পাশের বাড়ির আপনজন
পাশের বাড়ির আপনজন
তাহমিনা খাতুন
আমাদের ছোট পাড়াটিতে আমরা এবং আমাদের কয়েক জন ঘনিষ্ট আত্মীয়ের বসতি ছিল। আমার আপন চাচা আমাদের পাড়া থেকে সামান্য দূরে বাড়ি করে বসবাস করতেন। চাচারও ছিল আব্বার মত গাছ লাগানোর অভ্যাস। খুব গোছালো সংসারী মানুষ ছিলেন তিনি। ওনার হাতে সব সময় একটা কাস্তে বা নিড়ানি দেখা যেত, যা দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতেন বা গাছ লাগাতেন। চাচীমাও খুব সৌখিন মানুষ ছিলেন। বাড়ি-ঘর সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতেন। চাচিমা ছিলেন সদা হাস্যোজ্জল! ফুলের গাছ লাগানো, হাঁস মুরগী,কবুতর পোষা ইত্যাদি ছিল চাচীমার সখ। অতিথি আপ্যায়নেও চাচীমা ছিলেন অত্যন্ত আন্তরিক। যে সময়ে মেয়েদের লেখাপড়ার চর্চা করার কোন সুযোগই ছিল না, সেই সময়েই চাচীমা লেখাপড়া শিখেছিলেন। ওনাকে বই পড়তে এবং চিঠি-পত্র লিখতে দেখতাম! অনেক বছর আগে প্রাণবন্ত মানুষটি পরিণত বয়স হওয়ার অনেক আগেই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন!
আমার আব্বার আপন চাচাতো ভাই খন্দকার আব্দুর রশিদ ছিলেন আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী। ছোট কাকার ছিল চার মেয়ে। পঞ্চম সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে চাচীমা মারা যান। মাতৃহীন চার শিশুকে লালন পালন করেন তাদের দাদী। কয়েক বছর পর ছোট কাকা আবার বিয়ে করেন। উনি পুরনো বাড়ি ছেড়ে নতুন বাড়ি করে অন্যত্র চলে গেলে ওনার বড় ভাই খন্দকার আব্দুর রহমান আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী হন! উনি পুলিশ বিভাগে চাকুরী করতেন। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, সেজ কাকা আমাদের পাশে বসবাস শুরু করার কিছুদিন পরেই সেজ চাচীমাও সাতটি নাবালক শিশুকে অকূলে ভাসিয়ে অষ্টম সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান!
এছাড়া পাড়াটিতে বাস করতেন বড় ফুফুমা (আব্বার আপন ফুফাতো বোন), ছোট ফুফুমা (আব্বার আপন বোন) এবং দুই ফুফুর আপন দেবর। বড় ফুফা, ছোট ফুফা এবং ওনাদের ছোট ভাই-তিন জনই অল্প বয়সেই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পরলোকের বাসিন্দা হয়েছিলেন আমার জন্মের বহু আগেই।
আরও পড়ুন গল্প একজন অনন্যা
বড় ফুফুমা ছিলেন লম্বা, ফর্সা, অসম্ভব সুন্দরী। তিনি ছিলেন অসম্ভব ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন একজন মানুষ! অল্প বয়সে পাঁচটি ছেলেমেয়ে নিয়ে বিধবা হন। ফুফা মারা যাওয়ার সময় ফুফুমা গর্ভবতী ছিলেন। ওনার ছোট ছেলের জন্ম হয়েছিল ফুফা মারা যাওয়ার পর। জমি জমার বিলি ব্যবস্থা, এতোগুলি ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করার কঠিন কাজটি একা সম্পন্ন করেছেন! সে যুগে যখন মেয়েদের লেখাপড়া করার সুযোগ ছিল না, সে সময়েও ওনাকে দেখতাম গল্পের বই পড়তে! বড় ফুফুমার বাবার বাড়ি ছিল বর্তমানের রাজবাড়ি জেলার পাংশায়। উনি ছিলেন সে সময়ের প্রখ্যাত সাহিত্যিক ইয়াকুব আলী চৌধুরীর বোন। বড় ফুফু দ্বারিয়াপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন না। বেশীর ভাগ সময়ই ঢাকায় ছেলে মেয়েদের কাছে থাকতেন। যতদিন গ্রামে থাকতেন, ওনার ছেলেমেয়েরাও প্রায়ই আসতেন। ওনারা গ্রামে এলে পাড়ায় একটা উৎসবের আমেজ তৈরি হত। ওনাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে যারা আমার সমবয়সী ছিল তারা হত আমার খেলার সাথী।
