বড় বাবা (১ম পর্ব)
বড় বাবা ( ১ম পর্ব)
শাহানাজ মিজান
আকাশে প্রচণ্ড মেঘ জমেছে। সন্ধ্যা নেমে আসছে। রিফাত দোকানে এলো। তাড়াতাড়ি কয়েক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলে, দোকানদার চাচা বললেন,
__বাবা রিফাত! তোমার কি এই কাম সাজে? কি মানুষ তুমি আর কি করছো? সব তো ঠিকই অয়া যাবি। এতো পাগলামি করো না বাবা।
রিফাত সিগারেট ধরিয়ে একগাল ধোঁয়া ছেড়ে, দোকানদার চাচার দিকে একবার তাকালো। তারপর কোনো কথা না বলেই চলে গেল।
রিফাত আগে দিনে দুটো সিগারেট খেত। ভার্সিটিতে লেখাপড়া করার সময় বন্ধুদের পাল্লায় পরে সিগারেট খাওয়া শিখেছিলো। শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর ভেবেছিল, আর কখনো সিগারেট খাবে না। আর যাই হোক সে এখন একজন দেশ গড়ার কারিগর। কিন্তু ইদানীং সে প্রতিদিন তিন চার প্যাকেট সিগারেট ছাই করে ধোঁয়া উড়িয়ে দেয়।
একেকবার নিজের মনে নিজেই বলে, সত্যিই তো, আমার এমন আচরণ করা মানায় না। লোকে কি বলবে? কিন্তু দিপার কথা মনে হলেই আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। সিগারেট খেতে খেতে সে নিজেকে নিজেই ভুলে যায় কিন্তু দিপাকে তো কিছুতেই ভুলতে পারছে না।
দিপা জানে, রিফাত তাকে কতোটা ভালোবাসে। সব জেনে বুঝেও তাকে বলতে হয়েছে, “তুমি আমাকে ভুলে যাও।” গ্রামে বসবাস করে বড়লোকের ছেলের সাথে প্রেম করা তার কি মানায়? এছাড়া সে একজন দিনমজুরের মেয়ে।
প্রিয় বন্ধু অলিদ এসেছে। রিফাতকে অনেক বোঝাতে চেষ্টা করছে। কিন্তু রিফাত দিপাকে ছাড়া এই মুহূর্তে আর কিছুই বুঝতে চাইছে না। সে যেদিকে তাকায় সেদিকেই শুধু দিপাকে দেখতে পায়।
রিফাতের মা এসে কাদছেন। তিনিও ছেলেকে বোঝাতে চাইছেন। কিন্তু রিফাতের একটাই কথা, সে আর বাড়ির ভিতরে যাবে না। এই বাহির বাড়িতে যে কোচিং সেন্টার খুলছে, সে ঘরটিতেই থাকবে।
মা বার বার বলছেন,
__তোর বড় বাবা এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। এইতো আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা কর।
রিফাত নিজেও জানে যে, বড়বাবা এলে সবকিছুই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ওর সমস্ত রাগ-অভিমান সবটা ওর বাবার উপর।
আরও পড়ুন গল্প জীবনের উপহাস
অনেক দিন ধরে বড় বাবার শরীরটা বেশ খারাপ যাচ্ছিলো। তাই তিনি চেকআপের জন্য বতর্মানে ইন্ডিয়াতে আছেন। আর দশ-বারো দিন পরেই ফিরবেন।
সেদিন ডাইনিং টেবিলে বসে, খেতে খেতে বাবা বললেন,
__অনেক দিন ধরেই তোমার বিয়ের কথা ভাবছি। পাশের গ্রামে আমি একটা মেয়ে দেখে এসেছি। তোমার বড় বাবা দেশে ফিরলেই সব কথা ফাইনাল হবে। এর মধ্যে তুমি যদি মেয়েটাকে দেখতে চাও তো, দেখে আসতে পারো। আর তোমার যদি পছন্দের কেউ থেকে থাকে, সেটাও আমাদের জানাতে পারো।
