প্রিয়তমার-লাল-চোখ-১ম-পর্ব
গল্প,  মোহাম্মদ সেলিমুজ্জামান,  সাহিত্য

প্রিয়তমার লাল চোখ (১ম পর্ব)

প্রিয়তমার লাল চোখ (১ম পর্ব)

মোহাম্মদ সেলিমুজ্জামান

 

বাবা, তুমি মাকে অত কথা বলো না তো, পারলে রান্না করে খাও। মা যা পেরেছে তাই করেছে। মেয়ে পারিয়া এ কথা বলতেই মিজান সাহেব বললো,
— না, তাই বলে মাছের পিস এত ছোট করে কাটে? এতে তো একটুও মাছ নেই, শুধু কাঁটা। খেতেও আবার দাঁতের উপর পাটির মধ্যে খাড়া হয়ে ঢুকলো। কথাই তো ঠিক মতো বলতে পারছি না। তারপর আবার খাবো কী করে?”
তুমিই তো বলেছ মাছ ছোট করে কাটতে। যাতে অনেকদিন খাওয়া যায়। মাছের যা দাম কেনার উপায় নেই। তাই ছোট করে কেটেছি।
— কিন্তু পিছা? পিছাও কী ছোট করে কাটতে বলেছি?
মিজান সাহেবকে আজকাল মাছের পিছা অথবা কুন্টা খেতে দেয়। স্ত্রী বলে,
—মাছ ছেলেমেয়ে খাবে, তুমি পিছাই খাও।
মিজান সাহেব চিন্তা করলো ছোটবেলায় দেখেছি আমার দাদি বড় মাছটা, ভালো মাংস এবং গরুর দুধ লাল করে জ্বালিয়ে দাদাকে খাওয়াতো। দাদার হাত পুরা দুধের মধ্যে না ডুবলে দাদা দুধ খেতো না। আবার ভালো মিষ্টি আমগুলো দাদির নিজের বাক্সের মধ্যে তালা দিয়ে রাখতো দাদাকে খাওয়ানোর জন্য। দাদার খাওয়ার সময় হলে বাক্সের মধ্য থেকে চুপি চুপি আমগুলো বের করে দাদাকে খাওয়াতো। বাজার থেকে বড় বড় শবরি কলা এনেও লুকিয়ে রেখে দাদাকে দুধ-ভাতের সঙ্গে খেতে দিতো। প্রতিদিন সকালে একটা করে ডিম সিদ্ধ করে দাদাকে খেতে দিতো। আমি কোনো ফাঁকে যদি একটু খেতে পারি এজন্য দাদার পাশাপাশি থাকতাম। দাদার খাওয়ার দিকে চেয়ে থাকলে দাদা ডিমটা ভেঙে একটু খেতে দিতো।

আবার কোনো সময় একটু দুধ মাখা ভাতও দিতো। তখন পরম আনন্দে খেয়েছি। দাদাকে খেতে দিয়ে দাদি পাশেই বসে থাকতো। যতক্ষণ না খাওয়া শেষ হতো ততক্ষণ দাদি বসে থাকতো। খাওয়া শেষ হলে দাদি থালা-বাসন নিয়ে যেতেন। তারপর একটা পান এনে দাদাকে দিত। দাদা পরম সুখে পান চিবাতেন। যেদিন কোনো কারণে দাদি দাদার কাছে বসে থাকতে পারতেন না, সেদিন দাদা খেতেন না। বলতেন কুকুর-বিড়ালের খাবার দিয়ে গেছে। আমি ভাত খাবো না। যা তোর দাদিকে ডেকে আন। আমি দৌড়ে দাদিকে ডেকে আনতাম। এই ফাই-ফরমাশ খাটার বিনিময়ে আমার একটু বেশিই দুধ মাখা ভাত, ডিমের অংশ অথবা ভালো মাছের অংশবিশেষ জুটতো। ভাবতাম বড় হলে আমিও দাদার মতো ভালো ভালো খেতে পারবো। বিষয়টি গল্পের ছলে প্রিয়তম স্ত্রী ফৌজিয়া আহম্মেদকে অনেক দিন শুনিয়েছি। যদি একটু অনুকম্পা হয়। অথবা উৎসাহিত হয়ে ভালো খাবারের পরিমাণটা একটু বাড়িয়ে দেয়।

