বড়-বাবা-২য়-পর্ব
গল্প,  শাহানাজ মিজান,  সাহিত্য

বড় বাবা (২য় পর্ব)

বড় বাবা (২য় পর্ব)

শাহানাজ মিজান

 

পড়ন্ত বিকেল, রিফাত একটার পর একটা সিগারেট খেয়েই যাচ্ছে। আর ওর মনে হচ্ছে ঐ ধোয়ার মধ্যে দিয়ে হেটে হেটে আসছে দিপা। রিফাতের চোখ দুটো ফুলে লাল হয়ে আছে।
মনে পড়ছে, এই তো সেদিনের কথা। রিফাত গ্রামের হাইস্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করলো। প্রিয় বন্ধু অলিদই পরামর্শ দিলো, বাড়ির বাহিরে একটা ঘর তুলে, সেখানে কোচিং সেন্টার খুলতে।
এখন সব শিক্ষকেরাই এভাবে কোচিং সেন্টার খুলে ছেলে-মেয়েদের পড়ান। তাতে শিক্ষকদের সময় বাঁচে আর ছেলেমেয়েদের ও সুবিধা হয়। বিশেষ করে যেসব পরিবারের, ছেলে-মেয়েদের জন্য একা একজন শিক্ষক বাড়িতে রেখে পড়ানোর সার্মথ‍্য নেই। তাদের জন‍্য তো খুবই ভালো সুবিধা যে তারা অল্প খরচে ভালো শিক্ষকের কাছে পড়তে পারে।

আবার কিছু শিক্ষিত বেকার ছেলেমেয়েরাও এখানে টিউশনী করার সুযোগ পায়। কলেজ বা ভার্সিটিতে লেখাপড়া করছে, এমন কিছু ছেলে-মেয়েরাও এখানে টিউশনী করে নিজেদের পড়াশোনার খরচ যোগাড় করতে পারে। দিপাও তেমন একটি মেয়ে। গরীব বাবা মায়ের মেধাবী সন্তান। দিপা তখন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজে। অলিদের বাড়ির পাশেই ওদের বাড়ি। একদিন অলিদ এসে বললো,

__রিফাত আমাদের এই কোচিং এ তো একজন শিক্ষক লাগবে। হাতেম চাচার মেয়ে দিপা খুবই ব্রিলিয়েন্ট স্টুডেন্ট। ওকে নিয়ে নিই…
__ও কি ছেলে-মেয়েদের পড়াতে পারবে?
__পারবে মানে? খুব ভালো করেই পারবে। আরে ও তো টিউশনি করেই নিজের পড়াশোনার খরচ যোগায়। জানিস তো হাতেম চাচা গরীব মানুষ। বেচারা আমাকে বললো….তাই….। তাছাড়া তুই তো সব সময় গ্রামের উন্নয়নের কথা ভাবিস। গ্রামের মানুষের সুবিধা-অসুবিধার কথা ভাবিস। তাদের যেন উপকার হয়, সেটা ভাবিস….তাই…..

আরও পড়ুন গল্প দীপ্তিদের দেবতা

রিফাত একগাল হেসে বললো,

__আচ্ছা অলিদ, এই কোচিং সেন্টারটা তো আমরা দুজন মিলেই খুলেছি। আমরা দুজনই যেমন শিক্ষক, তেমন প্রানপ্রিয় বন্ধুও। তাহলে তুই তোর সিদ্ধান্তে একজন শিক্ষক নিতে চাস, তাতে এতো আমতা আমতা করার কি আছে? যা করলে ভালো হয়, তা কর।
__তাতো বটেই, কিন্তু তোর একটু রাগ বেশি….তাই আরকি….তুই তো জানিস আমি তোকে একটু একটু ভয়ও পাই….
__আচ্ছা আচ্ছা বুঝেছি (হো হো করে হেসে)। ঠিক আছে কাল থেকে আসতে বলিস। কি যেন নাম মেয়েটার? তাকে বলিস যেন ভালো করে পড়ায়। আমি তো ওকে চিনিই না….
__দিপা খুবই ভালো মেয়ে। খুবই ভদ্র আর শান্ত স্বভাবের মেয়ে। তোকে কোনো চিন্তা করতে হবে না ওর পড়ানো নিয়ে। দিপাও লেখাপড়া শেষ করে আমাদের মতো একজন শিক্ষক হতে চায়। আর তুই ওকে কি করে চিনবি? এপাড়া-ওপাড়া বাড়ি। দিপাও কখনো এদিকে আসে নাই। আর তুই ও তো ওদিকে তেমন একটা যাস না….