রিফাত মাথা নিচু করে বলেছিল,
_আমি দিপাকে পছন্দ করি।
কথাটা শুনে রিফাতের বাবার মাথায় আগুন চড়ে গেল।
__তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? কি বলছো এসব? কোথায় তুমি আর কোথায় দিপা?
__দিপা খুব ভালো মেয়ে।
__সেটা জানি। কিন্তু ওদের পারিবারিক অবস্থান? সেটা ভুলে গেছো?
__আমি দিপার পারিবারিক অবস্থানকে বিয়ে করবো না। আমি শুধু দিপার কথা বলেছি। আর তুমিই তো বললে, আমার কোনো পছন্দ আছে কিনা।
__তাই বলে দিপা (রেগে)? আর কোনো মেয়ে খুজে পেলে না?
__আমার পছন্দের কোনো মূল্যই যদি তোমার কাছে না থাকে, তাহলে আমাকে জিজ্ঞেস করার দরকার কি? আমি দিপাকে ভালোবাসি। আমার জন্য অন্য কোনো মেয়ে দেখার কোনো প্রয়োজন নেই।
কথাটা বলেই রিফাত ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
আরও পড়ুন গল্প রাজামারা
রিফাতের বাবা রেগে তার মাকে বললেন,
__ছেলেকে তো ভালো শিক্ষা দিয়ে মানুষ করছো, যে নিজের বাবাকে বাবা বলে ডাকে না। তাই বলে আমি তো আমার দায়িত্ব থেকে সরে আসতে পারি না। কথাটা মনে রেখ।
__আমার উপরে রাগ দেখাচ্ছো কেন? আমি কি করেছি! সন্তান যখন ভালো কিছু করে তখন সব বাবারা গর্ব করে বলে আমার সন্তান। আর যদি পান থেকে চুন খসে, ওমনি সব দোষ এসে পরবে মায়ের ঘাড়ে, তাই না?
__আমার ছেলে কি এমন খারাপ কাজ করেছে? ছেলের বিয়ের বয়স হয়েছে। সে একটা মেয়েকে ভালোবাসে। এতে দোষের কি আছে?
__ওহ হো, এখন বুঝলাম, সবই তোমার আস্কারাতেই হয়েছে। একটা কথা জেনে রাখো। তোমরা মা ছেলে মিলে যতই গিট পাকাও না কেন, এই গিট কি করে খুলতে হয়, সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি।
__তুমি এতো রাগ করছো কেন, তাইতো বুঝতে পারছিনা? কেবল বিয়ের কথা হচ্ছে। এখনই তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না। তাছাড়া বড় ভাইজান এখন দেশের বাইরে আছেন। তিনি না ফেরা পযর্ন্ত তো কোনো সিদ্ধান্ত তোমরা নিতে পারবে না। তাই বলছি, অপেক্ষা করো। বড় ভাইজান আসুক। তিনিই রিফাতকে বোঝাবেন। যা ভালো হয় তিনি তাই করবেন।
রিফাতের বাবা আর কিছু না বলে বাইরে চলে গেলেন। তার ছোট বেলার বন্ধু ফিরোজ মেম্বারকে গিয়ে বললেন,
__আমার ছেলে টাকে একটু বোঝাও। সে যেন এমন পাগলামি না করে। ঐ দিনমজুর হাতেম আলীর মেয়েকে সে যদি বিয়ে করে, আমার মান-সম্মান কিচ্ছু থাকবে না।
ফিরোজ মেম্বার বন্ধুকে শান্তনা দিয়ে বললেন,
__তুমি কোনো চিন্তা করো না, বন্ধু। আমি দেখছি কি করা যায়।
ফিরোজ মেম্বার মানুষ হিসেবে বিশেষ সুবিধার নয়। তিনি সমস্ত গ্রামে রটিয়ে দিলেন যে, দিপা তার রুপের ফাঁদে ফেলে রিফাত মাস্টারকে বিয়ে করতে চায়।
দিপাকে নিয়ে চারিদিকে কানাঘুসো শুরু হয়ে গেলো। গ্রামের মানুষের যেন একটা কাজ বাড়লো। যে একটা কথা বলার যোগ্যতা রাখে, সে দু-কথা শুনিয়ে দিয়ে যায়। আর যার কোনো কথা বলার যোগ্যতাই নাই, সে পারলে দশ কথা শুনিয়ে দিয়ে যায়।
আরও পড়ুন অশরীরী আত্মা
এতো কথা শুনেও হাতেম আলী কিছু বলতে পারে না। শুধু “ইয়া আল্লাহ রহম করো” বলে আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দেয়। এই পৃথিবীতে গরীবেরা তো চিৎকার করে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করতে পারে না।
আর দিপা মানুষের কথায় নয়। বাবাকে কষ্ট পেতে দেখে নিজে কষ্ট পায়। দিপার আরো দুটো ছোট-ভাইবোন আছে। ওরা স্কুল-কলেজে যাওয়া আসার সময় লোকজন আশে পাশে থেকে কথা শোনায়। ওরা বাড়িতে এসে সে সব কথা বলে। দিপা সব কথা শুনে চুপচাপ বসে থাকে। কখনো কখনো দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরে। আবার কখনো কখনো অশ্রু লুকিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে দুই ভাই-বোনকে খেতে দেয়। কিংবা অন্য কথা দিয়ে ভোলাতে চেষ্টা করে।
আরও পড়ুন গল্প বড় বাবা গল্পের-
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
বড় বাবা (১ম পর্ব)