প্রতীক্ষিত বৃষ্টি
প্রতীক্ষিত বৃষ্টি
শাহানাজ মিজান
আকাশে মেঘ জমতে শুরু করলে ময়ূরী যেমন পেখম মেলে নাচে, মিনুর মনটাও তেমন করে নেচে ওঠে। এক দৌড়ে ছাদে চলে যায়। মেঘকালো লম্বা চুলগুলো বাতাসে উড়তে থাকে। সেই সাথে শাড়ির আঁচল। মিনু আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেয়। এরপর নাচতে-নাচতে, গাইতে-গাইতে ফুলের টবগুলো এক সাথে করে। বৃষ্টিতে ভিজে, আবার সবকিছু ঠিকঠাক করে রেখে নিজের রুমে আসে। এটা ওর মা একদম পছন্দ করেন না। কিন্তু ওর বাবা মেয়ের এই আনন্দে, নিজে খুব আনন্দিত হন। তাঁদের দুই মেয়ের মধ্যে মিনু বড়। মিনুকে তিনি একটু বেশিই ভালোবাসেন।
ছয়তলা বাড়িটা ওদের নিজেদের। মিনু ছাদে হাটতে খুব পছন্দ করে। তাই ওর বাবা ছয় তলাতেই থাকেন। বাকি ফ্লাটগুলো ভাড়া দেয়া।
মিনু আজও তার ব্যতিক্রম করল না। আজও আকাশে মেঘ জমতে দেখেই দৌড়ে চলে গেল। যথারীতি তার সব ইচ্ছে পূরণ হল। কিন্তু আজ একটু বিপত্তি ঘটল। সবকিছু ঠিকঠাক করে রেখে নেমে আসবে, এমন সময় হঠাৎ চোখ পড়ল, একটা ছেলেও ভেজা অবস্থায় এক মনে মিনুর দিকে তাকিয়ে দাড়িয়ে আছে। মিনু একটু লজ্জা পেল। কিন্তু কিছু না বলেই ছাদ থেকে নেমে এল।
কয়েকদিন পর, বিকেলে ছাদে গিয়ে আবার ঐ ছেলেটির সাথে দেখা হল। বই পড়ছিল। মিনু নেমে আসতে উদ্যত হলে ছেলেটি পেছন থেকে ডাকল। এই যে শুনুন, আমি অপূর্ব। আপনাদের পাশের ফ্লাটে থাকি। কিছু মনে না করলে, আপনার নামটা জানতে পারি?
মিনু: আমার নাম মিনু।
অপূর্ব: ওয়াও, নাইচ নেম। আপনি কি করেন?
মিনু: জ্বী এখনো কিছু করি না। ইকোনমিক্সে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ছি।
অপূর্ব: এক্সিলেন্ট। যদি কিছু মনে না করেন, আমি আপনার সাথে একটু কথা বলতে চাই। আসলে আমার বাবা-মা, ভাই-বোন বেশ কয়েক বছর ধরেই আপনাদের এই বাড়িতেই থাকছে। আমি বাইরে ছিলাম, আজ কয়েকদিন হলো এসেছি। এখানে আমার সাথে কথা বলার মতো কেউ নেই। যদি আমরা একটু ওপাশে দাড়াই…. মানে….আপনার যদি আপত্তি না থাকে আর কি…..
আরও পড়ুন গল্প সোনালী সকাল
মিনু: জ্বী। আনটির কাছে আপনার কথা শুনেছিলাম। বলুন, কি বলবেন?
অপূর্ব: আমি আসলে বিশেষ ভণিতায় কথা বলতে পারি না। আপনাকে সেদিন বৃষ্টিতে ভিজতে দেখে ভীষণ ভালো লাগল। বৃষ্টি আমারও খুব পছন্দ।
মিনু: ওহ, আসলে আমি আপনাকে খেয়াল করিনি…..
অপূর্ব: আই এ্যাম ভেরি লাকি, আপনি আমাকে খেয়াল করেননি। নইলে প্রকৃতির এই অপূর্ব দৃশ্য দেখা মিস হয়ে যেত। চঞ্চলা হরিণী নয়না এক ময়ূরী পেখম মেলে নাচছিলো, সেটা দেখতে পেতাম না।
মিনু: (লজ্জা পেল) আমি আসলে মনের আনন্দে সব ভুলে গিয়েছিলাম…..
অপূর্ব: আমি একটা ব্যাপার খেয়াল করেছি যে আপনি মনের আনন্দেই যখন নাচছিলেন, তখন আপনার চোখের পানি আর বৃষ্টির পানি একাকার হয়ে গিয়েছিল। কেন জানতে পারি?
মিনুর চোখ ছলছল করে উঠল। মুখে মুচকি হেসে বলল, ওটা এমনি।
অপূর্ব: জানেন, এই ব্যাপারটা আমায় খুব ভাবিয়েছে যে এতো সুন্দরী একটি মেয়ে এভাবে কাদবে কেন?
