প্রিয়তমার লাল চোখ (শেষ পর্ব)
প্রিয়তমার লাল চোখ (শেষ পর্ব)
মিজান সাহেব দ্রুত হোস্টেল থেকে বের হয়ে একটা রিকশা নিয়ে হোস্টেল অরবিন্দতে গিয়ে ব্যাগ নিয়ে এলো। তারপর সিট বুঝে নিয়ে চাবিটা হাতে করে রাঁধুনি রেস্টুরেন্টের দিকে রওনা দিলো। রাঁধুনি রেস্টুরেন্টে এসে দেখে রেস্টুরেন্টটি মোটামুটি ফিল-আপ। বসার জায়গা তেমন নেই। এমন সময় হঠাৎ দেখলো এক ভদ্র মহিলা তার দুই সন্তান নিয়ে নাস্তা করছে। সামনের সিটগুলো ফাঁকা । মনে পড়ে গেল তার সন্তানদের কথা, সে গিয়ে সামনের সিটে বসে পড়লো। মিজান সাহেব দেখলো বাচ্চাগুলো কী সুন্দর করে একাই ডাল দিয়ে পরোটা খাচ্ছে। কিন্তু তার ছেলেরা একা খেতে চায় না। তাদের গালে উঠিয়ে খাওয়াতে হয়।
মিজান সাহেব এবার ওয়েটারকে ডাকলো। বললো,
— এই খাবার কী আছে?
— স্যার ভাত, মাছ, মাংস, কচুর শাক ঘণ্ট, আপনি যা খান৷ পরোটা আর লটপটি আন। স্যার পরোটা হবে কিন্তু লটপটি নেই।
মিজান সাহেব চোখ বড় বড় করে বললো,
— কী বলিস? আমি এই মাত্র দেখে গেলাম লটপটি আর তুই বলিস লটপটি নেই?
— স্যার ছিল, শেষ হয়ে গেছে।
— কী আর করা, ঠিক আছে। পরোটা আর ডাল আন।
মিজান সাহেব ভদ্র মহিলার ছোট্ট ছেলেকে ইঙ্গিত করে বললো,
— ও যখন পরোটা ডাল এমন সুন্দর করে খাচ্ছে, আমিও পরোটা ও ডাল খাব।
ভদ্র মহিলা বললো,
না, সাথে ভাজিও নেন ভালো লাগবে।
— ঠিক আছে, ভাজিও দে।
ইতিমধ্যে ভদ্র মহিলার ছেলেমেয়েদের সাথে হালকা ভাব বিনিময় হয়েছে। ওয়েটার পরোটা ও ডাল ভাজি এনে দিল। মিজান সাহেব ভদ্র মহিলার ছোট্ট ছেলেটিকে ইঙ্গিত করে বললো,
— কী, কেমন হয়েছে? ভালো, না? এই ছেলে, পানি দাও।
ওয়েটার এতক্ষণ দাঁড়িয়ে কথা শুনছিল। পানি চাইতেই, সে চার গ্লাস পানি নিয়ে এলো। মিজান সাহেব খাওয়া শুরু করলো। এক সময় ভদ্র মহিলা খাওয়া শেষ করে চলে গেল। কিন্তু মিজান সাহেবের খাওয়া শেষ হলো না। কিছু সময় পর মিজান সাহেব খাওয়া শেষ করে পানি খেয়ে হাত মুখ ধুয়ে টেবিলে এলো। তারপর টেবিলে রাখা টিস্যু ও ধনিয়া নিয়ে চিবাতে চিবাতে কাউন্টারে গিয়ে বললো,
— ভাই আমার বিল কত হয়েছে?
ওয়েটার এগিয়ে এসে বললো,
— চারশত পঁচাশি টাকা।
— অ্যাঁ, চারশত পঁচাশি? দুইটা পরোটা আর ডাল-ভাজি চারশত পঁচাশি টাকা?
মিজান সাহেবের চোখ একেবারে মাথায় উঠে গেল। বললো,
— এই মিয়া ঠিক মতো বলো।
— কেন স্যার, আপনি আপনার বউ, ছেলেমেয়েসহ খেয়েছেন। তিনটা হালিম, পরোটা, মাংস, ডাল-ভাজি, চারটা পানি, আর আপনার দুই পরোটা আর ডাল-ভাজি। ঠিক আছে স্যার, আপনি সাড়ে চারশত টাকা দেন৷
— এই তুমি আমার বউ ছেলেমেয়ে কোথায় পেলে?