বড়ফুফুমার বড় মেয়ে মাজেদা খাতুন বানীকে আমরা ডাকতাম বড় বু’ বলে। বড় বু’ বানী তাঁর নামের স্বার্থকতা রেখেছিলেন! গ্রামের প্রাইমারী স্কুল পাশ বড় বু নিজ চেষ্টা আর মেধার জোরে হয়ে উঠেছিলেন দেশের একজন প্রথিতযশা সাহিত্যিক এবং সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি স্বরুপ পাক্ষিক ‘অনন্যা’, ‘বেগম’ পুরস্কার সহ বেশ কিছু পুরস্কারও পেয়েছিলেন! এত বছর পরেও বড় বু’র তাৎক্ষণিক সাহিত্য কর্মের একটি উদাহরণ দেওয়া হয়তো খুব বেশী অপ্রাসঙ্গিক হবে না। আমি তখন হয়তো দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি। আমাদের চাচাতো বোন হেলেন বু’র বিয়ের আয়োজন চলছিল।
আরও পড়ুন গল্প লালু
আমাদের ছোট বেলায় দেখেছি কোন মেয়ের বিয়ের আয়োজন হলে কনের ছোট ভাই বোনেরা এবং চাচাতো, ফুফাতো, মামাতো, ভাই বোনেরা সবাই মিলে হবু বর কনেকে উদ্দেশ্য করে ঠাট্টাচ্ছলে অথবা তাদের সুন্দর ভবিষ্যত জীবন কামনা করে কবিতার ছন্দে শুভকামনা জানাতো, যার শিরোনাম দেওয়া হতো ‘প্রীতি উপহার’। বহু অধ্যবসায়ের মাধ্যমে সেই প্রীতি উপহার খানি বর ও বর যাত্রীদের সামনে ভরা মজলিশে পাঠ করা হত। কিন্তু অন্তমিলের সে কবিতা লেখা সহজ সাধ্য ব্যাপার ছিল না। বিশেষত অল্প বয়সী বালক বালিকার পক্ষে। বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে আমরা দেখেছি, আমাদের অগ্রজরা আগে সংঘটিত হওয়া বিভিন্ন বিয়ের কনের ‘প্রীতি উপহারের’ সন্ধান করতেন এবং সংগৃহীত প্রীতি উপহার থেকে লাইন অদল বদল করে কিছু একটা দাঁড় করানোর চেষ্টা চালাতেন! আমাদের বড়বোনেরা হেলেন বু’র বিয়েতে প্রীতি উপহার লেখার জন্য উদ্বিগ্ন! ঠিক সেই সময়ে ত্রাতা হিসাবে আবির্ভূত হলেন আমাদের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ফুফাত বোন বড় বু বানী!
ঢাকা থেকে সেদিনই বড় বু দ্বারিয়াপুর পৌঁছেছেন। আমাদের বড় বোনদের দুই তিন জন বড় বু’র কাছে ধর্না দিলেন। বড় বু’ তাৎক্ষণিকভাবে একখানি চমৎকার প্রীতি উপহার লিখে দিলেন। বড় বু’র বড় মেয়ে উষা খালা সম্ভবত উনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। উষা খালা রীতি মত রিহার্সালের মাধ্যমে আমাকে সেই প্রীতি উপহার খানি ভরা মজলিসে পড়ার মত দুঃসাহসী কাজটি করার উপযোগী করে তৈরি করলেন। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হওয়ার পর আমার মত পাঁচ ছয় বছরের এক ক্ষুদ্র গ্রাম্য বালিকা অসীম সাহস সঞ্চয় করে সেই বহু মূল্যবান প্রীতি উপহারখানি বর ও বর যাত্রীদের সামনে উপস্থাপন করলাম।
এই দুঃসাহসিক কর্ম সম্পাদনের জন্য বেশ হাত তালি পাওয়া গেল! গর্বে ‘মাটিতে পা পড়ে না অবস্থা’ আর কি! আমাদের ছেলে বেলায় বিয়ের অনুষ্ঠানে মেয়েদের আনন্দ করার আর একটা অনুসঙ্গ ছিল বেশ মজার। তা হলো উঠানে বালতি বালতি পানি ঢেলে কাদা করে মেয়েরা একজন আর একজনকে ধরে এনে কাদায় মাখামাখি করে দিত!
আরও পড়ুন সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা
বড় ফুফুমার মেজ মেয়ে রানী যাঁকে আমরা ভাই বোনেরা মেজ বু’ বলতাম, যখনই দ্বারিয়াপুরে আসতেন , সাথে নিয়ে আসতেন গ্রামোফোন। আমরা ছোটরা সেই আজব যন্ত্রখানার সামনে ভীড় জমাতাম গান বা নাটক যাই হোক না কেন শোনার জন্য। অবাক হয়ে ভাবতাম একটা যন্ত্রের মধ্য থেকে কিভাবে শব্দ বের হয়! আমাদেরকে আরও বেশী বিস্মিত করতো, গ্রামোফোন যন্ত্রটির উপরের ‘হিজ মাস্টারস্ ভয়েসের’ কুকুরের ছবিটি! আমাদের ধারণা ছিল কুকুরটিই হয়তো এত সব কিছু করে!
