মরিচপোড়া (১ম পর্ব)
মরিচপোড়া (১ম পর্ব)
আমি যখন বাড়িটির সামনে এসে দাঁড়ালাম, সূর্য তখন মধ্য গগন থেকে অল্প একটু হেলে পড়েছে পশ্চিমে। চারদিকে ঝাঁ ঝাঁ সোনা গলানো রোদ। আমিও এসেছি বহু পথ অতিক্রম করে। কত হবে? হাজার লক্ষ ক্রোশ। মাপজোক নেই। আমি কিছুটা ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত। যদিও রোগ, শোক, জরা আমাকে তেমন একটা ছুঁতে পারে না; তারপরও এই নশ্বর পৃথিবীর সবকিছু যেহেতু একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে, আমিই বা অবিনশ্বর থাকি কী করে।
আমি যখন গৃহটিতে প্রবেশ করলাম মিতুজা তখন ঘরের ডুয়া লেপাপোছায় ব্যস্ত। বালতিতে মাটি ও গোবরের মিশ্রণ তৈরি করে সেগুলো দিয়ে লেপাপোছার কাজটি করছিল সে। গৃহের মূল ফটকে এসে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কোত্থেকে একরাশ দমকা বাতাস এসে আমাকে অনেকটা উড়িয়ে নিয়ে দাঁড় করাল উঠোনের একেবারে মাঝখানে। সেই ঘূর্ণিবায়ুযুক্ত বাতাস রাজ্যের সমস্ত ধুলোবালি, ময়লা উড়িয়ে নিয়ে ফেলল মিতুজার চোখে-মুখে।
তপ্ত রোদের উত্তাপ থেকে নিজেকে বাঁচাতে আমি আশ্রয় নিলাম উঠোনের এক প্রান্তে নিমগাছের ছায়ায়। আমার পদসঞ্চার ছিল লঘু ও নিঃশব্দ। বাতাসে কিছুর সঞ্চার ঘটলে বায়ুতরঙ্গে তার কম্পন হয়। কিন্তু সেই কম্পন মিতুজা অবধি পৌঁছাল কিনা ঠিক বোঝা গেল না। গ্রীষ্মের এই দাবানলে সমস্ত গ্রামটি পুড়ে ছাই হচ্ছিল যেন। চোখের ধুলোবালি পরিষ্কার করতে গিয়ে এই প্রথম মিতুজা আমার দিকে তাকানোর সুযোগ পেল। শান্ত দু চোখ যেন দুটি পদ্মকোরক। আমাকে দেখেও তার মধ্যে তেমন ভাব-চাঞ্চল্যের উদয় হলো না। ভাবলেশহীন ও নির্লিপ্ত। ভাবে মনে হচ্ছে যেন এ সময়টায় আমার এখানেই থাকার কথা ছিল। মিতুজা আগের মতোই ডুয়া লেপায় মগ্ন রইল।
আরও পড়ুন গল্প হাইয়া আলাল ফালাহ
ভেবেছিলাম আমাকে দেখে সে হয়তো চমকে উঠবে, ঝটকা খাবে। বিশেষ করে আমার মৃত পাখির মতো বিবর্ণ চোখ দুটো দেখে কিংবা অশ্বত্থ গাছের ঝুরির মতো জটপাকানো লম্বা চুল- যেগুলো কাঁধ ছেড়ে আরো বেশ খানিকটা নীচে নেমে এসে আমার বক্ষ ছুঁয়েছে, সেগুলো দেখে। চারদিক শুনশান নিস্তব্ধতা। মিতুজার স্বামী এন্তাজ শেখ দীর্ঘদিন প্রবাসী। প্রায় বছর দুয়েক ধরে সে কাজ করে আরব দেশে, একটি আতরের কারখানায়। শ্বশুর-শাশুড়ি আর এক দেবরকে নিয়ে তার সংসার। শ্বশুর ময়েজ শেখ সম্পন্ন গৃহস্থ। জমিজিরাত আছে বিশ-বাইশ বিঘার মতো। সমস্ত বিষয়-আশয় বর্গা দিয়ে গায়ে ফুঁ দিয়ে ঘুরে বেড়ানোই তার প্রধান কাজ।
মিতুজার দেবর মন্তাজ শেখ বিএ পাস করে বর্তমানে বেকার। ঘোড়াদহ উচ্চবিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে চাকরির জন্য লাখ দুয়েক টাকা ঘুষ দিয়ে রেখেছে বেশ কিছুদিন। কিন্তু চাকরিটা হবে হবে করেও হচ্ছে না অজানা কোনো কারণে। মিতুজার শাশুড়ি জোমেলা খাতুন ধীরস্থির বৈষয়িক হলেও বেশ মেজাজি মানুষ ।
আমাকে আর কতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে বুঝে উঠতে পারছিলাম না । মিতুজা কি আমায় তুলবে না ঘরে নিয়ে?