— এটা কী বলেন স্যার? আপনারা একসাথে খেলেন। তারা চলে গেল। আর আপনি বললেন— বউ ছেলেমেয়ে কোথায় দেখলাম? — এই যা, ওরা আমার বউ, ছেলেমেয়ে হতে যাবে কেন?
— কেন? আপনি যে বললেন— ওরা যা যা খায় তাই আমাকে দাও। আপনার স্ত্রী বললো— ভাজি খাও। আপনি বললেন— ঠিক আছে ভাজিও দাও। আমি তো আপনার কথামতো সবই দিলাম। বলেন, আপনি এসব কথা বলেননি?
মিজান সাহেব আমতা আমতা করে বললো,
— এসব কথা তো বলেছি। কিন্তু সে তো আমার স্ত্রী নয়।
এবার কাউন্টার থেকে ম্যানেজার হুঙ্কার দিয়ে বললো,
— এ ভাই, টাকা দেন তো। আমার আরো কাস্টমার আছে, যতো সব…।
পাশের লোকজন বললো,
— কী ভাই, আপনি টাকা দিচ্ছেন না কেন?
মিজান সাহেব আর কোনো কথা না বলে পাঁচশত টাকার একটা নোট বের করে দিলো। ম্যানেজার পঞ্চাশ টাকা ফেরত দিলো। মিজান সাহেব টাকা নিয়ে বের হয়ে এলো।
মিজান সাহেব দুই দিন প্রেসারের ওষুধ খায়নি। আজকের এ ঘটনায় প্রেসার বেড়ে গেছে। সারা দিন বৃষ্টিতে ভিজে, একটু ঠান্ডা লেগেছে। ক্রমেই শরীর দুর্বল হওয়া শুরু করেছে। তারপর হাঁটতে হাঁটতে হোস্টেলে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
মাথায় অনেক চিন্তা। আজ নামাজ আদায় করাও হয়নি। টাকা বাঁচাতে গেলাম তাও সম্ভব হলো না। তাড়াহুড়া করে চার্জার না আনাতে মোবাইলেও কোনো চার্জ নেই। কারো সাথে যোগাযোগ করাও যাচ্ছে না। শুয়ে শুধু এপাশ ওপাশ করছে। কিছুতেই ঘুম আসছে না।
হায়রে চাকরি! প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কর্মকর্তা হওয়ায় বিশেষ ভাতাও পান না। প্রেষণে আসা কর্মকর্তাদের চাপে পদোন্নতি ও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। সংসারের চাহিদা মিটাতে না পারায় স্ত্রী-সন্তাদের কাছেও…। না কিছুতেই ঘুম আসে না। বিছানায় শুয়ে কত কথা যে মনে পড়ছে তার। জীবনের হিসেব কিছুতেই মিলাতে পারছে না সে। এমন সময় হঠাৎ ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। চারদিকে অন্ধকার। ফ্যান ঘুরছে না। শরীর ঘামছে। মাথাটা একটু ঝিম ঝিম করছে। এভাবে বেশ কিছু সময় গেল কিন্তু ইলেকট্রিসিটি আর আসছে না। মিজান সাহেব রুম থেকে বের হয়ে ডাকতে শুরু করলো,
— এই ছেলে কোথায় গেলে? এই কারা আছেন, জেনারেটর দেন।
এমন সময় একটা ছেলে এসে বললো,
— এত ডাকছেন কেন? দিবো।
— জেনারেটর দাও। বিদ্যুৎ নেই তো। জেনারেটর দেয়া যাবে না। জেনারেটর নষ্ট।
— কেন? তোমরা যে বললে— জেনারেটর আছে। বিদ্যুৎ চলে গেলে জেনারেটর দিবো।
— জেনারেটর নেই, তা তো বলিনি। জেনারেটর আছে কিন্তু দিবো না। এটা কী হয়? চলেন আমার সাথে, জেনারেটর আছে কি না দেখাই৷ ছেলেটা সাথে করে নিয়ে গেল অন্ধকারের মধ্যে, হাত দিয়ে দেখালো ঐ যে জেনারেটর।
— টর্চ লাইট নিয়ে এসো দেখি; ওটা ঠিক আছে কি না। চাচা চলেন তো, উপরে যাই। টর্চ-মর্চ নাই। হোস্টেলে তেমন গেস্টও নেই। শুধু শুধু জেনারেটর দিয়ে তৈল খরচ করবো নাকি?