মিজান সাহেব দাদির কথা বলতেই, স্ত্রী গর্জে উঠে বললো,
— রাখো তোমার দাদি কথা। ঐ দিন আর নেই। তোমার দাদি চাকরি করতো? তোমার দাদা তোমার দাদিকে ভালো ভালো কাপড় কিনে দিতো। ভালো ভালো বাজার করে দিতো। তোমার ভালো মাছ, ভালো আম এগুলো কেনার মুরদ আছে?
বলেই ছেলেকে ধমক দিয়ে বললো,
— এই যা। আমি প্রতিদিন খাইয়ে দিতে পারবো না। আজ একাই খাবি।
মিজান সাহেব চমকে উঠে শান্ত হয়ে গেলো। আর কথা বাড়ালো না৷
স্ত্রী বলতেই লাগলো,
— সামনে ঈদ, ছেলেমেয়ের কেনাকাটার কথা বলো না। গত ঈদেও কাউকে কিছু দাওনি। আমাকে তো কোনো দিনই কিছু দাও না। এত কামাই করো, টাকা-পয়সা কী করো? আমি কিছুই বুঝি না? প্রতিদিন তো হাওয়ার উপর দিয়ে চলছো। এখন আবার যুক্ত হয়েছে লেখালেখি। বই ছাপাও, প্রকাশকের কাছে যাও। পরিচিতজন, বন্ধু-বান্ধবী, আত্মীয়-স্বজন যাকে জানাও তারাই বলে একখানা বই পাঠিয়ে দাও, পড়ে দেখি। বই পাঠাও, দৌড়াদৌড়ি করো। আমাদের কোন সময়ও দাও না। সুখে রেখেছো? এরপর আবার ভালো খেতে চাও, না?
মিজান সাহেব কোনো মতো খাবার শেষ করে ডাইনিং টেবিল থেকে উঠে পাশের রুমে আত্মগোপনের চেষ্টা করে।

মিজান সাহেব অফিস থেকে বাসায় ঢুকতেই বড় ছেলে রোহান বললো,
— বাবা, সীমান্ত বইসহ ব্যাগ হারিয়ে ফেলেছে।
— কোথায় সীমান্ত?
— বাবা, সীমান্ত নানা বাড়ি চলে গেছে। তুমি রাগ করবে তাই বাড়ি আসেনি।
মিজান সাহেবের স্ত্রী বললো,
— ব্যাগের মধ্যে পানির পট, বই-খাতা সবই ছিল। নতুন ব্যাগটা। এখন ব্যাগ কিনবে, টাকা পাবে কোথায়? তাছাড়া বইপত্র তো আছেই।
মিজান সাহেব কোনো কথা না বলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। আজ তার হাতে কোনো টাকা নেই। কাপড় খুলে হাত-মুখ ধুয়ে ডাইনিং টেবিলে বসতেই স্ত্রী বললো,
— যাও, আটা কিনে আনো।
মিজান সাহেব চোখ বড় বড় করে বললো,
— আটা কিনতে হবে আগে বলতে পারনি?
— কখন বলবো? তোমার সাথে তো এখনই দেখা হলো।
— কেন? সকালে দেখা হয়নি?
— সকালে বললে বল এখন কি বাজারে যাচ্ছি? আর বিকেলে বললে বল সকালে বলতে পারনি? আসলে কখন বললে ভালো হয় আমি তো কিছুই বুঝতে পারি না। তোমাকে বাজারের কথা বললেই শুধু একথা ওকথা বলো। কারণ কী?
মিজান সাহেব আস্তে করে বললো,
— যাচ্ছি।
স্ত্রী শান্ত হলে মিজান সাহেব বললো,
— বিকেলের নাস্তা?
— নাস্তা কোথায় পাবো? নাস্তা তৈরি করিনি। প্রতিদিন নাস্তা তৈরি করি, তুমিই তো আসো না। সেজন্য আজ আর তৈরি করিনি।
— ঠিক আছে, গতকালের নাস্তাই ফ্রিজ থেকে দাও।
— ফ্রিজে নাস্তা নেই। শেষ হয়ে গেছে।
— আসলে তুমি আমার জন্য নাস্তাই তৈরি করো না। শুধুই অভিনয়। যাও কিছুই লাগবে না। একটু মুড়ি দাও, খেয়ে পানি খাই।
— মুড়ি কোথায় পাবো? মুড়ি তো সেই কবেই শেষ হয়ে গেছে। আজ বাজার থেকে মুড়িও নিয়ে এসো। সাথে দু’টা ভিমবার।

নানির হাত ধরে ছোট ছেলে সীমান্ত বাসায় এসে ঢুকলো।
মিজান সাহেব পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকলো। চিন্তা করলো আর কিছুক্ষণ থাকলে বাজারের লিস্ট বড় হতে থাকবে। তার চেয়ে কেটে পড়াই ভালো। আদরের ছেলে এসে বললো,
— বাবা আমার জন্য একটা কিনডেজার এনো।
পরম আদরের একমাত্র মেয়ে পারিয়া বললো,
— বাবা আমার জন্যও এনো।
বড় ছেলে রোহান শুধু বাবার দিকে চেয়ে থাকলো।
অবস্থা দেখে মিজান সাহেব জিজ্ঞাসা করলো,
— কিনডেজার কী রে বাবা?
— বাবা, কিনডেজার তুমি চেনো না? ডিমের মতো দেখতে। সেদিন নাফিজ আর নিধি খেয়েছিল। খেতে খুব মজা।

