বই-চোর-১ম-পর্ব
গল্প,  সাইফুর রহমান

বই চোর // ১ম পর্ব // ছোটোগল্প // সাইফুর রহমান

বই চোর // ১ম পর্ব 

সাইফুর রহমান

সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ যেখানে শেষ হয়েছে, তার থেকে ঈষৎ আগে শ্যাওড়া গাছসদৃশ একটি পাকুড় বৃক্ষের সন্ধান পাওয়া যায়। বনসাই আকৃতির এই গাছটি সেখানে দাঁড়িয়ে আছে সম্ভবত বেশ কিছুকাল ধরে। পাকুড়গাছের ছায়ার নিচে সস্তা টিন দিয়ে ছাওয়া ঘুপচির মতো যে চায়ের দোকানটি আছে, সেখানেই দুপুর ১২টা নাগাদ অপেক্ষা করার কথা ছিল সুনীলের।
দুপুরের দিকে চায়ের দোকানটি অপেক্ষাকৃত নির্জন থাকে। ডিমের কুসুমের মতো সূর্যটা পশ্চিমে হেলে পড়লে পাকুড়গাছটির সুশীতল ছায়া পড়ে চায়ের চালাঘরে। তখন সেখানে মানুষের জমায়েত হয়। কোলাহল বাড়ে।
চায়ের এই দোকানটি অবশ্য এ অঞ্চলটিতে মোহনমিয়ার চায়ের দোকান নামে পরিচিত। সুনীল ১২টার আগেই সেখানে এসে উপস্থিত হলেও এখন পর্যন্ত দেখা নেই ইন্দ্রনাথের। ইন্দ্রনাথ সুনীলের দীর্ঘদিনের ইয়ার। বই সংগ্রহবিষয়ক কিছু শলাপরামর্শের জন্য ইন্দ্রনাথই সুনীলকে বারবার অনুরোধ করেছে অপেক্ষা করতে এখানে।
সময় পেরিয়ে গেছে ১২টা অতিক্রম করে আরও ঘণ্টাখানেক। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে ভাদ্রের অকাল বর্ষণ। চারদিক ভেসে যাচ্ছে বৃষ্টির পানিতে।
সকাল থেকে পেটে দানাপানি পড়েনি কিছুই। এরই মধ্যে অবশ্য চা খাওয়া হয়ে গেছে বেশ কয়েক প্রস্থ।

আরও পড়ুন গল্প  কাঠগোলাপ ও প্রেম

বৃষ্টির জন্যই হয়তো কোথাও আটকা পড়েছে ইন্দ্রনাথ; মনে মনে ভাবে সুনীল। দোকানে সাজিয়ে রাখা কাচের বয়ামগুলোর একটি খুলে লাঠি বিস্কুট নিয়ে চিবোতে চিবোতে প্রবল বরষণের আবছা কুয়াশা ভেদ করে দৃষ্টি সম্প্রসারিত হতেই দেখা গেল, রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে ইন্দ্রনাথ। বাঁ হাতটি উঁচু করে সজোরে চেঁচিয়ে উঠল সুনীল,
— ইন্দ্রনাথ, এই যে আমি এখানে।
— বাহ, বেশ! তুই তো দেখছি এখানে বসে আরামে চা-বিস্কুট খাচ্ছিস। আর আমি একেবারে কাকভেজা হয়ে গেলাম।
— কী করব বল, তুই আসতে দেরি করছিস। এদিকে বেদম বৃষ্টি। সকাল থেকে পেটে কিছুই পড়েনি।
ইন্দ্রনাথ সবিস্ময়ে সুনীলের দিকে তাকিয়ে বলল,
— তোর হাতে চটের এই থলে দুটি কীসের রে, সুনীল?
সুনীলের কণ্ঠে ইতস্ততার সুর,
— এই আর কী, এগুলোর মধ্যে চাল।
— চাল?
— হ্যাঁ, রেশনশপ থেকে তুললাম। সের পাঁচেক পেয়েছি। এর মধ্য থেকে সেরখানেক সরিয়ে আলাদা করে রাখলাম ছোটো এই থলের ভেতর। এগুলো বিক্রি করে বই কিনব। আমি তো আর তোর মতো ধনীর দুলাল নই যে হাজার টাকা খরচ করে বই কিনতে পারি। প্রতি সপ্তাহে সেরখানেক করে চাল আমি এভাবে সরিয়ে রাখি। তারপর পাঁচ-দশ সের জমিয়ে সেগুলো বিক্রি করে বই কিনি।
ইন্দ্র বিস্ফোরিত নেত্রে তাকায় সুনীলের দিকে।
বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না আজ।