বোশেখের হাওয়ার মর্মর শোনা যায় নিমগাছে। বাতাসের তোড়ে জলপাই রঙের দু-চারটা নিম ফল লুটায় মাটিতে। চড়ুই আর শালিকের চূর্ণ কণ্ঠ ভেসে আসে আশপাশের কোনো বৃক্ষ থেকে। বাড়ির পেছনে ঝোপঝাড়গুলোতে কে যেন গাছপালার ডাল, কাণ্ড কাটছে দা দিয়ে; তারই মড়মড় আর্ত আওয়াজ শোনা যায় দূর থেকে। নিমগাছে বসা একটি দাঁড়কাক ঈষৎ তন্দ্রাজড়ানো কণ্ঠে ডেকে ওঠে কৰ্কশ শব্দে ।
আরও পড়ুন গল্প রোদেলা দুপুর কাঁদে
ঘর লেপার জীর্ণ কাপড়, বালতি, ঝাটা নিকোনো উঠানের একপাশে রেখে মিতুজা আমার চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে ইশারা করল ওকে অনুসরণ করতে। আমিও পিদিম থেকে বেরিয়ে আসা জিনের মতো ওর পিছু নিলাম। হাঁটার সময় লক্ষ করলাম মিতুজা পদক্ষেপগুলো ফেলছে এলোপাতাড়ি। অনেকটা অনির্দিষ্ট ভঙ্গিতে। যেন টাল সামলানোটাই ওর জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আকৃতিতে মিতুজা কিছুটা পৃথুলা। কিছুটা বলা আসলে ঠিক হলো না। অপরিসীম কঠিন স্বাস্থ্য। গায়ের রং গাঢ় তাম্রাভ। অনেকটা খেজুরের গুড়ের মতো। কিন্তু সুন্দর মুখশ্রী। কুঞ্চিত ঘন চুলের রাশি পেছন দিকে অনেক দূর পর্যন্ত ঝুলে পড়েছে। দুই চোখে যেন নধর ভাবাবেশ। মিতুজার গাঢ় নীল জমিনের ওপর লাল পেড়ে শাড়িটার জায়গায় জায়গায় কাদামাটির ছোপ ছোপ দাগ। চাপকলের হাতলটা ধরে বার কয়েক চেপে ঘর্মাক্ত মুখটি আপাতত ধুয়ে নিল সে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ইবার কও কেমন আছো মংলু! তোমার আসতি এত দেরি হলো যে। আমি তো মেলা দিন ধইরে তোমার ধ্যান করতিছিলাম।’
আমি আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বললাম,
──বাহ্ বেশ তো, আমার নাম তুমি জানলে কী করে মিতুজা?
