বড় বাবা (শেষ পর্ব )
বড় বাবা (শেষ পর্ব )
শাহানাজ মিজান
রিফাতের মা বললেন,
__না ভাইজান। এই বাড়িতে বউ হয়ে আসা থেকে শুরু করে সন্তানদের বড় হয়ে ওঠা, ওদের ভালো-মন্দ সবকিছু আপনি দেখাশোনা করেছেন। তাই আমি মনে করি শুধু রিফাত নয়, এ বাড়ির সব ছেলে-মেয়েদের সমস্ত ব্যাপারে কথা বলার, তাদের জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার একমাত্র অধিকার আপনার।
__না রিফাতের মা। তোমরা শুনলে না, মেঝ কি বলল?
__(চোখের পানি মুছে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে) শুনেছি ভাইজান। আমি আমার স্বামীর হয়ে আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি।
__ভাইজান, কারো অজানা নাই যে আপনি এই সংসারের জন্য, সব ভাই-বোনদের জন্য কি করেছেন। কেউ যদি সেটা অস্বীকার করতে চায় সেটা তার ব্যাপার। রিফাতকে আমি পেটে ধরেছি আর উনি তার জন্মদাতা। শুধু জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায় না। সংসারে কিছু টাকা দেওয়া ছাড়া সন্তানদের প্রতি কোনো দায়িত্ব তিনি পালন করেননি। আমার রিফাত তার বাবাকে চিনতোই না। তাই সে বড় হওয়ার পরেও তাকে বাবা বলে ডাকতে পারে না, সংকোচ বোধ করে। ভাইজান, আমার রিফাত এই সংসারের বড় সন্তান। আপনি তাকে ভালোবেসে, বুকে আগলে রেখে, সুশিক্ষিত করে মানুষ করেছেন। রিফাত কষ্ট পাবে এমন কোন সিদ্ধান্ত আপনি নেবেন না সেটা আমি জানি। তাই আপনি বলেন কি করবেন?
রিফাতের বাবা রেগে বললেন,
__তাই বলে একজন দিনমজুরের মেয়েকে…….
এবার বড় বাবা খুব জোরে, সিংহের মতো হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন,
__থামো। বার বার একই কথা! তুমি কোন লাট বাহাদুর? দুই দিনের বৈরাগী ভাতের কও অন্ন! তোমার আগের দিনের কথা সব ভুলে গেছ? তোমার অবস্থা যদি আগের মতো থাকত, হাতেম আলী গরীব হলেও তোমার ছেলের হাতে তার মেয়েকে তুলে দিত না। আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম যে রিফাত দিপাকে ভালোবেসে ফেলেছে। তাই একদিন হাতেম আলীর বাড়িতে গিয়েছিলাম। হাতেম আলী দিনমজুর হলেও তার গোছানো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সংসার। দিপা নম্র ভদ্র শিক্ষিত একটা সুন্দর মেয়ে। আর তোমার ছেলে তাকে ভালোবেসেছে।
আরও পড়ুন এ কে আজাদ দুলাল রচিত গল্প সোনালী
__শোনো তোমরা, আমাদের পারিবারিক অবস্থার কথা এই গ্রামের কারো অজানা নয়। গরীব দোকানদার বাপের আটজন সন্তানের মধ্যে আমি সবার বড়। একটা মাত্র ঘরের মধ্যে গাদা-গাদি করে বসবাস করেছি।
স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে সবেমাত্র কলেজে পা রেখেছি আমি। তখন ও পাড়ার ধনী বাড়ির মেয়ে মিতালীকে আমি ভালোবেসেছিলাম। মিতালী দেখতে তেমন সুন্দরী না হলেও তার মধ্যে ধনী বাবার অহংকার ছিল। একদিন মিতালীকে ভালোবাসার কথা বলার অপরাধে ওর বড় ভাই আমার বুকে লাথি মেরেছিলো। বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে বলেছিল, আমি যেন তার বোনের দিকে চোখ তুলে না তাকাই।
