বিসর্গ বর্ণের ব্যবহার
কিন্ডার গার্টেন,  পড়াশোনা,  প্রাথমিক বিদ্যালয়,  মাদ্রাসা,  মাধ্যমিক বিদ্যালয়

বিসর্গ বর্ণের ব্যবহার

বিসর্গ বর্ণের ব্যবহার

মো. আলতাব হোসেন

 

বিসর্গ একটি বাংলা বর্ণ; এটি কোনো চিহ্ন নয়। বর্ণ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। বিসর্গ বর্ণটি পরাশ্রয়ী, অনুস্বার ও চন্দ্রবিন্দুর মতোই অন্য বর্ণের সাথে যুক্ত হওয়া ছাড়া এটির কোনও কার্যকারিতা নেই।

 

১. শব্দ-সংক্ষেপে বিসর্গ

ভাষার গতিবৃদ্ধির জন্য শব্দসংক্ষেপ অপরিহার্য। তাই শব্দ সংক্ষেপ করার জন্যও প্রত্যেক ভাষারই থাকা চাই সর্বজনবিদিত সুনির্দিষ্ট নিয়ম। আমাদের বাংলা ভাষায়ও আছে তেমন কিছু নিয়মকানুন। কিন্তু সে নিয়ম আমরা অনেকেই অনুসরণ করছি না, প্রয়োগ করছি না।

শব্দ-সংক্ষেপ করার জন্য আগে বিসর্গ এবং অনুস্বার ব্যবহার করা হতো। আমরা এখনো নামের আগে উত্তরাধিকার সূত্রে মোহাম্মদ এর সংক্ষিপ্ত রূপ হিসেবে ব্যবহার করে আসছি ‘মোঃ’ অথবা ‘মো:’। এখানে বিসর্গ (ঃ) হচ্ছে একটি পৃথক বর্ণ এবং কোলন (:) হচ্ছে একটি বিরাম চিহ্ন, কাজেই এগুলোর কোনোটিই শব্দ সংক্ষেপে ব্যবহৃত হওয়া সমীচীন নয়। প্রমিত বানানে শব্দ-সংক্ষেপ করার ক্ষেত্রে কেবল বিন্দু বা ডট (.) চিহ্ন ব্যবহার করা হয়।

বিসর্গ দিয়ে ডঃ, ডাঃ, মোঃ, মোছাঃ, খ্রিঃ এরূপ লেখা যাবে না। সংক্ষেপচিহ্ন হলো একবিন্দু (.)। ড. (ডক্টর), ডা. (ডাক্তার), মো. (মোহাম্মদ), মোছা. (মোসাম্মত), হি. (হিজরি), খ্রি. (খ্রিস্টাব্দ), ই. (ইংরেজি) ইত্যাদি একবিন্দু (.) দিয়ে লিখতে হবে।

গভঃ দিয়ে গভর্নমেন্ট, প্রাঃ দিয়ে প্রাইভেট, লিঃ দিয়ে লিমিটেড, সাঃ দিয়ে ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’, রাঃ দিয়ে ‘রাদিয়াল্লা হু আন হু’ ইত্যাদি লেখা হয়ে থাকে প্রায়শই। গভ. (গভর্নমেন্ট), প্রা. (প্রাইভেট), লি. (লিমিটেড), সা. (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), রা. (রাদিয়াল্লা হু আন হু) ইত্যাদি একবিন্দু (.) দিয়ে লিখতে হবে।

আরও পড়ুন ভাষা নিয়ে ভাবনা

ইংরেজিতে Govt., Ltd., Mr., Dr. আধুনিক বানানে এ ধরনের শব্দে ডট ছাড়াও ব্যবহার করা যায়। যেমন: Mr, Dr ইত্যাদি।
ইংরেজি শব্দের সংক্ষিপ্ত বর্ণ রূপে (Abbreviation) ডট ব্যবহার না করাই ভালো। যেমন: SSC, HSC, SMS, BSS, BA, MPO, UN, BGB, BSF, BPL, IPL, ICC, BBC ইত্যাদি।
অনুরূপভাবে বাংলাতেও হবে। যেমন: এসএসসি, এইচএসসি, এসএমএস, বিএ, বিকম, বিএসএস, বিএসসি, পিএইচডি, পিসি, আইসিসি, ইউএন, বিবিসি ইত্যাদি। এতে বাংলা বানানের পরিচ্ছন্নতা রক্ষা হয়।

এক্ষেত্রে ডট ব্যবহার করা ভুল নয়, তবে আমাদের দ্বারা ভুলের সৃষ্টি হতে পারে। যেমন: BSc, PhD লিখতে গিয়ে B.S.C., P.H.D. লেখা। BSc, PhD – তে যদি ডট ব্যবহার করতে চান, তাহলে এভাবে হবে B.Sc., Ph.D. শুধু মাঝে ডট দিলে চলবে না যেমন: B.Sc, Ph.D অর্থাৎ Sc. ও D. পরেও ডট হবে। সুতরাং ভুল এড়াতে ডট ব্যবহার না করাই শ্রেয়।

ইংরেজি শব্দের সংক্ষিপ্ত বর্ণ রূপ দ্বারা যদি শব্দ গঠন হয়, তাহলে এর মাঝে ডট ব্যবহার হবে না। যেমন: UNESCO, UNICEF.

