বীর-মুক্তিযোদ্ধা-শহিদ-বু
কৃতি ব্যক্তিবর্গ,  ভাটিকয়া,  মুক্তিযোদ্ধা,  রানীনগর

বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ বুলবুল 

বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ বুলবুল

 

আমিরুল-ইসলাম-রাঙা
আমিরুল ইসলাম রাঙা 
রাধানগর মজুমদার পাড়া, পাবনা।

বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ বুলবুল পাবনায় মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শহিদ মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর প্রকৃত নাম জি এম শামসুল আলম বুলবুল। এমন নামে পরিচিতি খুব কম মানুষের কাছে জানা। যদি বলা হয় পাবনার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শহিদ বুলবুল কলেজ যার নামে তিনি সেই বুলবুল। তাহলে সেই শহিদ বুলবুলের পরিচিতি লক্ষ কোটি মানুষের মাঝে। যদি বলা হয় কে সেই বুলবুল? কোন যুদ্ধে কেমন করে তিনি শহিদ হয়েছিলেন। কোথায় তাঁর বাড়ী, কি তাঁর পরিচয়? আমার ধারণা এমন প্রশ্নের উত্তর খুব কম মানুষ দিতে পারবেন ।

পাবনা শহরের বুকে গড়ে উঠা পঞ্চাশ বছরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শহিদ বুলবুল কলেজে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী কিংবা কর্মরত শিক্ষক কর্মচারীর মধ্যে কতজন সঠিক করে শহিদ বুলবুল সম্পর্কে বলতে পারবেন তা নিয়ে সংশয় আছে। সবার কাছে মনে হয় শহিদ বুলবুল ত্রিশ লক্ষ শহিদের মধ্যে হয়তো একজন সাধারণ শহিদ। এই প্রজন্মের কতজন জানেন, শহিদ বুলবুল একজন সাধারণ শহিদ নন। তিনি ছিলেন অসীম সাহসী এক অসাধারন যোদ্ধা। মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাবনায় পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধে তিনি ছিলেন প্রথম শহিদ মুক্তিযোদ্ধা।

১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী পাবনা শহরে প্রবেশ করে বর্তমান বিসিক শিল্পনগরীতে অবস্থান গ্রহণ করে। কার্ফু জারী করে জনগনকে ঘর থেকে বের না হওয়ার ঘোষণা করে। দিনগত রাতে ঢাকা সহ সারাদেশে অপারেশন সার্চলাইটের নামে হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। পাবনায় ২৬ মার্চ শহরের গোপালপুর মহল্লা থেকে জেলা আওয়ামী লীগ নেতা নব-নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এডভোকেট আমিন উদ্দিন, ন্যাপ ভাসানীর জেলা সভাপতি ডাঃ অমলেন্দু দাক্ষী, পরিবহন ব্যবসায়ী সাঈদ উদ্দিন তালুকদার সহ অর্ধ শতাধিক মানুষকে গ্রেপ্তার করে।

আরও পড়ুন সুজানগরের একমাত্র খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা বীর প্রতীক আজিজুর রহমান

২৭ মার্চ শহরের কৃষ্ণপুর মহল্লায় জানাজা নামাজ পড়ার সময় নিরীহ মুসল্লীদের উপর গুলিবর্ষণ করে মানুষ হত্যা করে। একইদিন পাবনা পুলিশ লাইনে একাধিকবার আক্রমণ করে। ২৭ মার্চ রাতে পাকিস্তানী সৈন্যরা পুলিশ লাইন আক্রমণ করতে গেলে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। সারারাত ধরে চলা প্রতিরোধ যুদ্ধে পাবনার হাজার হাজার মানুষ শরীক হয়।