আরও পড়ুন গল্প একজন অনন্যা

সুনীল ইন্দ্রনাথকে বলল,
— আপাতত এখানে বসেই চা-বিস্কুট কিছু খেয়ে নে ইন্দ্র। বৃষ্টিটা একটু ধরে আসুক, তারপর না হয় যাওয়া যাবে অন্য কোথাও।
ইন্দ্র এক ভাঁড় চায়ের ফরমাশ করে প্যান্টের পকেট থেকে বের করল গোল্ডফ্লাগ সিগারেটের সুদৃশ্য একটি টিনের কৌটা। সেখান থেকে সিগারেট বের করে তাতে আগুন ধরিয়ে মুখ থেকে কুণ্ডলীর মতো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল,
— আচ্ছা সুনীল, তোর এই কবিতা লেখা কিংবা ধর এই বই সংগ্রহের বাতিকগুলো কীভাবে পেলি?
— সে অনেককাল আগের কথা ইন্দ্র। আমরা তখন থাকতাম বাংলাদেশের মাদারীপুরে। আমাদের গ্রামের পাঠশালায় আমার সঙ্গে পড়ত ইয়াকুব নামে একটি ছেলে। ও রোজ এমন মজার মজার অদ্ভুত সব গল্প আমাদের শোনাত যে, আমি অবাক বিস্ময়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম সেসব গল্প। যদিও আমি বেশ ভালো করেই জানতাম, এ সবই হলো ইয়াকুবের কল্পনাশক্তির চমত্কার প্রসব। আজ আমার বলতে দ্বিধা নেই, ইয়াকুবই ছিল আমার জীবনে প্রথম ব্যক্তি, যে আমার কল্পনাশক্তিকে উসকে দিয়েছিল। আমার লেখকসত্তাকে জাগিয়ে তুলেছিল। আমাদের পরিবারে আমার মায়ের ছিল বই পড়ার মারাত্মক নেশা। মায়ের সেই নেশা মেটাতে আমাকে রোজ দুটি করে বই তুলতে হতো উত্তর কলকাতার বয়েজ ওন লাইব্রেরি থেকে।

দেখা যাচ্ছে, মা হয়তো বসেছে একটি বই নিয়ে, লুকিয়ে-চুরিয়ে অন্যটি পড়তাম আমি। আর এভাবেই ধীরে ধীরে একজন পাক্কা পড়ুয়া হয়ে উঠলাম আমি। যদিও বর্তমানে একটু-আধটু কবিতা-টবিতা লিখে বন্ধুমহলে নাম করেছি বটে, কিন্তু কেউ হয়তো কোনো দিন জানতেও পারবে না আমার লেখকসত্তার চেয়ে পাঠকসত্তা এখনো আমার কাছে বেশি প্রিয়। ইন্দ্র তুই শুনে অবাক হবি, আমি আমার সমসাময়িক সব বন্ধু-সুহৃদের সঙ্গে আলাপ করে জেনেছি, একমাত্র মানবেন্দ্র ছাড়া আমার চেয়ে বেশি বই আর কেউ পড়েনি। সে হোক শক্তি, সন্দিপন কিংবা শীর্ষেন্দু।