 

২. বিসর্গের স্থলে কোলন : কেবলই ভুল

বিসর্গের পরিবর্তে কোলন কিংবা কোলনের পরিবর্তে বিসর্গ ব্যবহার করা যাবে না। কারণ কোলন একটি বিরামচিহ্ন এবং বিসর্গ একটি বর্ণ। ভুলবশত অনেকেই বিসর্গের স্থলে কোলন এবং কোলনের স্থলে বিসর্গ ব্যবহার করেন। যেমন: দু:খ > দুঃখ।

পূর্ণ শব্দে শেষে, গাণিতিক ক্ষেত্রে এবং ব্যাখ্যামূলক শব্দে কোলন ব্যবহার হয়। ঠিকানা লেখার ক্ষেত্রে বিসর্গের পরিবর্তে কোলন ব্যবহার করতে হবে। যেমন:
নামঃ > নাম:
পিতার নামঃ > পিতার নাম:
গ্রামঃ > গ্রাম:
পোস্টঃ > পোস্ট:
উপজেলাঃ > উপজেলা:
জেলাঃ > জেলা:

অনেকেই আন্তঃজাতিক না লিখে লেখেন আন্ত:জাতিক, বহিঃবিশ্বের স্থলে লেখেন বহি:বিশ্ব, প্রাতঃরাশ না লিখে লেখেন প্রাত:রাশ। বিসর্গের স্থলে কোলনের ব্যবহার পুরোপুরি ভুল। এমন ভুল পরিত্যাজ্য। যদিও এখন আর সংবাদপত্র ও সাহিত্যে বাংলা চর্চার ক্ষেত্রে আন্তঃজাতিক ও বহিঃবিশ্ব লেখা হয় না, লেখা হয় আন্তর্জাতিক ও বহির্বিশ্ব।

 

৩. শব্দের মাঝখানে বিসর্গের ব্যবহার ও বর্জন

প্রমিত নিয়মের অনুসরণে এখন আর সন্ধিজাত শব্দের মধ্যস্থলে স্ত, ম্প, ই, শ্ব, স্ৰ – এই যুক্তব্যঞ্জনগুলোর আগে বিসর্গ বসানো হয় না। ‘নিঃশ্বাস’ শব্দটি এখন ‘নিশ্বাস’ হয়ে গেছে এবং শব্দটির সগোত্রীয় নিশ্বাস-প্রশ্বাস, নিশ্বসন, নিশ্বসিত – এই শব্দগুলোও বিসর্গ-বর্জিত রূপ পরিগ্রহ।
দুস্থ, নিস্পন্দ, নিস্পৃহ, নিস্তব্দ, নিস্রাব, বক্ষস্থল, বয়স্থ, বহিস্থ, মনস্থ ইত্যাদি শব্দ বর্তমানে প্রমিত নিয়মের প্রভাবে বিসর্গবর্জিত রূপে প্রচলিত।
কিন্তু প্রমিত ‘অন্তস্থ’ (প্রান্তস্থিত) শব্দের পাশাপাশি ‘অন্তঃস্থ’ (মধ্যস্থিত) শব্দটি ভিন্ন অর্থের কারণে টিকিয়ে রাখা হয়েছে।

সমাসবদ্ধ পদে ‘শ’ ‘ষ’ ‘স’ পরে থাকলে বিসর্গ স্বরূপে স্বস্থানে অবস্থান করে। যেমন : নিঃশব্দ, বয়ঃসন্ধি, অন্তঃশীলা, দুঃসাহস। এক্ষেত্রেও বিসর্গ-পরবর্তী ব্যঞ্জনের ধ্বনি দ্বিত হয়। যেমন : নিঃশব্দ > নিশ্শব্দো।

 

