বই ও বইমেলা
বই ও বইমেলা
খ ম আব্দুল আউয়াল
শৈশবে মায়ের কোল নিরাপদ আশ্রয়। এমন তুলনীয় আশ্রয় মানুষের জীবনে আর কি হতে পারে; আমার তো মনে হয় বই। বইয়ের মতো এমন সাথী মানুষের জীবনে আর কিছুই হতে পারে না। সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায়, জীবনে চলার পথে সব সময়ে এমন নীরব অন্তরঙ্গ হিতৈষী বন্ধু দ্বিতীয়টি নেই। বই এমন সঙ্গী যে কখনও প্রতারণা করে না। মতের মিল না হলেও জবরদস্তি করে না। সঙ্গ তো দেয়ই, উপরন্তু এমন আরও কিছু দেয়; এ সংসারে আর কেউই দিতে পারে না। এই দুনিয়ার সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় হলো বই। বইয়ের জগতে একবার ঢুকতে পারলে মনে হবে পরপারের সাথীও যেন বই-ই হয়।
বইপড়া যদি সখ হয় তাহলে শুধু বইখানা চোখের সামনে মেলে ধরেই যেকোনো পাঠক, যেকোনো পরিবেশে বইয়ের ভূবনে আত্মমগ্ন হয়ে ডুব দিতে পারে। ট্রেনে, বাসে, ডাক্তারের জন্য অপক্ষায়, এমন কি বাথরুমে পর্যন্ত বই পড়া চলে। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায় বইপড়তে স্থান-কাল-পাত্র লাগে না। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় সৈয়দ মুজতবা আলীর সেই বিখ্যাত উক্তিটি “রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বই অনন্ত যৌবনা।” রাজনৈতিক নেতাদের অন্তরঙ্গ পাঠাভ্যাসের সময়টি হচ্ছে কারাগারে বন্দি থাকাকালে। বই শোকবিহ্বল চিত্তেও পড়া যায়, আনন্দ চিত্তেও পড়া যায়। শুধু বই পড়ার আগ্রহটা একবার মানুষের মনে ঢুকে গেলেই হলো।
আমাদের দেশেও বইপত্র পড়ার অভ্যাসটি বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু বই প্রেমিকের সংখ্যা এখনও তেমন বাড়েনি। আরও অনেক উপায়ের মধ্যে বইমেলা জনসাধারণের মধ্যে পাঠক হওয়ার, বই প্রেমিক হওয়ার আগ্রহ তৈরি করে। এজন্য বইমেলা কোনো লক্ষ্য-উপলক্ষ্য ছাড়াও আয়োজন করা যেতে পারে। বইমেলা পাঠক সাধারণকে বইয়ের জগতে ঢুকবার প্রবেশাধিকার দেয়। নিরক্ষর জনসাধারণের মধ্যেও বইমেলা ভূমিকা রাখে। বইমেলা নিরক্ষরকেও স্বাক্ষর করে তোলে এবং স্বাক্ষরতাকে ধরে রাখে। শুধু তাই নয় পাঠক সৃষ্টির সাথে সাথে লেখক সৃষ্টিতেও বইমেলার অবদান বিপুল। বইমেলার মাধ্যমেই একটি সুস্থ পাঠক সমাজই গড়ে ওঠে, সমাজ হয়ে ওঠে সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ।
সক্রেটিস বলেছিলেন “There is only one good, knowledge and one evil, ignorance”, কথাটি শ্বাশ্বত। এই ক্লাসিক বা শ্বাশ্বত বা চিরায়ত জ্ঞানই মানুষকে, মানুষের মানবতাকে ‘দ্ব্যর্থহীন নৈতিক সত্যের নিশ্চিত সন্ধান দেয়’। কিন্তু মানুষ একে অনুসন্ধান করেই লাভ করে থাকে, সহজে লাভ করার কোনো পথ নেই। বরঞ্চ আজকের যুগে, বর্তমানকালের মুদ্রণশিল্পের বিস্ফোরণের কালে ভালো বই বা যথোপযুক্ত জ্ঞান অর্জনের