__ঠিক আছে, অসুবিধা নেই।

তারপরের দিন থেকে দিপা আসতে শুরু করলো। রিফাত কখনো কোনো মেয়ের দিকে তেমন করে তাকায় না, নিজেই নিজের কাছে বিব্রতবোধ করে।

এরই মধ্যে দশম শ্রেণির প্রাক-নির্বাচনী পরীক্ষা হয়ে গেল। এই ক্লাসের মধ্যে দিশান খুবই দুষ্টু ছেলে।
একটা বিষয়েও পাশ করেনি। আজ যখন কোচিং এ এলো, দিপা বেতটা হাতে নিয়ে বেশ রেগে জিজ্ঞেস করলো,

__কি ব‍্যাপার দিশান, পরীক্ষা এমন হলো কেন?
দিশানের নির্লিপ্ত সত‍্য উত্তর,

__ম‍্যাম, আমি পরীক্ষার আগে একটুও পড়ালেখা করিনি….
__কেন? কি হয়েছিল ?
__ম‍্যাম, আমার কোনো দোষ নাই। ঐ বেটা কবিরাজ একটা তাবিজ দিয়েছিল। আর বললো, ‘এটা ডান হাতের বাহুতে পরতে হবে। তাহলে আর কষ্ট করে পড়ালেখা করতে হবে না। আমি এমনি এমনিই ভালো ফলাফল করতে পারবো।

আরও পড়ুন গল্প স্বর্ণলতা

ক্লাসের সবাই হি হি করে হেসে উঠলো। দিপা নিজেও তার হাসি আটকে রাখতে পারলো না, খিলখিল করে হেসে উঠলো।
হঠাৎ সবাই হাসছে কেন দেখার জন‍্য রিফাত দরজার ওপাশ থেকে উকি দিতেই তার চোখ আটকে গেল দিপার হাসিতে।
কখনো কোনো দিন রিফাত কোনো মেয়েকে এভাবে দেখেনি। একটা মেয়ের হাসি এতো সুন্দর হয়!
কতক্ষণ এভাবে দিপার দিকে পলকহীন তাকিয়ে ছিলো, রিফাতের মনে নেই। পেছন থেকে বড় বাবার কণ্ঠ শুনে চমকে তাকালো। বড় বাবা সেদিন কিছু বুঝতে পেরেছিলেন কিনা জানা নেইট। তবে রিফাত মনে মনে ঠিকই বুঝতে পেরেছিলো যে তার বুকের ভেতরে দিপার জন্য ভালোবাসা সৃষ্টি হয়ে গেছে।

ভালোবাসা লুকিয়ে রাখা যায় না। আর ভালোবাসার মানুষ যদি মুখের ভাষায় কিছু নাও বলে, তার চোখের ভাষা অনেক কিছু বলে দেয়। ভালোবাসার মানুষের সেই চোখের ভাষা বোঝার মতো বয়স, জ্ঞান ও শক্তি দিপার হয়েছে। দিপা যতটা পারে নিজেকে আড়ালে রাখে।
কিন্তু কথায় বলে,

“যার সাথে যার ভাব আছে,
তার মুখ দেখলেও লাভ আছে”

 

রিফাত এবং দিপারও হলো তাই। দুজনই মুখে কিছু বলে না কিন্তু একে অপরের চোখে চোখ পরলেই, সেই চোখের ভাষায় যেন অনন্ত কালের গল্প বলে যায়।
রিফাত আর নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারলো না। অলিদকে সব কথা বলে দিল। এক বছর হলো অলিদ বিয়ে করেছে। আজ রিফাতের কথা শুনে মহা খুশিতে বললো,

__তুই আর দেরি করিস না, দোস্ত। দিপাকে তোর মনের কথা বলে দে। দিপা রাজি থাকলে বড় বাবাকে বলে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো যাবে।

আরও পড়ুন গল্প ওরা তেরোজন

অলিদ কথাগুলো সহজে বললেও, কপালে চিন্তার ভাঁজ পরে গেল। কিছুক্ষ চুপ থেকে আবার বললো,

__কিন্তু দোস্ত, তোরা এতো ধনী আর দিপা গরীব দিন মজুরের মেয়ে। তোর পরিবারের সবাই কি দিপাকে মেনে নিবে?
__আরে এসব নিয়ে চিন্তা করিস না। আমি দিপাকে ভালোবাসি, এটাই সবচেয়ে বড় কথা। আর বড় বাবা যদি মেনে নে্‌ তাহলে পরিবারের আর কারো মানা না মানায় কিছু আসে যায়না।
__আচ্ছা, বড় বাবা যদি মেনে না নেন ?
__আমার বিশ্বাস  বড় বাবা আমার ভালোবাসাকে ঠিক মেনে নিবেন।
__কিন্তু, তোর বাবা ?

রিফাত ভ্রু কুচকে অলিদের দিকে তাকালো।

আরও পড়ুন গল্প বড় বাবা গল্পের-
১ম পর্ব
৩য় পর্ব
শেষ পর্ব

 

 

ঘুরে আসুন আমাদের ফেসবুক পেইজে

বড় বাবা (২য় পর্ব)

Facebook Comments Box

শাহনাজ মিজান গল্প ও উপন্যাস লেখেন। প্রকাশিত উপন্যাস: অধরা চাঁদ; গল্পগ্রন্থ: আকাশে চাঁদের পালকি তিনি ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের ৩১শে ডিসেম্বর পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত দুলাই ইউনিয়নের চরদুলাই গ্রামে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!