মিজান সাহেব চোখ বড় বড় করে বললো,
— এটা আবার কেমন কথা?
তারপর অন্ধকারের মধ্যে রুমে এসে ঢুকলো সে। দরজা লাগিয়ে দিতেই বাইরে থেকে ঠক ঠক আওয়াজ।
— কে?
— আমি, স্যার দরজা খোলেন।
— আমি কে?
— হোস্টেল বয় রফিক।
মিজান সাহেব দরজা খুলতেই একজন মহিলা নিয়ে ভিতরে ঢুকলো।
— স্যার, মহিলা গেস্ট। বিদ্যুৎ চলে গেছে হাত-পা টিপায়ে নেন। একটু পরেই বিদ্যুৎ চলে আসবে আরাম করবেন।
মিজান সাহেব চিন্তা করলো যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়। মিজান সাহেব ধমক দিয়ে বললো,
— এটা আবার কী, আমি মহিলা গেস্ট চেয়েছি?
— না, তখন জিজ্ঞাসা করেছিলেন তো, ঐ জিজ্ঞাসা আর চাওয়া একই কথা।
— ঠিক আছে, আমার মহিলা গেস্ট লাগবে না। তোমরা বের হও।
— ঠিক আছে স্যার, টাকাটা দিয়ে দেন।
মিজান সাহেব রেগে বললো,
— কিসের টাকা?
— আমি এত কষ্ট করে এই সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে এলাম, আপনি টাকা দিবেন না?
— তোমরা আমায় চেনো। আমি সরকারি কর্মকর্তা। আমি তোমাদের পুলিশে দিবো।
— পুলিশে আমাদের দিতে হবে না। একটু পরে পুলিশ এসে আপনাকেই ধরে নিবে। তারপর সাংবাদিকদের ডাকবে। তারা ছবি তুলে পত্রিকায় দিয়ে দিবে। সারা দেশের মানুষ দেখবে।
মিজান সাহেব চিন্তা করলো— সর্বনাশ! তাহলে তো সব শেষ। আমার চাকরি, মান-সম্মান সবই যাবে। সত্য ঘটনা কী, তা কেউ পড়বে না। মানুষের পড়ার সময় কোথায়? শুধু হেড লাইন দেখবে মহিলাসহ খরিদ্দার আটক। মিজান সাহেবের মাথার মধ্যে এক চক্কর দিলো।
— এই কত টাকা?
— পাঁচ হাজার দেন।
বলেই থাবা দিয়ে মানি ব্যাগ নিয়ে নিল। সব টাকা বের করে নিয়ে বললো,
— এখন ঘুমান, কাল চলে যাবেন।
মিজান সাহেব বললো,
— ভাই, আমার কোনো টাকা নেই। আমাকে কিছু টাকা দেন, আমি ঢাকায় যাব।
বাইরে থেকে একজন বললো— এই পাঁচশত টাকা দে।
পাঁচশত টাকার একটা নোট দিয়ে বললো,
— ঠিক আছে নেন। ও হ্যাঁ, ঠিক মতো ঘুমান। সকালে দেখা হবে। বাইরে বের হবেন না।
তারা মোবাইলটা নিয়ে রুমের দরজা লাগিয়ে দিলো। মিজান সাহেব চিন্তা করলো— এর চেয়ে প্রিয়তমার লাল চোখই ভালো।
সারারাত ঘুম হলো না। সকালে অনেক চিল্লা-চিল্লির পর রুম খুলে দিলো। ব্যাগটা হাতে নিয়ে হোস্টেল ত্যাগ করলো সে। সারারাত ঘুম নেই। দু’চোখ একবারের জন্যো এক হয়নি। বাসস্ট্যান্ডে এসে চিন্তা করলো— ক্ষুধা লেগেছে, কিছু খেয়ে নেয়া যাক।
রেস্টুরেন্টে ঢুকে দুটা রুটি এবং একটা কচু শাক ঘণ্ট নিয়ে অনেক কষ্টে খেল।
— ভাই, বিল কত?
