বই-চোর-শেষ-পর্ব
গল্প,  সাইফুর রহমান

বই চোর // শেষ পর্ব // ছোটোগল্প // সাইফুর রহমান

বই চোর // শেষ পর্ব

সাইফুর রহমান 

ইন্দ্রের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,
— একটা সিগারেট দে। অনেকক্ষণ হলো সিগারেট ফুঁকা হয়নি। নিকোটিনের প্রচণ্ড অভাব বোধ করছে শরীর।
সিগারেটের কৌটাটি এগিয়ে দিতে দিতে ইন্দ্রনাথ সুনীলকে উদ্দেশ করে বলল,
— বেশ জম্পেস ধরনের একটি বই সংগ্রহশালার সন্ধান পেয়েছি জানিস।
সুনীল সিগারেট জ্বালানো বন্ধ রেখে কৌতূহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
— বলিস কী, কোথায়?
— মুর্শিদাবাদের আজিমগঞ্জে। পরিত্যক্ত বনেদি জমিদারের এক প্রাসাদে। বাড়িটি নিয়ে অবশ্য ওয়ারিশদের মধ্যে মামলা-মোকদ্দমা চলছে দীর্ঘকাল ধরে। কিন্তু সেই বাড়ির পাহারাদারের সঙ্গে আলাপ হয়েছে আমার। দারোয়ানটির নাম লজপত সিং। জাতিতে রাজপুত। ওর পূর্বপুরুষ অনেককাল আগে চলে এসেছে বাংলায়। আমি কয়েক দিন আগে সেখানে গিয়ে নিজ চোখে দেখে এসেছি বইয়ের সেই সংগ্রহ। দেখলাম, দুর্লভ সব বইয়ের সমাহার সেখানে। খাস ফারসি ভাষায় লেখা এক সেট শাহানামা দেখলাম, মরোক্ক চামড়ায় বাঁধানো। হাফিজ, আর্যভট্ট, ইবনে খালদুন, কৌটিল্য—চমত্কার সব কালেকশনস। কিন্তু সমস্যা হলো, সব বই-ই কাচের আলমারিতে সাজানো। চাবি অবশ্য লজপত সিংয়ের কাছে থাকে না। সেই চাবি থাকে প্রাসাদের আরক্ষক, দুর্গাধিপতি ইরফান আলীর কাছে। ইরফান আলী জমিদারদের বহু পুরনো খিদমতগার। আমি অবশ্য বেশ টাকা-পয়সার লোভ দেখিয়ে এসেছি সিং ব্যাটাকে। বলেছি সিং মিয়া তোমার ওই ইরফান আলীকে যে করেই হোক রাজি করাও। হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ করতে প্রস্তুত আমি এই ইন্দ্রনাথ চক্রবর্তী; কিন্তু মনে রেখো, চাবি আমার চাই।

আরও পড়ুন গল্প প্রতীক্ষিত বৃষ্টি

এত সব দুর্লভ বইয়ের লোভ সামলানো সত্যিই বেশ কঠিন। ইন্দ্রনাথের এমন লোভনীয় প্রস্তাবে সুনীল রাজি হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। তারা দুজন যখন মুর্শিদাবাদের আজিমগঞ্জে গিয়ে পৌঁছল, তখন বেলা দ্বিপ্রহর। বিশাল প্রাসাদটির এখন প্রায় ভগ্নদশা। একসময়ের সাদা ধবধবে সৌধটি এখন পাউরুটি রং ধারণ করেছে। বাড়িটির কতক স্থানে শ্বেতরোগীর মতো ছোপছোপ দাগ। নির্বাক গাছগুলোও যেন কিভাবে টের পেয়ে গেছে, এই আবাসটি দীর্ঘদিন আবাসশূন্য। আর সে কারণেই দেয়ালের কিছু কিছু স্থানে জায়গা করে নিয়েছে ছোটো ছোটো বৃক্ষ ও গুল্মলতা। প্রাসাদটির সামনে বিস্তীর্ণ জায়গাজুড়ে সবুজ ঘাসের গালিচা পাতা। সেখানেই কোনো একটি কাজে ব্যস্ত ছিল লজপত সিং।
ইন্দ্রনাথ সিংহদ্বারের বাইরে দাঁড়িয়ে গলা ছেড়ে হাঁক দিল,
— এই যে লটপট সিং, আসো একটু এদিকে।
লজপত সিং লোহার মোটা মোটা গরাদযুক্ত তোরণটি খুলতে খুলতে বলল,
— সাহেব হামার নাম তো লটপট সিং নাহি, লজপত সিং।
ইন্দ্রনাথ নির্বিকার কণ্ঠে বলল,
— আরে ওই হলো… একই কথা। লটপট সিংও যা, লজপত সিংও তা।
সিং লোকটা বিশালদেহী। সামনের বপুটি অনেকখানি ফুলে উঠেছে ওপরে। বিপুল দেহের জন্যই হয়তো হাঁটার সময় হেলেদুলে হাঁটে। লজপত সিং কাছে এসে চুক চুক করতে লাগল,
— নেহি সাহেব, আপনাদের জন্য কুচ করতে পারলাম না। ইরফান আলীকে কত করে বোঝালাম—তোমার বয়স হয়েছে, খানাপিনার পয়সা নাই। শরীরে নানা অসুখ বেঁধেছে। টাকা নিয়ে আলমারির চাবিগুলো হামাকে দাও। বইগুলো পড়ে মানুষ জ্ঞানী হবে। কিন্তু ইরফান আলীর সাফ কথা। নিমকহারামি কিছুতেই করতে পারব না আমি। সাহেব, তোমাদের জন্য আমি কিছু মূল্যবান জিনিস রেখেছি, দেখো তোমাদের নজরে লাগে কি-না।

