প্রিয়তমার-লাল-চোখ-৩য়-পর্ব
গল্প,  মোহাম্মদ সেলিমুজ্জামান,  সাহিত্য

প্রিয়তমার লাল চোখ (৩য় পর্ব)

প্রিয়তমার লাল চোখ (৩য় পর্ব)

মোহাম্মদ সেলিমুজ্জামান

 

মিজান সাহেব বিকেল পাঁচটার দিকে কুড়িগ্রাম বাসস্ট্যান্ডে নামলো। নেমেই দেখে দুইটা আবাসিক হোটেল। একটার নাম সুফিয়া, অন্যটা অরবিন্দু। মিজান সাহেব হোটেল অরবিন্দুতে গিয়ে ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসা করলো,
— ভাই সিট হবে?
— হবে, সিঙ্গেল না ডাবল?
— সিঙ্গেল। ভাড়া কত?
— এসি না নন এসি?
— এসির ভাড়া কত? আর নন এসি কত করে?
— এসির ভাড়া আটশত আর নন এসি সিঙ্গেল ছয়শত টাকা।
এ তো অনেক ভাড়া। ঢাকার মতোই ভাড়া। এই মঙ্গা এলাকায় হোস্টেল ভাড়া এত! মিজান সাহেব হতাশ হয়ে গেল। যা টাকা আছে তা দিয়ে তো বেশি দিন চলা যাবে না।
— ভাই নন এসি দেন, আমি অর্ধেক দিবো। আমাকে একটা রুম দেন। আমি একটু ফ্রেশ হয়ে নেই। যদি থাকি তবে সন্ধ্যায় বলবো এবং ফুল পেমেন্ট করবো। আমার একটু অন্য জায়গায় যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
ম্যানেজার অনিচ্ছাকৃতভাবে হোস্টেল বয়কে ডেকে বললো,
— এই চাবি নিয়ে যা, ৭০২ নম্বর রুমটা খুলে দে।
মিজান সাহেব রুমে উঠে গোসল করে ফ্রেশ হলেন। তারপর পরিষ্কার কাপড় পরে নিচে বের হলেন। চিন্তা করলেন সন্ধ্যার আগেই কম দামের হোস্টেল খুঁজে বের করতে হবে। তবুও ঢাকা আমি যাব না। ঐ ক্যাচক্যাচানি আর ভালো লাগে না।

আরও পড়ুন গল্প হাইয়া আলাল ফালাহ 

নিচে নামার পর প্রচণ্ড ক্ষুধা অনুভব করলেন। পাশের একটা খাবার হোটেলে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলেন,
— ভাই খাবার হবে?
— হবে। কী খাবেন?
— কী খাবার আছে?
— রুটি, পরোটা, ভাত আপনি যা খান।
— নাস্তার কিছু?
— এইগুলো দিয়েই তো নাস্তা করবেন।
বাহ্! বিক্রির কী ধরন—এইগুলোই নাস্তা, এইগুলোই লাঞ্চ আর এগুলোই ডিনার?
— ভাই, তরকারি কী?
— আলু ভর্তা, কচুর শাকঘণ্ট, শাক ভাজি, মাছ, মাংস। আপনি কী খাবেন?
— দুইটা পরোটা দেন।
দোকানি পরোটা দিয়ে বললো,
— আর কী দিবো?
— ডাল-ভাজি অথবা মুরগির লটপটি দেন।
— এসব হবে না। কচুর শাক ঘণ্ট খান, ভালো লাগবে।
মিজান সাহেব চোখ বড় বড় করে বললো,
— পরোটার সাথে কচু ঘণ্ট? এভাবে আবার কেউ খায় নাকি?
— আরে সাহেব, কত মানুষই তো খায়৷
মিজান সাহেব চিন্তা করলো দূরে এলাম ‘লো কস্ট এরিয়ায়’ ভালো খাবো বলে। এর থেকে প্রিয়তমার লাল চোখই ভালো। কোনোদিন পরোটার সাথে কচুর শাক খায় না-কি?
— ভাই, আমাকে একটা ডিম ভেজে দাও। আমি কচুর শাক খাবো না। একটু মরিচ-পিঁয়াজ বেশি করে দাও।
দোকানি একটা ডিমের হাফ নিয়ে এলো। অর্থাৎ ডিম ভেজে পাটিসাপটা করে মাঝখান দিয়ে খুন্তি চালিয়ে দুভাগ করেছে। এই ‘হাফ’ মিজান সাহেবের ভালোই জানা আছে। কারণ প্রতিদিন সকালে তাকে এমন ডিমই খেতে হয়।