— বিশ টাকা।
পাঁচশত টাকার নোট বের করে দিতেই, ম্যানেজার রেগে বললো,
— ভাংতি দিন।
— ভাই, আমার কাছে আর কোনো টাকা নেই।
— হ্যাঁ, খাবারের দোকানে আসলেই টাকা ভাংতি থাকে না, না?
— এই হিটলার, টাকাটা ভাঙিয়ে নিয়ে আয়।
— জী স্যার, যাতিছি।
হিটলার টাকা নিয়ে ভাঙাতে গেলো। পাশে দুটা ছেলে হাসছে, ব্যাটা জার্মান থেকে আবার বাংলাদেশে এসেছো, তারপর আবার চায়ের দোকানে। হিটলার টাকা ভাঙিয়ে নিয়ে এলো। একজন বললো,
— দেখ, চুল কাট দিয়েছে আবার হিটলারের মতোই।
মিজান সাহেব বিল দেয়ার পর টেবিলে এসে বসলো। তারপর এক গ্লাস পানি খেয়ে ছেলেদের জিজ্ঞাসা করলো,
— ভাই, রংপুর যাব কীভাবে? বাস কোথা থেকে ছাড়ে?
— আপনি একটু হেঁটে সামনে যান, দেখবেন রংপুরের বাস ছাড়ছে। ঐ বাসগুলো দ্রুত যায়। মেইল বাস।
— ভাই, ভাড়া কত?
— আশি টাকা।
— লোকাল বাস নেই?
— আছে, ওগুলো ভালো নয়। যেতে অনেক সময় লাগবে। আপনি যেতে পারবেন না।
ছেলেদের কথায় একটু হেঁটে গিয়ে বাসের টিকিট কেটে মিজান সাহেব বাসের সিটে বসে থাকলো। বাস ভর্তি হলে একসময় বাস ছেড়ে দিল।
মিজান সাহেব বেশ খারাপ অনুভব করতে লাগলো। ঘুম নেই তারপর তিন দিন প্রেসারের ওষুধ খাওয়া নেই। একসময় বাস থেকে নেমে বগুড়ার একটি বাসে উঠলো সে। লোকাল বাস ধীরগতিতে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে চলতে লাগলো। মিজান সাহেব দুইবার বমি করলে শরীর নিস্তেজ হয়ে যায়। বাস যখন বগুড়া পৌছালো ততক্ষণে তার স্ট্রোক করেছে। বাসস্ট্যান্ডে থামলে, সবাই নামলেও মিজান সাহেব বাস থেকে নামে না। হেলপার এসে বলে,
— এই যে, চাচা নামেন।
মিজান সাহেবের মাথাটা সিটের উপর থেকে নিচে পড়ে যায়।
তারপর তাকে ধরাধরি করে একটা রিকশায় তুলে দিয়ে বলে হাসপাতালে নিয়ে যা। মানুষের এমন বিপদে কোনো ভদ্রলোক বা সামর্থ্যবান কেউ কাছে আসে না। কিন্তু রিকশাওয়ালাএ ঠিকই তার দায়িত্ব পালন করে। রিকশাওয়ালা ধরাধরি করে তাকে হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেল। ডাক্তার এসে পালস দেখে বললেন— মারা গেছে। রিকশাওয়ালা তাকে রেখে চলে আসে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার প্যান্টের পকেটে থাকা মানিব্যাগ থেকে বিভিন্ন ভিজিটিং কার্ডের টেলিফোনে ফোন করে তার অফিসে খবর দেয়। অফিস থেকে তার বাসায় জানায়। তার আত্মীয়স্বজন ছুটে গিয়ে একসময় তার লাশ ঢাকায় নিয়ে এলো।
প্রিয়তমার চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। তার লাল চোখে আজ সাগরের পানি, শেষ হবে না কোনো দিনই। বুকে নদীর ঢেউ, দেখবে না কেউ। মনে পড়ে মানুষটার প্রতি অনিচ্ছাকৃত কত…!
আরও পড়ুন প্রিয়তমার লাল চোখ-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
প্রিয়তমার লাল চোখ (শেষ পর্ব)