প্রিয়তমার লাল চোখ (২য় পর্ব)
প্রিয়তমার লাল চোখ (২য় পর্ব)
মিজান সাহেব চিন্তা করলো প্রতিদিনের ক্যাচক্যাচানি, ছেলেমেয়েদের অবহেলা আর ভালো লাগে না। কিছু দিন বাইরে থেকে আসি। আমার অনুপস্থিতি তারা ঠিকই টের পাবে। মিজান সাহেব রাগ করে কাপড়-চোপড় পাল্টিয়ে, বিছানায় শুয়ে পড়লো। মিজান সাহেবের স্ত্রী রান্না শেষ করে ছেলেমেয়েদের পড়াতে বসালেন। রাতের খাবার শেষে বিছানার কাছে এসে বললো,
— ওষুধ খেয়েছো?
মিজান সাহেব কোনো কথা বললো না। স্ত্রী এবার শুরু করলেন তার স্বভাব সুলভ অভিযোগ।
— ঠিকমতো ওষুধ খাও না, মরে গেলে তোমার ছেলেমেয়ে দেখবে কে? আমি এ সংসার ছেড়ে চলে যাব।
মিজান সাহেব চিন্তা করলো, বিকেলের নাস্তা নেই, রাতের খাবারের জন্যও কোনো তাড়া নেই, আছে ওষুধ খাবার তাড়া। অর্থাৎ আমাকে বেঁচে থাকতে হবে, শুধু সংসারের ছাতা হয়ে। সেটা ভাঙা হোক আর ভালো হোক। তাতে কিছু যায় আসে না। এদিকে রাত বাড়তে থাকে আর ক্ষুধাও বাড়তে থাকে, ঘুম আর হয় না। কিছুক্ষণ পর বিছানা থেকে উঠে এ রুম ও রুম করে ড্রয়িং রুমে এসে বসে থাকলো মিজান সাহেব। মিজান সাহেবের ছোট ছেলে সীমান্ত তার কাছেই ঘুমায়। রাতে সে দেখে বাবা বিছানায় নেই। ঘুম থেকে উঠে এসে দেখে ড্রয়িং রুমে বাবা বসে আছে।
— কী বাবা এখানে তুমি কী করছো? এত রাতে ঘুম থেকে উঠে এখানে বসে আছ কেন? ঘুমাবে চলো।
মিজান সাহেব কোনো কথা না বলে ছেলের সাথে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ে। বিছানায় শুয়ে আচ্ছন্ন নিদ্রায় মনের ভিতর অনেক কথা উঁকি-ঝুঁকি করতে থাকে। এই তো সেদিন স্ত্রী বেতন পাওয়ার পর বাজারে গিয়ে ছেলেদের জন্য দুধ বনভিটা (হরলিক্সের ন্যায়) আর পাউরুটি কিনে আনে। স্বল্প বেতনে বেশি কিছু কিনতে না পারায় তার অনেক আফসোস। স্ত্রী, মিজান সাহেবের কোলের কাছে শুয়ে বলছিল জান বড় লোকদের টাকা খরচ করার কত উপায়! আজ দোকানে কত ধরনের জেলি দেখলাম। কোনোটার দাম দুইশত, কোনোটার আবার পাঁচশত টাকা। যেটা অস্ট্রেলিয়ার তৈরি, ওটা নাকি ডায়াবেটিস রোগী ও বয়স্কদের জন্য বানানো। মিজান সাহেবের এবার ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। তাই স্ত্রীর কথার সাথে সাথেই বললো,
— তাহলে আমার জন্য একটা আনলে না কেন?
অমনি প্রিয় দু’টি চোখ লাল করে বললো,
— অ্যাঁ, আবার জেলি খায়? আমি আমার ছেলেদের জন্য কিছু কিনতে পারি না, আর ওনার জন্য জেলি আনবো, না?
মিজান সাহেব আস্তে করে বললো,
— না তুমি বললে তো, তাই বললাম আর কী?