আরও পড়ুন গল্প জারজ

ইন্দ্রনাথ বলল,
— তাই নাকি! বেশ ভালো বলেছিস তো। সবই তো বুঝলাম, তা তুই বই সংগ্রহের এই ঘোড়ারোগটি কীভাবে পেলি?
সুনীল স্মিত হেসে বলল,
— তুই একটা আস্ত মূর্খ। যে ছেলেটি বই পড়তে ভালোবাসে, সে যে বই সংগ্রহ করতেও ভালোবাসবে—সেটাই স্বাভাবিক নয় কি? শোন, তোকে তাহলে বলি—ছোটবেলায় আমি একটির বেশি দুটি জামা পর্যন্ত কিনতাম না। বরং বাবাকে বলতাম, জামা-জুতার পরিবর্তে বই কিনে দাও আমাকে। কথাগুলো রূপকথার মতো মনে হলেও এটাই সত্যি ইন্দ্র। আমাদের বাড়িতে বইয়ের কোনো সংগ্রহ ছিল না। আমার বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। বইয়ের সংগ্রহ গড়ে ওঠে কয়েক পুরুষে। আমরা তখন কলকাতায় বাংলাদেশ থেকে আসা রিফিউজি। কিন্তু মাদারীপুরে আমার মামাদের বাড়িতে বইয়ের সংগ্রহ ছিল বেশ ভালো। সেই সংগ্রহ থেকে প্রচুর বই আমি চুরি করে এনেছিলাম অকৃপণ হস্তে। জানিস তো ইন্দ্র, একটি প্রবাদ আছে—‘ধনবানে কেনে বই বুদ্ধিমানে পড়ে।’ তবে তোকে আজ একটি সত্যি কথা বলি, আমি জীবনে সবচেয়ে বেশি বই চুরি করেছি আমার এক মাড়োয়ারি বন্ধুর সংগ্রহশালা থেকে।
ইন্দ্র এবার সুনীলের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
— তুই আবার আমার লাইব্রেরি থেকে কোনো বই এদিক-সেদিক করিসনি তো? তোর বাড়ি গিয়ে ভালো করে সার্চ-টার্চ করতে হবে একবার।
ঝংকার দিয়ে উঠল সুনীল,
— আরে থাম থাম, চোরের মায়ের বড়ো গলা। তুই তো শালা একটা বড়ো চোর। ধনী আর বিখ্যাত সব লোকের সংগ্রহশালায় হানা দিয়ে বেড়াস। আর আমি তো এখন হয়েছি চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা। বই চুরির অভ্যাসটা আমি তোর সঙ্গে দেখা হওয়ার অনেক দিন আগেই ছেড়ে দিয়েছি। ইনফ্যাক্ট আমার কবিতা ও গল্পটল্পগুলো যখন থেকে কাগজে ছাপা হতে শুরু হয়েছে, তখনই ছেড়ে দিয়েছি। আমাকে বারবার না থামিয়ে গল্পটা আগে শোন না, ইন্দ্র।

আরও পড়ুন গল্প সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা

ইন্দ্রনাথ বলল,
— আমার কাছেও দুর্দান্ত একটি খবর আছে, যা শুনলে তুইও অভিভূত হয়ে যাবি। আগে তোর গল্প শেষ হোক, তারপর আমারটা বলছি।
— সেই যে আমার মাড়োয়ারি সহপাঠীর কথা বলছিলাম। আমি আর আমার সেই বন্ধু—আমরা একসঙ্গে একই স্কুলে পড়তাম। ওর নাম কমল ভাণ্ডারিয়া। আমার সেই বন্ধুর বাবা ছিলেন চামড়া ব্যবসায়ী। প্রচুর কাঁচা পয়সার মালিক। কমল বাংলা বলত ভাঙা ভাঙা, কিন্তু প্রায়ই ও স্কুলে নতুন নতুন সব বই নিয়ে আসত। তুই তো জানিস, লাইব্রেরিগুলোতে যেসব বই পাওয়া যায়, সেগুলোর বেশির ভাগই পুরনো। যেমন ধর—নীহারঞ্জন গুপ্ত, শশধর দত্তের মোহন সিরিজ, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, প্রভাবতী দেবী সরস্বতী, মনীন্দ্রলাল বসু, পাঁচকড়ি দে—এগুলো আর কী। কিন্তু কমল ক্লাসে নিয়ে আসত সদ্য প্রকাশিত আনকোরা সব বই। যেমন একদিন নিয়ে এলো শিবশঙ্কর মিত্রের ‘সুন্দরবনের আর্জান সর্দার’। নামের মধ্যেই আমি যেন খুঁজে পেলাম বইটি পড়ার দুর্দমনীয় এক আকর্ষণ। কমলকে কত করে বললাম—বইটি আমাকে কয়েক দিনের জন্য একটু ধার দে, পড়া শেষ হলেই ফিরিয়ে দেব। কমল ভাণ্ডারিয়া ছিল মহা কৃপণ। ও আমাকে ফিরিয়ে দিল।

