্জন নিস্তব্ধ। এই পতিত পটভূমি, এই নিবিড় নিশীথ প্রহর, এই হিম আরও তীক্ষ্ণ করে তুলেছে রাতের দ্বিপ্রাহরিক নির্জনতাকে। রুদ্র শাওনের মাথা হঠাৎ ঝিমঝিম করে ওঠে। তার মনে হয়, নিকষ কালো অন্ধকারের ভেতর থেকে ‘মেঘতরুণী’ বেরিয়ে আসবে। কিছু একটা ঘটবে, কিছু ঘটতে যাচ্ছে যেন। বিধ্বস্ত শাওন খসে পড়ার মতো ঝরা পাতার স্তূপের ওপর বসে পড়ে। তার মাথার দুপাশের শিরা ব্যথায় টনটন করছে। ছিঁড়ে যাবে বুঝি। সে চিৎকার করে মাধবী নিশীথিনীকে ডাকে, কিন্তু স্বর বেরয় না।
রুদ্র শাওন আধিভৌতিক নিথর রাতের হিম অন্ধকারের ভেতর হঠাৎ দেখে দুটি অত্যুজ্জ্বল নীল চোখ একদৃষ্টে তাকেই দেখছে। যেন জীর্ণ জমিদার বাড়ির ধ্বংসাবশেষের আনাচে-কানাচে জমে থাকা মৃত্যুলিপ্ত অন্ধকারের ভেতর থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এসেছে এক অশরীরী আত্মা। যার দেহ নেই, কেবল দুটি চোখ জ্বলছে বিদ্রূপপূর্ণ ভঙ্গিমায়। অতি চাপগ্রস্ত শাওন নিবিড় মনোসংযোগ করে দেখে একটি ধবধবে সাদা বিড়াল। সে ধড়ে প্রাণ ফিরে পায়। তার মনে হয়, কুয়াশার এক দেবদূত তার একাকিত্বকে অমূল করতে শূন্য থেকে ভৌতিক আবহের ভেতরে একটি পাপড়ির মতো ঝরে পড়েছে। সে আর একা বোধ করে। না।
‘সামন্ত জমিদার বাড়ি’র ক্ষয়ে যাওয়া ভগ্নপ্রায় হতগর্ব দালানগুলোর দিকে তাকায় রুদ্র শাওন। তার মনে হয়, এই বিশাল বাড়ির প্রতিটি কণায় লেপটে আছে আবেগ, তারুণ্য, আনন্দ-বেদনা আর জীবন-মৃত্যুর কত না সংলাপ। প্রতি ভাঁজের ভেতর দিয়ে গভীর ধারায় বয়ে গেছে মৃত্যুলিপ্ত ইতিহাস। গোটা বাড়িটিই যেন ‘এক মৃত্যুর কালপঞ্জি’। কালের এপিটাফ। অবিশ্বাস্য বিয়োগগাথা বুকে নিয়ে জবুথবু হয়ে এখনো মাথা নুয়ে কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে। তবে আলো নেই। গভীর অন্ধকারে ঢলে পড়েছে বহুকাল আগে।
আরও পড়ুন গল্প শিকড়ের সন্ধানে
রুদ্র শাওনের কেন যেন মনে হয়, মধ্যরাতের এই নির্জন পোড়ো বাড়ির অতি আপন একজন সে। যেন এই বাড়ির সঙ্গে কাল-কালান্তরের গভীর সম্বন্ধ তার। যেন শেষকৃত্যের সময়, যখন ঐ দিঘির ঢালু খাদের গভীরে তার কফিনটা নেমে যাবে, সেই সময়ের শবদেহের ভঙ্গুর বিচলনের দৃশ্য স্পষ্ট ভেসে ওঠে চোখের সামনে। সে আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করে, তার আশপাশে কেউ নেই। সে একা।
শাওনের চোখে অশ্রু। সে প্রিয় কারও চোখে ক’ফোঁটা জল দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু অন্তিম শয়ানে প্রিয় কাউকেই দেখেনি। অকস্মাৎ ডান দিকের জরাজীর্ণ দালানটিতে পলিথিন মোড়ানো ভাঙা জানালায় অতি ক্ষীণ আলোর রেখা দেখতে পায়। আতঙ্ক আর বিস্ময় নিয়ে কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ধীর পায়ে দালানটির দক্ষিণ প্রান্তের কক্ষটির দরজায় গিয়ে লঘু হাতে টোকা দেয়। কোনো সাড়াশব্দ নেই। এমনই নিস্তব্ধ যে পিন পড়লেও বুঝি শব্দ শোনা যাবে।
রক্ত হিম করা এই নির্জনতা এই নীরবতা চারদিক থেকে মৃতের মতো বরফ শীতল হাত বাড়িয়ে শাওনকে যেন স্পর্শ করে। আতঙ্কিত শাওন দুহাত দিয়ে দরজা ধাক্কা দেয়। ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে দরজা খুলে যায়। সে ভেতরে ঢোকে। ঘরটিতে কবরের নিস্তব্ধতা আর তারচেয়ে আরও বেশি অন্ধকার। সে ঢলে পড়তে পড়তে কোনোমতে নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখে। এক পাশের সরু পথে ক্ষীণ আলোর রেখা দেখতে পায়। টলতে টলতে একপা দুপা করে মলিন আলোর উৎসের দিকে এগিয়ে যায়। গোলোক ধাঁধার মতো দিশেহারা পথে হাতড়ে হাতড়ে অবশেষে আলো-আঁধারির এক আধিভৌতিক বিশাল কক্ষের সামনে এসে দাঁড়ায় এবং আঁতকে ওঠে।
আরও পড়ুন মাধবী নিশীথিনী-
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
মাধবী নিশীথিনী (১ম পর্ব)