একবার এই গ্রামোফোনকে ঘিরে ঘটলো এক মজার কাণ্ড! পাড়ার এক জামাই এসেছেন শ্বশুর বাড়ি। ইসলামে গান শোনা নিষেধ-এই ধারণা থেকে গ্রামোফোনে গানের আওয়াজ শুনেই উনি রীতিমত দৌড়ে শ্বশুর বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলেন। মেজ বু’ দ্বারিয়াপুরে থাকাকালীন সময়ে তিনি আর শ্বশুর বাড়ি মুখো হন নি!
ছোট ফুফুমা ছিলেন আমার আপন ফুফু। ছোট খাট গড়নের ছোট ফুফুমা। ফরসা গায়ের রঙ। মাথার দীর্ঘ চুল হাঁটু ছাড়িয়ে নেমে যেত। তিনটি ছেলে মেয়ে নিয়ে অল্প বয়সে বিধবা হয়েছিলেন। ফুফুর একমাত্র ছেলে কাজী মাহবুব হোসেন দুলাল ওনাকে আমরা মেজ ভাই ডাকতাম, বড় মেয়ে ননী, ওনাকে আমরা লাল বু’ এবং সবার ছোট ছিলেন শান্তি, ওনার গায়ের রঙ ছিল যাকে বলে দুধে আলতা-আমরা ওনাকে দুদু বু’ ডাকতাম। ছোটদের অসম্ভব আদর করতেন দুদু বু’। ছোটদের নিয়ে চড়ুই ভাতি খেলতেন, হাতে মেহেদী লাগিয়ে দিতেন।
আরও পড়ুন গল্প বড় বাবা
এমন একজন ভাল মানুষ দুদু বু’ প্রথম সন্তান সম্ভবা থাকাকালীন অবস্থায় হার্ট এ্যাটাকে মারা যান! দুদু বু’র হৃদয়হীন, পাষণ্ড স্বামী উনি মারা যাওয়ার মাত্র তিন দিন পরেই ২য় বিয়ে করে নতুন বৌ নিয়ে পুরনো শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে আসেন! নিষ্ঠুর লোকটির আচরণে স্তম্ভিত সবাই! দুলাল মেজভাই যিনি বোনদেরকে অসম্ভব ভালবাসতেন- সে আঘাত সহ্য করতে না পেরে চেতনা হারিয়ে ফেলেন। ছোট ফুফুমার বাড়িতে নতুন করে শোকের ছায়া নেমে আসে! শুধু মাত্র নিষ্ঠুর আচরণ করেই ক্ষান্ত হয়নি লোকটি, কিছুদিন পরে মৃত স্ত্রীর সম্পত্তির অংশ দাবী করে নির্লজ্জ, লোভী লোকটি! মানুষ কতটা হৃদয়হীন, লোভী, পাষণ্ড হতে পারে-এ ঘটনা তারই প্রমাণ।
আমাদের পাড়ায় উল্লেখ করার মত আরেকজন মানুষ ছিলেন বড় ফুফু ও ছোট ফুফুর দেবরের স্ত্রী। ওনাকে আমরা ছোট চাচীমা বলে ডাকতাম। অসম্ভব ভাল মনের একজন মানুষ ছিলেন। অত্যন্ত অল্প বয়সে দুটি শিশু পুত্রকে নিয়ে বিধবা হন এবং স্বামীর বাড়িতেই অবস্থান করেন। ছোট চাচীমার ঘর ছিল আমাদের জন্য অবারিত। তিনি ছিলেন অত্যন্ত রন্ধন পটিয়সী! আমার শৈশবে দেখেছি, পাড়ায় কোন মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে নতুন বরের জন্য বেশ কয়েকটি বিশেষ পদ রান্না হত, আর সেই বিশেষ রান্নার জন্য ছোট চাচীমার ডাক পড়তো। নিজের কাজ ফেলে রেখে চাচীমা সেসব রান্নার দায়িত্ব হাসিমুখে সম্পাদন করতেন!
এঁরা ছাড়াও আরও দুই একটি পরিবারের বসবাস ছিল ছোট্ট পাড়াটিতে। পাড়ার বাইরের কয়েকজন আন্তরিকতাপূ্র্ণ মানুষের মধ্যে ছিলেন ক্ষনা বু’, বেলী বু’ আর নূরী বু’। ওনারা আমার যথেষ্ট বয়ঃজ্যেষ্ঠ ছিলেন। ওনাদের ছেলেমেয়েরা ছিল আমার খেলার সাথী।
আরও পড়ুন যাপিত জীবনের কথকতা-
দ্বারিয়াপুর গ্রাম
আত্রাই নদী
আমার বাবা
আমার মা
ভাই-বোনদের কথা
আমার শিক্ষাজীবন
একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলো
যেভাবে আইনজীবী হলাম
শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ
সংসার ও আইনজীবী জীবন
আমার নানী
প্রথম শহর দেখা ও প্রথম বিদেশ ভ্রমণ
তৎকালীন গ্রামের চিত্র
ছেলেবেলার ষড়ঋতু
মধুর স্মৃতি
স্নেহশীল কজন
তৎকালীন গ্রামীণ চিকিৎসা ব্যবস্থা
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
পাশের বাড়ির আপনজন