— তুমি বলো কেন? আমি তো বড় লোকদের টাকা খরচ করার জায়গার কথা বললাম।
মিজান সাহেব কথা না বাড়িয়ে চুপ করে বিছানার সাথে নিজেকে আটকিয়ে রাখলেন। সে রাতে মিজান সাহেবের আর কিছুতেই ঘুম হলো না। ভোর পাঁচটার দিকে উঠে নামাজ আদায় করে তারপর বাথরুম, গোসল সেরে নাস্তার টেবিলে আসতেই স্ত্রী বললো — তোমার জন্য তিনটা রুটি আর আলু ভাজি। কম করে খেও। ডিম অর্ধেক খাবে। বাকিটুকু পারিয়া খাবে।
মিজান সাহেব চিন্তা করলো রাতেও কম খাবার দেয়। তারপর সকালেও ছোট তিন রুটি। কোনো কথা না বলে নাস্তা সেরে কাপড় পরে অফিসে চলে যায়।
পিয়ন রাজ্জাক এসে বললো,
— স্যার আপনার কাছে একজন লোক এসেছে।
— ঠিক আছে পাঠিয়ে দাও।
ভদ্র লোক ভিতরে ঢুকে সালাম দিলো। বললো,
— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাফিজ স্যার পাঠিয়েছে। আপনাকে এই টাকাগুলো দিতে বলেছে।
মিজান সাহেব হাসিমুখে টাকা হাতে নিয়ে চিন্তা করলো, কালই বাসা থেকে চলে যাব। দূরে, বহু দূরে। মিজান সাহেব অফিস থেকে সাত দিনের ছুটি নেয়। তারপর পরিকল্পনা করে এই টাকায় বেশিদিন থাকা যায় এমন জায়গায় যেতে হবে। যেখানে থাকা-খাওয়ার খরচ কম এমন এলাকা ঠিক করতে হবে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট, খুলনা এসব এলাকা অনেক ব্যয়বহুল, তাই যাওয়া যাবে না। চিন্তা করে ঠিক করলো, কুড়িগ্রাম মঙ্গা এলাকা। সব কিছু সস্তা, ঐ এলাকায় গেলে ভালো হয়। তাই ঐ এলাকায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।
মিজান সাহেব সেদিন বাসায় এসে কাপড় গুছিয়ে ব্রিফকেসে রাখলো। সকাল ছয়টার দিকে কাপড় পরতে থাকে সে। স্ত্রী এসে বললো,
— কোথায় যাও?
মিজান সাহেব কথা বললো না।
— ট্যুরে যাও আর যেখানেই যাও বাজার করার টাকা রেখে যেও।
মিজান সাহেব কোনো কথা না বলে এক হাজার টাকার একটা নোট টেবিলের উপরে রেখে ব্রিফকেস হাতে করে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো। আগের দিনই কুড়িগ্রামগামী ‘নাবিল’ গাড়ির একটা টিকিট কেটে রেখেছিল। সে বাসা থেকে বেরিয়ে একটু দূরে যেতেই বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ভিজে দৌড়ে রাস্তায় গিয়ে দেখে কোন গাড়ি-ই গাবতলি যায় না। এদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে। চিন্তা করলো বেশিক্ষণ দেরি করলে গাড়ি মিস করবে। বেবিতে গেলে ভাড়া বেশি লাগবে। রিকশাতেই যাওয়া যাক।
— এই রিকশা কল্যাণপুর যাবে?
— যাব।
— ভাড়া কত?
— একশত।
— কমে যাবে না?
— আশি টাকা দিবেন।
— পঞ্চাশ টাকা নাও।
— না, যাব না।
এরপর আরেক রিকশা একশত টাকা ভাড়া চায়। মিজান সাহেব ষাট টাকা বলে। তারপর আরেক রিকশা… কিন্তু সময় শেষ আবার ভাড়া বাড়ে। এখন আশি টাকাতেও কোনো রিকশা যায় না। এ কী করলাম, আশি টাকায় চলে গেলেও তো ভালো ছিল। টাকা বাঁচাতে গিয়ে বাস মিস করলে তো টাকাই শেষ হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত একশত টাকা দিয়ে একটা রিকশা ভাড়া করে মিজান সাহেব। একটু এগোতেই প্রচণ্ড ট্রাফিক জ্যাম। কিছুতেই আর রিকশা এগোয় না। এদিকে সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। মিজান সাহেবের হার্টবিট বাড়তে থাকে। বাস মনে হয় আর ধরা গেল না। শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে পড়ল সে। একটু একটু করে রিকশা যখন আসাদগেট ছেড়ে সংসদ ভবনের রাস্তার মাথায় গেল; অমনি মিজান সাহেবের চোখে পড়ল নাবিলের বাস কাউন্টার। রিকশাওয়ালাকে বললো,
— ভাই একটু থাম, আমি বাস কাউন্টারে গিয়ে শুনে আসি কুড়িগ্রামের বাসের অবস্থান কোথায়। এখন তো সাতটা বেজে গেছে। বাস ছেড়ে দেয়ার কথা।
মিজান সাহেব কাউন্টারে এসে জিজ্ঞাসা করতেই কাউন্টার থেকে জানালো,
— ঐ যে বাস ছেড়ে যাচ্ছে। আপনি তাড়াতাড়ি যান, বাসে ওঠেন।
মিজান সাহেব তাড়াহুড়া করে রিকশার কাছে গিয়ে বললো,
— ভাই আমার বাস ছেড়ে যায়, তুমি ভাড়া নাও। একটু কম রাখো। কল্যাণপুর তো যাওয়া হলো না।
রিকশাওয়ালা বললো,
— ভাই, কম হবে না।
— কেন? আপনারা একটু দূরে গেলে তো বেশি ভাড়া দাবি করতেন। এখন কম নিবেন না কেন?