মিনু: (আকাশের দিকে তাকিয়ে ) কালো মেয়েরা আবার সুন্দর হয় নাকি?
অপূর্ব: (একটু ভেবে) হুম এখন সবটাই বুঝলাম। আচ্ছা আপনি একটা সত্যি কথা আমাকে বলবেন? ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে কখনো অসুন্দর মনে হয়েছে আপনার?
মিনু: (মাথা নীচু করে) না।
অপূর্ব: তাহলে? আল্লাহ্ নিজ হাতে মানুষ সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীতে কোনো মানুষই অসুন্দর নয়।
মিনু: এটা আপনার উদারতা, মহানুভবতা। কিন্তু আপনাদের সমাজের তথাকথিত রুচিশীল ভদ্র লোকেরা যখন বিয়ের পাত্রী দেখতে এসে কালো মেয়েদের রিজেক্ট করে দিয়ে যায়, তখন নিজের কাছে নিজেকেই অতি তুচ্ছ মনে হয়।
অপূর্ব: যারা গায়ের রঙটাকে বড় দোষ হিসেবে দেখে, আমি তো বলবো, তাদের রুচিবোধ বলে সত্যিই কিছু নেই। আছে শুধু নোংরা দৃষ্টিভঙ্গি আর অসুস্থ মানসিকতা।
মিনু: সে আপনি যাই বলুন না কেন। কালো মেয়েদের নিয়ে গল্প, উপন্যাস লেখা হয়। তাদের চোখের গভীরতা, চিরল দাতের হাসি, দীঘল কালো চুল ইত্যাদি উপমায় কবিতা লেখা হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো কালো মেয়েদের প্রতি পদে পদে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয় যে তারা সমাজের অবাঞ্চিত আবর্জনা।
অপূর্ব কিছু বলার আগেই মিনু চোখের পানি মুছতে মুছতে দৌড়ে নিচে চলে গেল।
আরও পড়ুন গল্প নীরুর মা
কলিং বেলটা বেজে উঠল। মিনুর বাবা দরজা খুলতেই, অপূর্ব সালাম দিয়ে ওর বাবা মা কে সাথে নিয়ে ঢুকলো।
মিনুর বাবা মা হাসিমুখে উনাদের বসতে দিলেন।
অপূর্বর মা: ভাই সাহেব, আমরা আপনাদের কাছে মিনু মা কে চাইতে এসেছি।
মিনুর বাবার চোখে আনন্দশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
অপূর্বর বাবা: ভাই সাহেব, আমার ছেলে সম্বন্ধে সবই তো আপনাদের বলেছিলাম। এবার নিজের চোখেই দেখে নেন, জামাই পছন্দ হয় কি না। আসলে আমার ছেলেটা মিনু মাকে প্রথম দেখেই পছন্দ করেছে। কিন্তু মিনু একথা বিশ্বাস করবে না, তাই একেবারে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলাম।
মিনুর বাবা: কি করে বিশ্বাস করবে বলুন? মেয়েটার গায়ের রঙ কালো বলে কতবার বিয়ে ভেঙ্গে গেছে। কতবার তাচ্ছিল্যের শিকার হতে হয়েছে। অপমানিত হতে হয়েছে। ওকে দেখতে এসে ছোট মেয়েটাকে পছন্দ করে যেত। শেষমেশ ছোটটাকে বিয়ে দিয়ে দিলাম। মেয়েটা আমার সারাক্ষণ হিনমন্যতায় ভুগেছে। আপনারা তো সবই জানেন। আর আজ এমন সুদর্শন সুশিক্ষিত ছেলে আমার মিনু মাকে পছন্দ করেছে, বিয়ে করতে চায়। এ যে আমাদের সৌভাগ্য ভাই সাহব। (হঠাৎ অপূর্বর হাত ধরে) বাবা অপূর্ব, তুমি দ্বিধাগ্রস্ত নও তো?
অপূর্ব: না আঙ্কেল। সর্বগুণ সম্পন্না একজন ভালো মনের মানুষকে আমি ভালোবেসেছি। আমার ভালোবাসা দ্বিধাহীন। তাইতো সরাসরি আপনাদের বাসায় চলে এলাম।
মিনু এতক্ষণ দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে সব শুনছে। অপূর্বর চোখে চোখ পরতেই লজ্জা পেয়ে দৌড়ে ছাদে চলে গেল। অপূর্বও গেল। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। মিনু চোখ বন্ধ করে আছে। বৃষ্টির ফোটা পড়ছে চোখের পাতায়। পেছন থেকে অপূর্ব মিনুর কাধে হাত রাখলো। মিনুর মুখ লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল। দুজনেই আকাশের দিকে তাকিয়ে জোরে শ্বাস নিল। তখন এলোমেলো বাতাসে উড়ছে মিনুর দীঘল কালো চুল আর শাড়ির আচঁল।
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
প্রতীক্ষিত বৃষ্টি