আরও পড়ুন গল্প বিষফুল

মিজান সাহেব চোখ বড় বড় করে বললো,
— এই ভাই, আমি হাফ খাবো না। আমি তো ডিম আস্তা দিতে বললাম, তুমি হাফ দিলে কেন? দোকানে হাফ ডিম বিক্রি হয় নাকি?
— ওটা হাফ না। দুটা ডিম ভেজে মাঝখানে কেটেছে।
— ওটা আমাকে বুঝাতে হবে না। এ বিষয়ে আমি ভালো বুঝি। ফুল ডিম মরিচ-পিঁয়াজ বেশি করে দিয়ে ভেজে আন।
— আমি তোমাকে দুই ডিম একসাথে ভাজতে বলেছি? তোমরা দেখছি, ঢাকা থেকেও চালাক। কে বলে মঙ্গা এলাকার মানুষ বোকা?
ছেলেটা মুখে বিড় বিড় করতে করতে বিরক্ত সহকারে ডিম নিয়ে গেলো। তারপর একটা ডিম ভেজে পুনরায় নিয়ে এলো।

পরোটা খাওয়ার পর বিল পরিশোধ করে মিজান সাহেব হোটেল থেকে বের হলেন। একজনকে জিজ্ঞাসা করলেন,
— কুড়িগ্রাম শহরটা কোন দিকে?
ভদ্রলোক হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলো, ঐ দিকে। রিকশা নিয়ে যান, দশ টাকা রিকশা ভাড়া নিবে। মিজান সাহেব চিন্তা করলো হেঁটেই যাব, দশ টাকা আর ভাড়া দিবো না। তাছাড়া দেখা ও চেনা দুটোই হবে। হাঁটা শুরু করলো। বইয়ের দোকান, টিভি, ফ্রিজের দোকান অর্থাৎ এ দোকান ও দোকান ঘুরতে ঘুরতে কুড়িগ্রাম শহরের চারমাথায় এসে দাঁড়ালো। দেখলো ধানসিঁড়ি নামক একটা খাবারের দোকান। চিন্তা করলো ঢাকায়ও ধানসিঁড়ি রেস্টুরেন্ট আছে। আবার কুড়িগ্রামেও ধানসিঁড়ি, দেখে আসি কেমন রেস্টুরেন্ট। এখানে খাবার মান কেমন। দোকানে ঢুকে একটা টেবিলে বসে, ওয়েটার এলে জিজ্ঞাসা করলো,
— কী খাবার আছে?
— ভাত খাবেন? না নাস্তা করবেন?
— এখন ভাত হবে?
— হ্যাঁ, হবে।
নাস্তার কী আছে?
— নাস্তার হালিম আছে, পরোটা ডাল-ভাজি, মুরগির লটপটি, কচুর শাক ইত্যাদি।
মিজান সাহেব ঘুরে ঘুরে দেখলো- না, তরকারি ভালোই আছে। তারপর চিন্তা করলো, এখন ছয়টা বাজে। সাড়ে সাতটা, আটটার দিকে এসে রুটি আর লটপটি খাবো যাতে রাতে আর খেতে না হয়। এখন হোস্টেল দেখে আসি। ওয়েটার বললো,
— স্যার বসেন, কী খাবেন?
— না, এখন কিছু খাবো না, পরে আসব।
এই বলে হোটেল থেকে বের হয়ে এলো। ওয়েটার মিজান সাহেবের দিকে এমনভাবে তাকালো যেন, এমন আজব মানুষ দুনিয়াতে কখনও দেখেনি।