আরও পড়ুন গল্প তিল তাল

এ কথা বলেই লজপত সিং ভেতরে চলে গেল। ফিরে এলো কিছুক্ষণ পর, হাতে সুদৃশ্য সব তৈজসপত্র। হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি কিছু জিনিস। পুরনো একটি কাঠের দেয়ালঘড়ি, ব্রোঞ্জের লণ্ঠন—এসব। সুনীল ও ইন্দ্রনাথের বোঝার বাকি রইল না যে লজপত সিং আসলে বড়ো তস্কর দলের সদস্য। ওর কাজই হচ্ছে জমিদারদের পরিত্যক্ত প্রাসাদগুলো থেকে মূল্যবান সব সামগ্রী চুরি করে বিক্রি করা।
ইন্দ্রনাথ অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বলল,
— আমরা কি এত কায়ক্লেশ সহ্য করে এখানে এসেছি, এসব ফালতু জিনিস কিনতে? লজপত, তুমি কেন বুঝতে চাইছ না যে আমরা চাই বই। আলমারির চাবি।
লজপত সিং কাঁচুমাচু হয়ে বলল,
— কিন্তু হাম কী করব বলুন সাহেব। ইরফান আলী বলেছে, কিছুতেই সে চাবি দিবে নাহি।
ইন্দ্র বলল,
— ঠিক আছে, কোনো অসুবিধা নেই; আমাদের নিয়ে চলো ইরফান আলীর কাছে। আমরাই তাকে বোঝাব। বইগুলো অন্য কাউকে পড়ার সুযোগ করে দিলে তার এমন কোনো নিমকহারামি হবে না।
লজপত সিং বলল,
— ঠিক আছে সাহেব, চলুন। আপনাদের নিয়ে যাচ্ছি ইরফান আলীর মাকানে।
ইরফান আলীর বাড়িটি জমিদারের প্রাসাদ থেকে খুব বেশি দূরে নয়। ইরফান আলীর ঘরটিতে মাটির দেয়াল। ওপরে অবশ্য টালির ছাউনি। মনিবের রাজপ্রাসাদটির মতো ইরফান আলীর ঘরটিও হেলে পড়েছে একপাশে। ঘরের দেউড়িতে দাঁড়িয়ে লজপত সিং বেশ কয়েকবার হাঁক দিল—ইরফান আলী বলে। ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। দোরটি উন্মুক্ত বলে লজপত সিং ভেতরে ঢুকেই নাকে রুমাল চেপে বিদ্যুত্গতিতে বেরিয়ে এলো বাইরে। ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে সুনীল ও ইন্দ্রনাথ দুজনই ভেতরে ঢুকে দেখল—বমি করে চারদিক ভাসিয়ে দিয়েছে ইরফান আলী। দুর্গন্ধে সেখানে টেকাই মুশকিল।