বই পাওয়া আরও দুস্তর এবং দুরধিগম্য হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আবুল কাসেম ফজলুল হকের ‘বইয়ের জগতে ভালো মন্দ’ প্রবন্ধটি বা মোহিতলাল মজুমদারের ‘পুথির প্রতাপ’ প্রবন্ধটি স্মর্তব্য। জ্ঞানের বিকাশে বইয়ের বাজারেও বাণিজ্য ও পুঁজি বাড়ানোর উপায় উদ্ভাবনে আজ শিক্ষার্থী ও জ্ঞানানুসন্ধানীরা পথ হারিয়ে দিশেহারা। এতে জ্ঞানের বিকাশ তো দূরের কথা, এমন এক অজ্ঞতার রাজত্ব বিস্তারে জ্ঞানকে করা হচ্ছে পণ্য। আর এর মাধ্যম হচ্ছে মুদ্রণশিল্প, বইপুস্তক, পত্রপত্রিকা এবং হাল আমলের কম্পিউটারের ব্যবহার। আজকের দিনে বাজার অর্থনীতি বইয়ের বাজারকেও মুনাফার নিক্তিতে পরিমাপ করে। ফলে বইপুস্তকও তাই যত বেশি সারগর্ভহীন, তত বেশি আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ এবং ঝকঝকে মুদ্রণ, পারিপাট্য উপস্থাপিত হতে দেখা যায়। এই গুরুতর অসুস্থতা থেকে বইয়ের জগতকে উদ্ধারের উপায় পাঠকদেরকেই বের করতে হবে।
লাইব্রেরির মধ্যে আমরা সহস্রপথের চৌমাথার উপর দাঁড়াইয়া আছি। কোনো পথ অনন্ত সমুদ্রে গিয়াছে, কোনো পথ অনন্ত শিখরে উঠিয়াছে, কোনো পথ মানব হৃদয়ের অতলস্পর্শে নামিয়াছে। যে দিকে ইচ্ছা ধাবমান হও, কোথাও বাধা পাইবে না। মানুষ আপনার পরিত্রাণকে এতটুকু জায়গায় বাঁধাইয়া রাখিয়াছে-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পাঠকেরাই সৃষ্টিশীল লেখকদের সবচেয়ে বড়ো পৃষ্ঠপোষক হতে পারেন। এ ব্যাপারে পাঠকেরা যদি সচেতন না হন, তাহলে সৃষ্টিশীল জ্ঞানের ধারা থমকে দাঁড়াতে বাধ্য। বইয়ের জগতের ভালোমন্দের মানদণ্ড সৃষ্টির জন্য পাঠকের পক্ষ থেকে কোনো না কোনো প্রকার সংঘটিত উদ্যোগ দরকার। কেবল পুঁজিপতিদের স্বার্থ সংরক্ষণে ও তাদের সহযোগীদের প্রচারের মধ্যে অবস্থান করলে পাঠকের পক্ষে ভুল পথে চলারই সম্ভাবনা থাকে। পাঠকের সচেতনতার বড়োই প্রয়োজন। কিন্তু পাঠককে হাতে ধরে পথ চিনিয়ে দেওয়াও যাবে না। কারণ পাঠকই তার আপন পঠনীয় বিষয়ের গভীরে ধীরে ধীরে অনুপ্রবেশ করে। এখানে স্বাধীনভাবে অনুসন্ধানের বা পথ খোঁজার এবং পথ চলার আনন্দেই সে পথ খুঁজে পায়। এই পথে চলতে গিয়েই বই ও বইমেলা পথের দু ধারে সত্যের ও অভীষ্ট লক্ষ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। ভালো বই পড়ার প্রভাব পাঠকচিত্তে সুদূর প্রসারী হয়।
এই পথ চলার আনন্দ এবং পথ খোঁজার স্পৃহা ও স্বাধীনতাকে হরণ করে নেয় বই ব্যবসায়ীদের পুঁজিবাদী স্বার্থ। জ্ঞানের রাজত্বে দেয়াল তুলে সাময়িকতার তুচ্ছতায় পাঠকের পথ রুদ্ধ করে দেয় বইয়ের ব্যবসায়ী স্বার্থ। চানক্য বলেছিলেন “রাজা স্বদেশে পূজিত হন, বিদ্বান পূজিত হন সর্বত্র”। জ্ঞানের রাজত্ব পৃথিবীব্যাপী এবং এর নাগরিক পাঠকসমাজ। সকল রাজনৈতিক, ভৌগলিক, ধর্মীয় ও জাতীয়তার উর্ধ্বে এর সার্বভৌমত্ব। এক্ষেত্রে