আরও পড়ুন গল্প ওরা তেরোজন

মিজান সাহেব পিছনের দিকে আর না তাকিয়ে রাস্তায় হাঁটা শুরু করলো। রাস্তায় এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলো,
— ভাই, কুড়িগ্রামের মূল শহর কোনটা?
ভদ্রলোক মিজান সাহেবের দিকে তাকিয়ে থাকলো। মিজান সাহেব আবার জিজ্ঞাসা করলো,
— এই যে ভাই, মার্কেট-টার্কেট কোন্ দিকে?
ভদ্রলোক কিছু না বুঝে তাকিয়ে রইল। মিজান সাহেব বুঝতে পেরে বললেন,
— এই ধরেন জামা-কাপড়, জুতা-স্যান্ডেল পাওয়া যায়।
একটু দমমেরে থেকে বললো,
— ঐ দিকে যান, ঐ মসজিদের আশপাশেই সব দোকান-পাট হবে সবকিছু পাওয়া যাবে।
মিজান সাহেব হাঁটতে শুরু করলো।

ভদ্রলোক চিন্তা করলো- লোকটা দেখে তো মনে হয় বাংলাদেশি, বাংলায় কথা বলে। কিন্তু মনে হয় সুইডেনে বেড়াতে এসেছে, কিছুই যেন চেনে না! ছাগল কোন্ কার যেন।

মিজান সাহেব হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর এগোতেই দেখে একটা হোস্টেল। নিচে দোকানপাট। সামনে একটা ইলেকট্রনিক্সের দোকান। দোকানে ঢুকতেই দেখা গেলো টুপি পরা দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক। চিন্তা করলো ওনার কাছে সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে। দেখেই মনে হয়- ভদ্রলোক, বেশ বিশ্বস্ত।
— এই যে ভাই, একটু কথা বলতাম।
— হ্যাঁ, বলেন।
— ভাই, এদিকে থাকার কোন ভালো হোস্টেল পাওয়া যাবে?
— হ্যাঁ, কিন্তু এদিকে ভালো হোস্টেল পাবেন না। আপনি বাস স্টেশন যান। ওখানে অরবিন্দু ও সুফিয়া দুটি হোস্টেল আছে। ওখানে থাকতে পারবেন।
— ঐ হোস্টেলের ভাড়া তো বেশি। আপনাদের উপরের হোস্টেল কেমন?
— না, এ হোস্টেল ভালো না।
ওনার মুখে কেমন যেন একটা ঘৃণার ভাব ফুটে উঠলো। তিনি আবার বললেন,
— ঐ যে একটু দূরে একটা হোস্টেল দেখা যায়, আপনি ঐখানে যান। ঐ হোস্টেল ভালো আছে।

আরও পড়ুন গল্প সাদা কাগজে প্রেম

মিজান সাহেব দোকান থেকে বের হয়ে রাস্তার এপারে দাঁড়িয়ে হোস্টেলের দিকে লক্ষ্য করলেন, কোনো মেয়ে মানুষ হোস্টেলে দেখা যায় কি-না অথবা ঘন ঘন মানুষ যাতায়াত করে কি-না। দেখলো দুই-চার জন মানুষের আনাগোনা আছে। তারপর ইলেক্ট্রনিক্স দোকানের ঐ ভদ্রলোকের দেখানো হোস্টেলের দিকে গেল। দেখলো একজন বৃদ্ধ ম্যানেজার বসে আছে। জিজ্ঞাসা করলো,
— চাচা হোস্টেলে সিট হবে?
— হ্যাঁ, কয়টা।
— একটা।
— আছে।
— সিট ভাড়া, মানে সিঙ্গেল কত আর ডাবল…।
— সিঙ্গেল চারশত টাকা, ডাবল পাঁচশত টাকা।
— ডাবল মাত্র একশত টাকা পার্থক্য? এসি রুম হবে না?
— না, এসি রুম নাই।
আলাপ করার পর মিজান সাহেব বাইরে এলেন। চিন্তা করলো— দেখি ঐ হোস্টেলে আসলে খারাপটা কী। নাকি ভদ্রলোক ভুল তথ্য দিলো। মিজান সাহেব ইলেক্ট্রনিক্স দোকানের ভদ্রলোকের চোখ ফাঁকি দিয়ে হোস্টেলে গেল, গিয়ে দেখে একজন টেলিভিশন দেখছে আর একজন অফিসের সোফার মধ্যে শুয়ে আছে। মিজান সাহেব অফিসে গেলেও কারো কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করতে পারলো না। জিজ্ঞাসা করলো,
— ভাই, থাকার সিট হবে?
সোফায় শুয়ে থাকা ছেলেটা উঠে বললো,
— হ্যাঁ, হবে।
— সিঙ্গেল ভাড়া কত আর ডাবল সিটের কত ভাড়া?
— সিঙ্গেল একশত পঞ্চাশ টাকা, আর ডাবল তিনশত টাকা। মিজান সাহেব দেখলো খুব সস্তা। এমন ভাড়ার রুমই তো চেয়েছিলাম। যাতে বেশিদিন থাকা যায়। কিন্তু এই ভদ্রলোক যে বললো-খারাপ হোস্টেল, সেটা কী করে বুঝবো? না থাক, তার পর হোস্টেল থেকে বের হয়ে এলো।
রাস্তায় এসে চিন্তা করলো—রুম দেখা হলো না, কেমন রুম? তাছাড়া সুকৌশলে জানা যায় কি না এখানে মহিলা থাকে কি না অথবা মহিলা গেস্ট আসে কি না, যদি এসব ঝামেলা না থাকে তবে এখানে থাকাই ভালো। কিন্তু একবার ফিরে এসেছি, আবার গেলে কী মনে করবে? ভাববে ভদ্রলোক মনে হয় মহিলাই খুঁজছে। না থাক, যাব না। চাচা মিয়ার হোস্টেলেই উঠবো।