বাস ছেড়ে যায়, তাড়াতাড়ি করে রিকশা ভাড়া মিটিয়ে বাসে চড়তে গিয়ে পা ফসকিয়ে পানির মধ্যে এক পা ঢুকে গেল। প্যান্টও ভিজে গেল। মিজান সাহেব জোরে চিৎকার করলেন,
— এই বাস থামেন, আমি আসছি।
হেলপার বাসে একটা থাপ্পড় দিয়ে বললো,
— আসেন তাড়াতাড়ি।
মিজান সাহেব দৌড়ে গিয়ে বাসে উঠলেন। বাসের সিটে যখন বসলেন, তখন লক্ষ করলো জামা-প্যান্ট কিছুই ভেজার আর বাকি নেই। নোংরা পানিতে প্যান্ট ভিজসে, একটু গন্ধও নাকে আসছে। পাশের ভদ্রলোক একটু উসখুস করছে। মনে মনে বিরক্তও হচ্ছে। মিজান সাহেব, হাসি দিয়ে বললো,
— যাক বাসটা তাও পেলাম। একটু ভিজে গেছি।
মিজান সাহেবের মুখে প্রশান্তির হাসি দেখে ভদ্রলোক কপালে চোখ তুলে বললো,
— কোথায় আপনি একটু ভিজেছেন? আপনি তো সম্পূর্ণই ভিজেছেন। তারপরও হাসছেন? যেভাবে পড়েছিলেন তাতে জীবন-লীলা সাঙ্গ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল, আমি তো লক্ষ করেছিলাম।
— হ্যাঁ, তা ঠিকই বলেছেন। রাস্তায় জ্যাম ছিল তো তাই। কী আর করা, কাপড় পাল্টানোর সুযোগ তো নেই। এটা ইউরোপের কোনো দেশ নয়, বাংলাদেশ। সারা রাস্তায় কষ্ট করতে হবে এই আর কী।
— আপনি যেভাবে ভিজেছেন তাতে আপনার অসুখ করবে।
— যাক আল্লাহর উপর ভরসা। এছাড়া কী-ই বা করতে পারি?
মিজান সাহেব সিটের উপর মাথা দিতেই চোখে ঘুম এসে গেল।
একসময় ঘুম থেকে জেগে দেখে বাস ফুট ভিলেজে দাঁড় করিয়েছে। মিজান সাহেব চিন্তা করলো দামি রেস্টুরেন্টে খাওয়া যাবে না। রাস্তার ঐ ধারে যে ইটালি (ছোট চাটাই দিয়ে তৈরি করা) রেস্টুরেন্টে সেখানে খাওয়া যাক। রেস্টুরেন্টে গিয়ে মিজান সাহেব দেখলো তরকারি রান্না করে বড় ডিশের মধ্যে রেখেছে। আর মাছিগুলো উড়ে উড়ে মনের আনন্দে তার স্বাদ নিচ্ছে। এ ডিশ থেকে ও ডিশে। তারপরও পেটে ক্ষুধা।
— ভাই, ভাত কী দিয়ে?
— মাছ আছে, মাংস আছে। আপনি কী খাবেন?
— কী মাছ?
— আইড় এবং বাইন মাছ।
— এই যে মাছি যেগুলোর স্বাদ দেখছে, এইগুলো নাকি?
— ভাই, দুই একটা মাছি আছে। তবে এইমাত্র রান্না করেছি তো তাই।
— মাছ কত করে?
— মাছ ষাট টাকা, মাংস একশত টাকা।
— মাছই দেন৷
— কোন মাছ দিব?
— বাইম মাছ।
দোকানি মাছ এবং এক প্লেট ভাত এনে দিলো।
— ভাই, বাইম মাছ কোথায়? এটা তো বাইম মাছের মাথা। চেঞ্জ করে দেন।
ওয়েটার এবার পরিবর্তন করে যা আনলো তা আরো ছোট।
— কত বড় মাছ দেখলাম। তুমি ঐগুলো না দিয়ে এত ছোট মাছ কোথায় পেলে?
— বড় মাছ দেয়া যাবে না। আপনি খেলে খান, না হলে যান। ঐ বড় মাছ দেখিয়েই তো ছোট মাছগুলো বিক্রি করতে হবে। মিজান সাহেব কথা শুনে রাগে গরম হয়ে গেল। শুধু বললো,
— তুমি টের পেয়েছ যে, আমার আর রাগ করার বয়স নেই।
দুই মুঠো ভাত গালে দিয়ে আর খেতে ইচ্ছা করলো না। ভাতের মধ্যে হাত ধুয়ে টাকা পরিশোধ করে চলে এলো। বাসে বসে চিন্তা করলো- এ কী! ঘরেও জ্বালা, আবার বাইরেও জ্বালা। বারী সিদ্দিকীই আজ ঠিক। আমি তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
আরও পড়ুন প্রিয়তমার লাল চোখ-
১ম পর্ব
৩য় পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
প্রিয়তমার লাল চোখ (২য় পর্ব)