৪. শব্দের শেষে প্রয়োজন নেই বিসর্গের

আগে সংস্কৃত হতে আগত অনেক শব্দের শেষে বিসর্গ যুক্ত করা হতো। কিন্তু বর্তমানে প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম অনুসারে এসব শব্দের শেষে বিসর্গ উঠে গেছে। যেমন :
অংশতঃ>অংশত অন্ততঃ> অন্তত
অহরহঃ>অহরহ আইনতঃ> আইনত
ইতস্ততঃ>ইতস্তত কার্যতঃ>কার্যত
ক্রমশঃ>ক্রমশ দৃশ্যতঃ>দৃশ্যত
ন্যায়তঃ>ন্যায়ত পুনঃপনঃ > পুনঃপুন
প্রথমতঃ প্রথমত প্রসঙ্গতঃ>প্রসঙ্গত
প্রায়শঃ>প্রায়শ বশতঃ>বশত
বস্তুতঃ>বস্তুত বাহ্যতঃ>বাহ্যত
বিশেষতঃ> বিশেষত মুখ্যতঃ>মুখ্যত
মূলতঃ>মূলত শেষতঃ>শেষত
সাধারণতঃ> সাধারণত স্বভাবতঃ>স্বভাবত

এ প্রসঙ্গে বাংলা ভাষার ধ্বনিবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক মুহম্মদ আবদুল হাই (১৯১৯-৬৯) তার ‘বাঙলা লিপি ও বানান সমস্যা’ প্রবন্ধে শব্দের শেষে বিসর্গের ব্যবহার প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘এর যথাযথ উচ্চারণ বাঙলায় নেই। ক্রমশঃ, আপাততঃ, প্রধানতঃ, সাধারণতঃ প্রভৃতি শব্দে এ-কালে বিসর্গ উচ্চারিত হয় না তা-ই নয়, বানানেও দেখানো হয় না।’

 

৫. বিসর্গ বর্ণের প্রকৃতি ও উচ্চারণ

আনন্দ, বেদনা, বিস্ময় ইত্যাদি প্রকাশের জন্য মাঝে মাঝে বিসর্গ ব্যবহার করা হয়। তবে প্রমিত বানানে বিসর্গের পরিবর্তে ‘হ্’ ব্যবহার অধিক লক্ষণীয়। যেমন:
আঃ!>আহ্!
উঃ!>উহ্!
ওঃ!>ওহ্!
ইঃ!>ইহ!
বাঃ>বাহ্

 

শেষ কথা:

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নামফলক, চিঠিপত্র, টেলিভিশন এমনকি অনেক প্রকাশিত বই এবং পত্রপত্রিকায় বিসর্গের অহরহ অপপ্রয়োগ দীর্ঘদিন দেখতে দেখতে; এখন নতুন প্রজন্মসহ আমরা অনেকেই মনে করি এটা-ই ঠিক। আমাদের অধিকাংশ মানুষের নামের সংক্ষিপ্তরূপ, আমাদের শিক্ষা সনদে লেখা হয়েছে ও হচ্ছে (ঃ) বিসর্গ দিয়ে। যেমন মোঃ, মোসাঃ, মিঃ, ইত্যাদি। আজীবন এই ভুল বয়ে বেড়াচ্ছি আমরা!

অথচ জন্মনিবন্ধন কর্তৃপক্ষ, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বোর্ড, জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান কর্তৃপক্ষ এবং সকল স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ সনদ লেখার সময় একটু সচেতন হলেই অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব এই প্রচলিত ভুল। শুদ্ধ সনদ দেখেই আমাদের সন্তানেরা শিখতে পারবে, শব্দ সংক্ষেপণ চিহ্নের সঠিক ব্যবহার এবং পরিহার করতে পারবে  বিসর্গের অপব্যবহার।

বাংলা একাডেমিসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন সকল প্রতিষ্ঠান এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াসমূহ ঐকমত্যে এসে, একই নিয়ম অনুসরণ অত্যাবশ্যক। এক্ষেত্রে শিক্ষকদেরও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে ।

[লেখাটি তৈরিতে বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান, বাংলা একাডেমি, ঢাকা; বাংলা বানানের প্রয়োগ অপপ্রয়োগ ও বানানপঞ্জি, আবুল কাইয়ুম, নন্দিতা প্রকাস, ঢাকা; জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে]

 

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

বিসর্গ বর্ণের ব্যবহার

Facebook Comments Box

প্রকৌশলী মো. আলতাব হোসেন, সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশ এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত অলাভজনক ও অরাজনৈতিক সংগঠন ‘আমাদের সুজানগর’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সাধারণ সম্পাদক। তিনি ‘আমাদের সুজানগর’ সাহিত্য সংকলনের সম্পাদক এবং ‘আমাদের সুজানগর’ ওয়েব ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও প্রকাশক। এছাড়া ‘অন্তরের কথা’ লাইভ অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক তিনি। সুজানগর উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, কৃতি ব্যক্তিবর্গ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে ভালোবাসেন। বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি স্বনামধন্য ওয়াশিং প্লান্টের রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেকশনে কর্মরত আছেন। তিনি ১৯৯২ সালের ১৫ জুন, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালি ইউনিয়নের সাগতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!