আমি গরীব, দেখতেও সুন্দর নই বলে, মিতালী আমাকে পছন্দ করেনি। সেদিন আমি খুব কেঁদেছিলাম। চোখের পানিতে বুক ভেসে গেলেও মন থেকে মিতালীকে ভুলতে পারিনি।
ওরা সেদিন দেখেছিল আমাদের অগোছালো নোংরা পরিবেশ। আমার বুকের ভেতরের সীমাহীন ভালোবাসা দেখতে পায়নি কেউ। মিতালীর বিয়ে হয়ে গেল অনেক ধনী ছেলের সাথে। আমার ভালোবাসা ছিলো এক তরফা। কষ্ট পেয়েছিলাম খুব কিন্তু ভেঙ্গে পড়িনি। বাবার সাথে সংসারের হাল ধরেছি। ভাই-বোনদের মানুষ করেছি। মেঝ লেখাপড়া করলো না। তাই বাবার এক কানী জমি ছিল, সেটা বিক্রি করে ওকে বিদেশ পাঠালাম। আল্লাহর রহমতে ও ভালো টাকা-পয়সা রোজগার করার পাশাপাশি অহংকারও অর্জন করেছে।
ছোট দুই ভাইয়ের লেখাপড়া করানো, চাকরি দেয়া, ভাই-বোনেদের বিয়ে দেয়া সবই করলাম। তোমরা বলত, আমি কি শুধু মিতালীকে ভালোবেসে জীবন পার করে দিলাম, তোমাদের ভালোবাসিনি? আমার জন্য মা বাবা খুব কষ্ট পেতেন। সবার প্রতি সমস্ত দায়িত্ব পালন করতে করতে যেদিন নিজের দিকে তাকালাম, সেদিন দেখলাম সময় অনেক গড়িয়ে গেছে। এই জগত সংসারের নিয়ম হল, যে যার জন্য বেশি ত্যাগ স্বীকার করবে, সে তত দোষী হবে। ত্যাগীরা সব সময় দোষের ভাগীদার হয়। তাই নিজেকে বিলিয়ে দিলাম মানুষের কল্যাণে। গ্রামের মানুষও আমাকে ভালোবেসে সম্মান করে, বার বার চেয়ারম্যান বানিয়েছে। আজ এই বাড়িতে পাকা দালানে শুয়ে তোমরা সেই ভাঙা ঘরের কথা ভুলে গেছ। কিন্তু আমি কিছু ভুলিনি। সেদিন দারিদ্রতার কাছে আমার ভালোবাসা হেরে গিয়েছিল। ধনী আর দারিদ্রতার অভিশাপের কাছে ভালোবাসারা বার বার এভাবে হারিয়ে যেতে পারে না। তাই আজ রাতেই দিপার সাথে রিফাতের বিয়ে হবে। তোমরা সবকিছুর আয়োজন কর।
আরও পড়ুন রাতুল হাসান জয় রচিত গল্প পরাজিত নাবিক
রিফাতের অন্যান্য চাচা, চাচাতো ভাই-বোনেরা সবাই খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। বড় বাবা রিফাতের কাধে হাত রেখে বললেন,
__বেটা রিফাত। এবার বল, তুমি কি শুধু দিপাকে ভালোবাস নাকি দিপার চারপাশটাকেও ভালোবাস?
রিফাত প্রশ্নাতুর চোখে বড় বাবার দিকে তাকাল।
__আমি বলতে চাইছি যে দিপা তার পরিবারের বাইরের কেউ নয়। আজ দিপা তোমার স্ত্রী হবে। কিন্তু কাল দিনমজুর হাতেম আলীকে লোকজনের মধ্যে বাবা বলে ডাকতে হবে। তোমার লজ্জা বোধ হবে না তো?
রিফাত বড় বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
__না, বড় বাবা। আমি দিপার ভাল-মন্দ সবটুকুকেই ভালোবাসি।
বর বেশে রিফাত। রাতে সবাই তাকবীর দিয়ে হাতেম আলীর বাড়িতে এল। বড় বাবা হাত জোড় করে হাতেম আলীকে বললেন,
__ভাই হাতেম আলী, তোমার দিপা আজ থেকে আমার মেয়ে। আমি তাকে রিফাতের সাথে বিয়ে দিতে চাই, এখন তুমি অনুমতি দাও।
হাতেম আলী চোখের পানি মুছে বললেন,
__এই তো কইলেন দিপা আপনের মেয়ে। তালি আমার অনুমতির কি আছে চেয়ারম্যান সাব? আপনের মেয়ে আপনে নিয়া যান।
দু’জনের কথাবার্তা শুনে, তাদের অনুমতি নিয়ে উপস্থিত সবাই মহানন্দে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করল।
আরও পড়ুন গল্প বড় বাবা গল্পের-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের ফেসবুক পেইজে
বড় বাবা (শেষ পর্ব)