বেড়া দেওয়ার অপচেষ্টা হচ্ছে জ্ঞানকে নিয়ে ব্যবসা ফেঁদে বসা। ক্লাসিক বা চিরায়ত সাহিত্য বিমুখতা সৃষ্টির জন্য ব্যবসায়িক পুঁজি কাজ করে। পাঠক যাতে জ্ঞানের গভীরতায় যেতে না পারে। জ্ঞানকে নিয়ে অজ্ঞতার এই উঁচু দেয়াল তোলা বাণিজ্যিকভাবে প্রযুক্তি পরিবর্তনের মাধ্যমে কম্পিউটারের ক্ষেত্রেও digital devide তৈরি করা হয়। এই প্রাচীর টপকে উদারমুক্ত জ্ঞানের আকাশে বিচরণ করতে হবে। এজন্য পাঠককেই অনুশীলন করতে হবে। এই অনুশীলন পাঠক সমাজকে সংগঠিতভাবে করতে হবে।
উনিশ শতকে বাংলার রেনেসাঁয় এই অনুশীলন সংগঠিত রূপ নিয়েছিল। তারই ফলশ্রুতিতে আমাদের সাহিত্যে ও জ্ঞানের অন্যান্য শাখায় বেশ কিছু ক্লাসিকের সৃষ্টি হয়েছিল। উনিশ শতকের সেই সব সংগঠিত আন্দোলনের কথা স্মরণ করলে প্রথমেই মনে পড়বে ‘ডিরোজিওর একাডেমিক এসোসিয়েশন’-এর কথা। তরুণ ছাত্রসমাজে এই এসোসিয়েশনের প্রভাব ছিল অপ্রতিরোধ্য। তারপর রামতনু লাহিড়ীর ‘জ্ঞানোপার্জিকা সভা’, রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুরের ‘তত্ত্ববোধনী সভা’ ইত্যাদি। শিক্ষা ও সংস্কৃতি নির্মাণে এই সমস্ত সংগঠনের ভূমিকা অপরিসীম।
আজকে আমাদের দেশে সাহিত্য-সংস্কৃতির সংগঠনের অভাব আছে তা কিন্তু নয়। কবিতা, নাটক, উপন্যাস এমন কি শুধুমাত্র আবৃত্তিরই পঞ্চাশের অধিক সংগঠন এই ঢাকাতে রয়েছে। কিন্তু এগুলোও সেই পুঁজিবাদী করপোরেট স্বার্থের হৈহুল্লোর ছাড়া বিশেষ আর কি। কারণ এরা কেউই সমাজ দেহে কোনো ছায়াপাত ঘটাতে সক্ষম হচ্ছে না। এজন্য সাংগঠনিক ক্রিয়াকাণ্ডগুলোও পর্যালোচনা করে একটু স্থিতধি হয়ে দেখা দরকার। ক্লাসিকের অনুশীলন সমসাময়িকতার উর্ধ্বে উঠে করা আবশ্যক। প্রকাশনার সংকট এবং গ্রন্থজগতের উন্নয়ন নিয়ে নানারকম চিন্তাভাবনা হওয়া আবশ্যক। সভা, সেমিনার, টকশো অবিরাম হচ্ছে তবে এগুলোর অধিকাংশের অন্তর্নিহিত সদিচ্ছার চেয়ে ব্যবসায়িক দিকটাই গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি এবং পাঠকসমাজ বিভ্রান্তই হচ্ছে।
এই বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি পেতে গেলেও ক্লাসিক বইয়ের আশ্রয় নিতে হবে। কারণ ক্লাসিকই সুন্দরের প্রতিষ্ঠা দিতে পারে। যদি ক্লাসিকের উপলব্ধি আমাদের দেশে বইয়ের জগতে পাঠকদের মধ্যে জাগে তাহলে একালের রচনাতেও উৎকর্ষ দেখা দেবে। জ্ঞানের বিস্ফোরণকেও মানুষের আত্মউন্নয়ন ও মনীষা সৃষ্টিতে ব্যপৃত করতে হবে এবং তা পাঠকের আত্মনিষ্ঠাতেই সম্ভব। ভালো বইই জীবন গঠনের সহায়ক। ভালো বই মানুষকে সৃষ্টধর্মী কাজে এগিয়ে নিয়ে অগ্রগামী সমাজের বাসিন্দা করে তোলে।
আরও পড়ুন খ ম আব্দুল আউয়ালের প্রবন্ধ-
গ্রন্থ ও গ্রন্থাগার
গ্রন্থাগার আইন
উচ্চশিক্ষা পরিকল্পনায় গ্রন্থাগার
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে
বই ও বইমেলা