২৮ তারিখ দুপুরের আগে শহরের টেলিফোন একচেঞ্জে অবস্থানরত সমস্ত পাকিস্তানী সৈন্যকে হত্যা করা হয়। এরপর সাধারন জনতা পাবনা বিসিক শিল্প এলাকা এবং লস্করপুরে অবস্থিত বর্তমান বাস টার্মিনালের দক্ষিণ পাশে বর্তমান ওসামা ফিলিং স্টেশনের  উপর বানানো চেকপোস্টে অবস্থানরত পাকিস্তানী সৈন্যদের উপর আক্রমন শুরু করে। এখানেই শত শত যোদ্ধার সাথে রাইফেল হাতে যুদ্ধে শরীক হন, জি,এম শামসুল আলম বুলবুল।

প্রসঙ্গগত উল্লেখ্য, লস্করপুর ঘটনাস্থল থেকে কয়েশ শত গজ পশ্চিমে বর্তমান আতাইকুলা সড়কে গোলাম আলী কাদেরী সাহেবের বাড়ী। সাথেই বুলবুলদের বাড়ী। সামনের পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য আব্দুর রব বগা মিয়ার বাড়ী। আগেররাত থেকে চলা যুদ্ধে শহরের টেলিফোন একচেঞ্জে অবস্থান করা পাকিস্তান সৈন্যদের হত্যা করার পর যখন লস্করপুর চেক পোস্টে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত হয় তখন জি,এম শামসুল আলম বুলবুল এবং তাঁর প্রতিবেশী বন্ধু আবুল মহসীন বেগ মুকু একসাথে রাইফেল এবং বন্দুক হাতে ঘটনাস্থলে রওনা হয়। পাকিস্তানী সৈন্যদের চেকপোস্টের কয়েশ গজ পশ্চিমে বর্তমান বিআরটিসি বাস ডিপোর সামনের রাস্তা ধরে উত্তর দিকে অবস্থান নিয়ে গুলিবর্ষণ শুরু করে। পাকিস্তান সৈন্যদের চতুর্দিকে ঘিরে সাধারণ জনতা গুলি করতে করতে প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে যায়।

আরও পড়ুন বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন সন্টু

এক পর্যায়ে জি এম শামসুল আলম বুলবুল মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরন করেন। এর কিছুক্ষণ পরেই পাশে থাকা সহযোদ্ধা আবুল মহসীন বেগ মকু গুলিবিদ্ধ হয় এবং সেও ঘটনাস্থলে মৃত্যুবরণ করেন। উক্ত যুদ্ধে আরো দুইজন মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন। তাঁরা হলেন আমিরুল ইসলাম ফুনু এবং আফছার আলী। সেই যুদ্ধে চারজন মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হয়েছিলেন এবং সর্ব প্রথমে শহিদ হন জি,এম শামসুল আলম বুলবুল। পরবর্তীতে লস্করপুর চেকপোস্টে অবস্থানরত তিনজন পাকিস্তানী সৈন্যকে হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বিরল ঘটনা হলো ২৯ মার্চ পাবনা হানাদার মুক্ত হয় এবং ১০ এপ্রিল পর্যন্ত পাবনা শত্রুমুক্ত থাকে। আর সেই অমর কৃতিত্বের সাথে যুক্ত হয় শহিদ বুলবুল এর নাম। যিনি পাবনায় প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধে প্রথম শহিদ হয়েছিলেন।

জন্ম: শহিদ জি এম শামসুল আলম বুলবুল ১৯৫৪ সালের ১ মার্চ, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার রাণীনগর ইউনিয়নের ভাটিকয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

পারিবারিক জীবন: পিতার আব্দুস শুকুর মিয়া এবং মাতা মোচ্ছা: রোকেয়া বেগম। তাঁরা ৬ ভাই ও ৭ বোন।

শিক্ষা জীবন: শহিদ বুলবুল তাঁর নিজ গ্রাম ভাটিকয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া সম্পন্ন করে পাবনা শহরে এসে মহিম চন্দ্র জুবিলী স্কুলে ভর্তি হন। প্রথমে তাঁর ভগ্নিপতি পাবনার প্রখ্যাত চিকিৎসক ডা. হারুনর রশীদের বাড়ীতে থাকলেও পরবর্তীতে শালগাড়ীয়া মহল্লায় গোলাম আলী কাদেরী সাহেবের বাড়ীর সাথে তাঁর বাবা বাড়ী ক্রয় করেন। শহিদ বুলবুল ১৯৬৯ সালে পাবনা মহিম চন্দ্র জুবিলী স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তৎকালীন ইসলামিয়া কলেজ (বর্তমান শহিদ বুলবুল কলেজ) এ ভর্তি হন।