আরও পড়ুন গল্প অন্তর্জাল ও মৃত্যু

এমন সময় দেখা গেল ঐ হোস্টেল থেকে একটা ছেলে বের হয়ে এলো এবং মিজান সাহেবের পাশ দিয়ে হেঁটে একটা পান দোকানে গেল। মিজান সাহেবও তাকে অনুসরণ করে পান দোকানে গেল। ছেলেটা সিগারেট আর পান নিল। মিজান সাহেব পান-সিগারেট খান না তাই একটা চকলেট নিল। যেহেতু দুজনই ঐ দোকানের খরিদ্দার এই সম্পর্কের সূত্র ধরে মিজান সাহেব জিজ্ঞাসা করলো,
— আপনি ঐ হোটেলের না?
ছেলেটি বললো,
— হ্যাঁ।
— হোস্টেলে সিট হবে?
ছেলেটি বললো,
— হ্যাঁ, হবে। চলেন যাই।
মিজান সাহেব ছেলেটির পিছু নিল। তারপর হোস্টেলে গিয়ে বললো,
— সিঙ্গেল সিটের রুমটি দেখান তো।
ম্যানেজার চাবি দিয়ে ছেলেটিকে বললো,
— ৩০৭ নং রুমটি খুলে দেখাও। মিজান সাহেব ছেলেটির সাথে গেল। রুম খুলে দেখালো। মিজান সাহেব দেখলো রুম ভালোই আছে। ভাড়াও কম। কিন্তু বিদ্যুৎ থাকে কি না জিজ্ঞাসা করতেই সে বললো,
— জেনারেটর আছে।
— আচ্ছা এখানে মহিলা গেস্ট আসে? অথবা আমি যদি আনি তবে থাকা যাবে?
ছেলেটি বললো,
— না, মহিলা গেস্ট নেই। কুড়িগ্রামের কোনো হোস্টেলেই মহিলা গেস্ট নেই। আর স্বামী-স্ত্রী ছাড়া অন্য কাউকেই এলাও করা হয় না।
মিজান সাহেব দেখলো- এটাই তো চাই। তাহলে এ হোস্টেল খারাপ কিসের? এখানেই থাকবো।

আরও পড়ুন প্রিয়তমার লাল চোখ-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
শেষ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

প্রিয়তমার লাল চোখ (৩য় পর্ব)

Facebook Comments Box

মোহাম্মদ সেলিমুজ্জামান কবি, কথাশিল্পী ও গবেষক হিসেবে সমধিক পরিচিত। প্রকাশিত উপন্যাস: চেয়ারম্যান হবো, ভোরের কুহেলিকা; কাব্যগ্রন্থ: নষ্ট ভালোবাসা, গল্পগ্রন্থ: সিডরের সেই রাত এবং তারপর..; ভ্রমণকাহিনী: নোবেলের দেশে শান্তির দেশে; গবেষণা গ্রন্থ: বাংলা সাহিত্য ও বঙ্গবন্ধু। তিনি পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের গুপিনপুর গ্রামের সন্তান। সম্ভান্ত মুসলিম প্রামাণিক পরিবারে ১৯৬৯ সালের ১ জানুয়ারিতে তাঁর জন্ম।

error: Content is protected !!