──ক্যান ছোটবেলায় মা তোমার কথা কতো কয়ছে। মরার দু দিন আগেও আমার হাত দুইডে ধইরে মা কলো-মারে আমি তোক এতিম কইরে চাইলে যাচ্ছি। কিন্তু বিপদে-আপদে তুই মংলুক স্মরণ করিস। দেখপি ও ঠিক চাইলে আসপি। আমাদের মতো মানষির জন্যি মংলুই হচ্ছে একমাত্র অবলম্বন, আমাদের শেষ আশ্রয়।
আমি কণ্ঠে উচ্ছ্বাস তুলে বললাম,
──তোমার মা সালেহা বেগম একজন মানুষ ছিলেন বটে। রাজেন্দ্রানীর মতো ছিল তার চেহারা। গৌরবর্ণ, ঠিক যেন কুমড়ো ফুলের মতো গায়ের রং। তোমার মায়ের যেমন ছিল সাহস, তেমনি বুদ্ধি। সারাক্ষণ হাসিখুশি। সহাস্য মুখেও তার সে কী দৃঢ়তা। আমি এসব দেখেছি বলেই বলছি।
আরও পড়ুন গল্প পথভোলা এক পথিক
──তা তুমি ঠিকই কচ্ছো মংলু। মায়ের ছিল বুকভরা সাহস আর মাথাভর্তি বুদ্ধি। শুনশান নিশুতি রাতে যখন ভূতের ভয়ে আমরা লালসালু দিয়ে মোড়া লেপের তলায় পলায়ে থাকতেম, চুপি চুপি আমার কানের কাছে মুখটা আইনে মা তখন চাপা গলায় বইলতো-‘ভূত আমার পুত, শাকচুন্নি আমার ঝি, কলেমা কালাম বুকে আছে, করবি আমার কী!’ আমিও মায়ের সঙ্গে সঙ্গে কবিতাখান বারবার মনে মনে পড়তেম-ভূত আমার পুত…। তোমাক আমি কী করো মংলু, এই কবিতাখান মন্ত্রের মতো পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ডর সব কোথায় যে উধাও হয়া যাতো।
আমি বললাম,
──সে সবই তো বুঝলাম। কিন্তু তুমি তো দেখছি তোমার মায়ের রূপের ছিটেফোঁটাও পাওনি।
মিতুজা বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল,
──তা অবশ্যি ঠিক। আমি হয়েছি বাপজানের মতো। হাত দুটো আমার দিকে সম্প্রসারিত করে মিতুজা বলল- দেখিছো মংলু আমার হাতগুলো কেমন হাঁড়ির তলার মতো। আচ্ছা থাক এখন এসব কথা। চাঁদনি রাতে উঠানে পাটি বিছিয়ে মা আর আমি শুইয়ে শুইয়ে যখন গল্প করতেইম, মা তখন তোমার কথা অনেক কতো। মায়ের সাথে তোমার দারুণ ভাব ছিল, তাইনে মংলু? মা নাকি ডাকলিই তুমি চইলে আসতে।
আমি মুখে ঈষৎ হাসি তুলে বললাম,
──সে তো আমাকে আসতেই হতো। কেন, এই যে তুমি আমাকে স্মরণ করলে, আমি কি না এসে পারলাম। ডাকার মতো করে ডাকলে তো ঈশ্বরকেও পাওয়া যায়। কী, ঠিক বলিনি মিতুজা?
আরও পড়ুন গল্প স্বপ্ন জল
শোনো হয়েছে কী একবার। তোমার মায়ের ইলিশ মাছের প্রতি ছিল ভীষণ দুর্বলতা। ইলিশ মাছ পছন্দ না হয়েই বা কী উপায়! তোমার মায়ের আসল বাড়ি তো সেই পদ্মাপাড়ে। রাজবাড়ী জেলার পাংশায়। তোমার বাবা সেই পাংশার মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে এলেন পাবনার ঘোড়াদহ গ্রামে। এ যেন জলের মাছ ডাঙ্গায় তোলার মতো অবস্থা। নতুন বউ, মুখ ফুটে ইলিশ মাছের কথা কাউকে বলতে পারে না। তোমার দাদিও ছিলেন দজ্জাল ও কিপ্টে ধরনের মানুষ। যদিও সপ্তাহে দু-একদিন ইলিশ মাছ কেনা হয় বটে কিন্তু তোমার মায়ের কপালে ইলিশের উচ্ছিষ্ট-কানকো-ল্যাজ এগুলো ছাড়া তো জোটে না কিছুই।
তখন ছিল ঘোর বর্ষাকাল। শ্রাবণ কী ভাদ্র হবে। সুজানগরের হাট থেকে তোমার বাবা বেশ বড় মাপের একজোড়া ইলিশ মাছ কিনে আনলেন। ইলিশ জোড়ার সে কী সৌন্দর্য। রূপার মতো চকচক করছিল মাছ দুটো। পেট ও পিঠে হালকা গোলাপি আভা, মাথার উপর চোখ দুটো দেখে মনে হচ্ছিল যেন কোনো জাত জহুরি নীলমণি হীরে কেটে বসিয়ে দিয়েছে চোখে। সেই ইলিশ দেখে তোমার মায়ের জিহ্বা লকলক করতে লাগল। তিনি ভাবতে লাগলেন কী করে উদরপূর্তি করা যায় ভাজা ইলিশ দিয়ে। শাশুড়ি তো দেবে না এক টুকরোও। তোমার দাদি তোমার মাকে বললেন- সালেহা, যা তো মা, গোটা একটা ইলিশ ভেজে আন জলদি।
আরও পড়ুন মরিচপোড়া-
২য় পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
মরিচপোড়া (১ম পর্ব)