মিজান সাহেব বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে। মিজান সাহেব একটি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। প্রতি মাসের বেতনে সংসার, ভাঙা গাড়ির ন্যায় ঠেলে-ঠুলে চলে কোনো মতো। বাসা থেকে বের হয়ে চিন্তা করে বাজারে গিয়ে বাকি করবো। দোকানি কী ভাববে? বলবে বড় অফিসার টাকা নেই। সামনে কিছু না বললেও মনে মনে দ্বিতীয়বার বাকি না দেয়ার বিভিন্ন অজুহাত তুলবে। ভীষণ চিন্তা নিয়ে পথ হাঁটছে। এমন সময় এক সহকর্মী বললো,
— মিজান সাহেব কোথায় যান? মন এত খারাপ কেন?
— বাজারে যাই। কিন্তু হাতে কোনো টাকা নেই। কী করা যায় বলেন তো? আপনার কাছে কোনো টাকা… ।
— হ্যাঁ, আমার কাছে পাঁচশত টাকা আছে, চলবে?
— চলবে।
সহকর্মীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাজারে গেলেন মিজান সাহেব। দুই প্যাকেট আটা, মুড়ি ও অন্যান্য বাজার করার পর কিনডেজারের কথা বলতেই দোকানি কিনডেজার দেখিয়ে বললো,
— একটা পঁয়তাল্লিশ টাকা।
মিজান সাহেব দেখলো তিনটা কিনতেই প্রায় দেড়শত টাকা লাগে। চোখ কপালে ওঠার উপক্রম। এইটুকু ডিম তার দাম এত! ভাই এর ভিতর কী আছে? স্বর্ণ দিয়ে তৈরি নাকি?
— তা হবে কেন? স্বর্ণ কি খাওয়া যায়?
— তবে কী?
— এতে আছে অনেক কিছু। আপনি নিবেন, না রেখে দিবো?
মিজান সাহেব রাখার জন্য ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলো। বললো,
— এগুলো মানুষ খায় নাকি?
— কী বলেন, আমরা প্রতিদিন দুই-চার ডজন বিক্রি করি।
মিজান সাহেব বাকরুদ্ধ! এদিক-ওদিক তাকাতাকি করে দোকানিকে বললেন,
— ভাই তিনটা চিপস দেন।
দোকানি চিপস দিলে বাজার নিয়ে বাসায় এলো। ছেলেমেয়ে দৌড়ে এসে বাজার হাতে নিয়ে কিনডেজার খুঁজতে
থাকলো।
চিপস দেখে সীমান্ত বললো,
— বাবা এ কী এনেছো? আমি তো কিনডেজার আনতে বলেছিলাম।
— বাবা ওটার দাম বেশি তাই চিপস এনেছি।
— আমি চিপস খাবো না। তুমি বাসা থেকে বের হও। বাবা এমন কথা বলে না।
— না, তুমি বের হও।
ছয় বছরের ছেলে সেও মিজান সাহেবকে ভালোবাসে না। সবাই বোঝে মিজান সাহেব ভালো আয় করতে পারে না। তাই সংসারের কারো কাছেই তার মূল্য নেই।
স্ত্রী এসে বললো,
— ছেলেমেয়ে একদিনই তো কিনডেজার খেতে চেয়েছে, আনোনি কেন? বলেই বাজারগুলো আছাড় দিয়ে রান্না ঘরে রেখে দিলো।
মিজান সাহেব ভাবগতিক দেখে ফিস ফিস করে বললো,
— টাকা নেই।
— হ্যাঁ, তা তো থাকবেই না। এমনি দেখি সবার সাথে দাঁত ক্যালায়ে হাসো। আর বাজার করতে বললে টাকা নেই। তোমার এত হাসি আসে কোথা থেকে? প্রশিক্ষণার্থীদের সাথে এত কিসের হাসি? ও বুঝি, আমি কিছুই জানি না, না?
— শোন ক্লাস, প্রশিক্ষণ, অধিবেশন ঐগুলো সব রঙ্গমঞ্চ। ওখানে বাস্তবের সাথে মিলানো যাবে না। হকার ও অভিনেতার মতো অভিনয় করতে হয়।
— রাখো তোমার অভিনয়। ছেলেমেয়ের ছোটখাটো আবদার পূরণ করতে পারো না। কিসের চাকরি করো?

আরও পড়ুন প্রিয়তমার লাল চোখ-
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
শেষ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

প্রিয়তমার লাল চোখ (১ম পর্ব)

Facebook Comments Box

মোহাম্মদ সেলিমুজ্জামান কবি, কথাশিল্পী ও গবেষক হিসেবে সমধিক পরিচিত। প্রকাশিত উপন্যাস: চেয়ারম্যান হবো, ভোরের কুহেলিকা; কাব্যগ্রন্থ: নষ্ট ভালোবাসা, গল্পগ্রন্থ: সিডরের সেই রাত এবং তারপর..; ভ্রমণকাহিনী: নোবেলের দেশে শান্তির দেশে; গবেষণা গ্রন্থ: বাংলা সাহিত্য ও বঙ্গবন্ধু। তিনি পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের গুপিনপুর গ্রামের সন্তান। সম্ভান্ত মুসলিম প্রামাণিক পরিবারে ১৯৬৯ সালের ১ জানুয়ারিতে তাঁর জন্ম।

error: Content is protected !!