তো হয়েছে কী—একদিন বিকেলে স্কুল শেষে কমলই আমাকে এক রকম জোর করে নিয়ে গেল ওর বাড়িতে। ফেরার সময় কৌশলে অপহরণ করলাম সুন্দরবনের আর্জান সর্দারকে। আরেক দিনের কথা, পরীক্ষা শুরু হওয়ার কয়েক দিন আগে হবে বোধ হয়। কমল ক্লাসে নিয়ে এলো হেমেন্দ্র কুমার রায়ের ‘যখের ধন’। কমল সেই বইটিও সত্যি সত্যি যখের ধনের মতো আগলে রইল। হাজার অনুনয় করেও কোনো লাভ হলো না। কেন জানি না সেই বইটি পড়ার জন্য প্রাণটি আমার ছটফট করতে লাগল মরুভূমির তৃষ্ণার্ত বালুকণার মতো। ভেতরে ভেতরে মুখিয়ে রইলাম কীভাবে পড়া যায় বইটি। পরীক্ষা শেষ করেই গ্রীষ্মের ছুটিতে বেড়াতে গেছি মামাবাড়ি। সেখানে মামাদের সংগ্রহশালায় পেয়ে গেলাম সেই যখের ধন বইটি। আজ অকপটে স্বীকার করছি, আমি সাত রাজার ধনভাণ্ডারের সন্ধান পেলেও বোধ হয় এতটা খুশি হতাম না, যতটা খুশি আমি হয়েছিলাম সেই যখের ধন বইটি আবিষ্কার করে। মামাদের যখের ধন চলে এলো আমার ঘরে।

আরও পড়ুন গল্প পরাভূত

একটি-দুটি বইতে কি আর আমার মতো গ্রন্থভুকের খিদে মেটে? অথচ নিয়মিত বই কেনার সাধ্য ছিল না আমার। তাই ছলে-বলে-কৌশলে এমনকি চৌর্যবৃত্তি অবলম্বন করেও বই জোগাড় করতাম আমি। পকেটে পয়সা নেই অথচ জীবনানন্দ দাশের নতুন কবিতার বই বেরিয়েছে। সে যে কী দুঃখের দিন, সেটা তোকে আমি বোধ হয় কিছুতেই বোঝাতে পারব না ইন্দ্র। মনের মধ্যে পর্বততুল্য কষ্ট নিয়ে ফেউ ফেউ করে ঘুরে বেড়িয়েছি কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায়। অনেক সময় হুটহাট ঢুকে পড়েছি কোনো বইয়ের দোকানে। সদ্য প্রকাশিত বইখানি একটু নেড়েচেড়ে গন্ধ শুঁকে মনের আশ মিটিয়েছি।
এ পর্যন্ত বলে থামল সুনীল।

আরও পড়ুন বই চোর-
শেষ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও  ইউটিউব চ্যানেলে

বই চোর // ১ম পর্ব

Facebook Comments Box

সাইফুর রহমান মূলত একজন গল্পকার। মানবজীবনের বৈপরীত্য ও মনস্তাত্ত্বিক বহুমুখিতা তাঁর লেখার প্রধান উপজীব্য। প্রকাশিত নিবন্ধনগ্রন্থ: জানা বিষয় অজানা কথা, যুক্তি তর্ক ও গল্প, ভিঞ্চির কালো জুতো, করোনায় শেক্সপিয়র রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য; গল্পগ্রন্থ: শরৎচন্দ্রের শরৎ উপাখ্যান ও অন্যান্য গল্প, পক্ষিরাজের ডানা, মরিচপোড়া। তিনি ১৯৭৭ সালের ১২ ডিসেম্বর, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত দুলাই ইউনিয়নের চরদুলাই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!