আরও পড়ুন পরাজিত নাবিক

সুনীল বলল,
— ইন্দ্র, চল ভাগি এখান থেকে তাড়াতাড়ি।
কিন্তু ইন্দ্রনাথ সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নয়। ইরফান আলীকে সে ডেকে তুলল। ইরফান আলী চোখ খুলে সুনীল ও ইন্দ্রকে দেখে উঠে বসার চেষ্টা করল একবার। কিন্তু সুনীলই বাধা দিল তাকে,
— না না, থাক উঠতে হবে না আপনাকে।
অর্ধনিমীলিত নেত্রে ইরফান আলী বলল,
— আমি জানি আপনারা কেন এসেছেন। কিন্তু আপনারা যা চান সেটা আমি দিতে পারব না, ক্ষমা করবেন আমাকে।
সুনীল বলল,
— কেন পারবেন না আলী সাহেব?
ইরফান আলী সুনীলের দিকে তাকিয়ে বলল,
— আপনার নাম কী জনাব?
সুনীল অস্ফুট গলায় বলল,
— আমার নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর ও আমার বন্ধু ইন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।
জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে ইরফান আলী বলল,
— আমি আপনাকে চিনি। আপনার অনেক লেখা আমি পড়েছি দেশ পত্রিকায়। আপনার লেখার হাত ভালো। সে যাহোক, আমি আজীবন আমার মনিবের নুন খেয়েছি। এই শেষ বয়সে এসে বেইমানি করতে পারব না আমি। জীবনে নিমকহারামি করিনি কখনো। আমি ভীষণ অসুস্থ। দুকুলে আমার কেউ নেই। স্ত্রী মারা গেছে বছয় দুয়েক আগে। পুত্র-কন্যারা সব দূরে। যে মেয়েটি এখানে কাজ করে, বেতন ঠিকমতো দিতে পারি না বলে কখনো সে আসে কখনো আসে না। এই মুহূর্তে আমার টাকার ভীষণ প্রয়োজন। এ রকম পরিস্থিতিতে ঈমানে সাধারণত ফাটল ধরে। আমার যদি সে রকম কোনো ভীমরতি হয় সেই ভয়ে গতকালই লোক দিয়ে আলমারির চাবি আমি পাঠিয়ে দিয়েছি আমার মনিবের কাছে। এই সম্পত্তি মামলা-মোকদ্দমা শেষে যে পায় পাবে। কিন্তু আমি আমার যে মালিককে চিনি, তিনিই আমার প্রকৃত মনিব।

আরও পড়ুন গল্প বড়ো বাবা

এসব বলতে বলতে ইরফান আলী আবার বমি করতে শুরু করল। ইরফান আলী সম্ভবত আক্রান্ত হয়েছে কলেরায়। ইন্দ্রনাথ বলল,
— সুনীল শোন, বইয়ের মধ্যে আমরা কী পড়ি? বিখ্যাত সব লোকদের কথা কিংবা তাঁদের কীর্তিময় জীবন, তাই তো, না-কি? ইরফান আলীর মতো কীর্তিমান ঈমানদার কি আর দু’একটা দেখা যায়। যায় না, তাই না? আপাতত বইয়ের পেছনে হাজার টাকা খরচ না করে এই টাকা আমি খরচ করব ইরফান আলীর চিকিৎসায়। মহানুভব এই লোকটিকে কিছুতেই মরতে দেওয়া যাবে না এই মুহূর্তে। চল, ওকে ধরে ওপরে তুলি। এখনই এঁকে নিয়ে যেতে হবে হাসপাতালে। সুনীল অপলক চেয়ে থাকে সদ্য আবিষ্কৃত তার এই বন্ধুটির দিকে।

আরও পড়ুন বই চোর-
১ম পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও  ইউটিউব চ্যানেলে

বই চোর // শেষ পর্ব

Facebook Comments Box

সাইফুর রহমান মূলত একজন গল্পকার। মানবজীবনের বৈপরীত্য ও মনস্তাত্ত্বিক বহুমুখিতা তাঁর লেখার প্রধান উপজীব্য। প্রকাশিত নিবন্ধনগ্রন্থ: জানা বিষয় অজানা কথা, যুক্তি তর্ক ও গল্প, ভিঞ্চির কালো জুতো, করোনায় শেক্সপিয়র রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য; গল্পগ্রন্থ: শরৎচন্দ্রের শরৎ উপাখ্যান ও অন্যান্য গল্প, পক্ষিরাজের ডানা, মরিচপোড়া। তিনি ১৯৭৭ সালের ১২ ডিসেম্বর, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত দুলাই ইউনিয়নের চরদুলাই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!