আরও পড়ুন বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইদ মো. আহসান হাবিব

রাজনৈতিক জীবন: তাঁর বড় ভাই জি এম ফখরুল আলম জিন্নাহ তৎকালীন ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র এবং  ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। সেই সময়ে পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুস সাত্তার লালু, সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বকুল, সাহাবুদ্দিন চুপ্পু, রেজাউল করিম, আবদুল কাদের প্রমুখ বড় ভাই জি এম ফখরুল আলম জিন্নাহ’র ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং সহযোগী। সেই সুত্রে শহিদ বুলবুল নিজেও ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬৯ এর গণআন্দোলন এবং ৭০ এর নির্বাচনে সক্রিয় কর্মী হিসেবে অংশ নেন। ১৯৭১ এর মার্চ মাসের শুরু থেকে অসহযোগ আন্দোলন, স্বাধীকার আন্দোলন এবং পরিশেষে স্বাধীনতা আন্দোলন এসব কিছুতেই শহিদ বুলবুল জড়িত ছিলেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ বুলবুল এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। তাঁর বাবা আব্দুস শুকুর মিয়া এলাকার জোতদার ছিলেন। এলাকায় অত্যন্ত জনপ্রিয় মানুষ ছিলেন। স্বাধীনতার আগে উনি ইউনিয়ন পরিষদের প্রেসিডেন্ট এবং পরবর্তীতে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। স্বাধীনতার পরে শহিদ বুলবুল এর বড় ভাই জি এম ফখরুল আলম জিন্নাহ কয়েক মেয়াদে চেয়ারম্যান ছিলেন। উনি অকাল মৃত্যুবরণ করলে আরেক ভাই জি এম মাহফুজুল আলম আশিষ চেয়ারম্যান হন। বর্তমানে শহিদ বুলবুল এর ছোট ভাই জি,এম তৌফিকুল আলম পিযুষ রানীনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের বীর যোদ্ধা শহিদ বুলবুল এর গোটা পরিবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন এবং ধারণ করে চলেছেন।

বুলবুল কলেজ নামকরণ: ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তৎকালীন ইসলামিয়া কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যক্ষ এম এ গনি ইসলামিয়া কলেজের নাম পরিবর্তন করে শহিদ বুলবুল কলেজ করেন। কলেজটি প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭৬ সালে শহিদ বুলবুল এর মা এই কলেজের নামে তাঁর গ্রামে ১০ (দশ) বিঘা জমি দান করেন। ১৯৮৩ সালে রাষ্ট্রপতি হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ শহিদ বুলবুল কলেজকে সরকারিকরণ করেন । বর্তমানে উক্ত কলেজটি সুনামের সঙ্গে পরিচালিত হয়ে আসছে।

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

Facebook Comments Box

প্রকৌশলী মো. আলতাব হোসেন, সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশ এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত অলাভজনক ও অরাজনৈতিক সংগঠন ‘আমাদের সুজানগর’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সাধারণ সম্পাদক। তিনি ‘আমাদের সুজানগর’ সাহিত্য সংকলনের সম্পাদক এবং ‘আমাদের সুজানগর’ ওয়েব ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও প্রকাশক। এছাড়া ‘অন্তরের কথা’ লাইভ অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক তিনি। সুজানগর উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, কৃতি ব্যক্তিবর্গ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে ভালোবাসেন। বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি স্বনামধন্য ওয়াশিং প্লান্টের রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেকশনে কর্মরত আছেন। তিনি ১৯৯২ সালের ১৫ জুন, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালী ইউনিয়নের সাগতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!