পথভোলা-এক-পথিক-১ম-পর্ব
এ কে আজাদ দুলাল (গল্প),  গল্প,  সাহিত্য

পথভোলা এক পথিক (১ম পর্ব)

পথভোলা এক পথিক (১ম পর্ব)

এ কে আজাদ দুলাল

 

করোনা বিষাদ কাল। সারা বিশ্ব স্থবির। ব্যবসা থেকে আরম্ভ করে সকল প্রকার কর্মকাণ্ড এক কথায় অচল। এর মধ্যে বিনোদনের কথা ভাবাই যায় না। তাই বলতে গেলে গত বছর বাঙালির জীবনের শ্রেষ্ঠ উৎসব পহেলা বৈশাখ এবং ভাষার মাস ফ্রেরুয়ারি যাপন করা সম্ভব হয়নি। এ বছরে যথা সময়ে বইমেলা আয়োজন করা সম্ভবপর হয়নি। তবে সেটা হয়েছে মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে, দু-সপ্তাহের জন্য। এবার একটা উপন্যাস বের হয়েছে। প্রকাশক সাহেব একদিন মোবাইলে কটুকথা শোনালেন।
__আরে ভাই, বই প্রকাশ করে, ঘরে ঘোমটা দিয়ে বসে থাকলে কি বই প্রচার হবে? কাহিনী ভালো দেখে বইটি প্রকাশ করলাম। মেলায় একটু পদধূলি দেন।
__ভাবছি, একদিন আসবো।
__একদিন না, প্রতিদিন আসতে হবে। আগামী বৃহস্পতিবারে বেশ ক’জন কবি-সাহিত্যিক আসবেন। আপনাকেও থাকতে হবে। ভাই মাত্র দুইটা দিন সময় দিলেই চলবে।
কথা না বাড়িয়ে সম্মতি দিলাম। যথারীতি বৃহস্পতিবার বিকেল তিনটের দিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিরাট বই মেলায় গিয়ে হাজির হয়ে দেখি, ও মা একি! আমার প্রকাশকের নির্দিষ্ট স্টলটি ক্লান্ত দুপুরে ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে স্টলগুলো খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। জিজ্ঞেস করতেই বললো,
__স্যার, খুব গরম পড়ছে। তাছাড়া এত দুপুরে দর্শকরা কেউ আসতে চায় না।
দর্শকের কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। যদি বলতো বই ক্রেতাগণ আসতে চায় না! মেলায় আসবে, ঘুরে বেড়াবে, বাড়ির ফেরার পথে মনের মত বই কিনবে; আর আড্ডা তো আছেই। মাঠের মাঝখানে পানি ভরা বিরাট দীঘি। আমার কাছে দীঘি মনে হল।

আরও পড়ুন গল্প হাইয়া আলাল ফালাহ

মনের ভেতরে জেগে উঠলো সেই পুরনো দিনের, জমিদারদের মনের বাসনা চরিতার্থ করার জন্য বাড়ির আশে-পাশে মাঠান জমি বিসর্জন দিয়ে দীঘি খনন করত। এটা তাদের খানদানী গৌরব। তবে এ দীঘি সেই দীঘি নয়। এখানে লুকিয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের উনিশ মিনিটের ভাষণের শব্দাবলী। হয়ত এই দীঘিতে বাতাসের তালে তালে ঢেউ খেলে বেড়াচ্ছে। সেই ৭ মার্চের পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অসাধারণ ভাষণটির শব্দ। কিছু সময় কান পেতে রই। হৃদয়ের ভেতরে দোল দিয়ে ওঠলো “এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

স্বাধীনতা তো আমরা পেয়েছি। কিন্তু মুক্তি কি পেয়েছি? এখনো স্বাধীনতা বিরোধীরা সক্রিয়। সূর্যের তেজ আস্তে আস্তে মিয়্রমান হচ্ছে আর পাঠকদের আনাগোনা বেড়ে চলেছে। মনে মনে স্বস্তিবোধ করলাম। প্রায় আধা ঘণ্টা এদিক-ওদিক ঘুরাঘুরি করে আবার আমার প্রকাশকের স্টলের সামনে আসতেই দেখি, স্টলের ঘোমটা খোলা হয়েছে। যাহোক নিজের পরিচয় দিতেই বিক্রয়কর্মী যুবকটি একগাল হাসি দিয়ে বললো,
__স্যার, ভেতরে এসে বসুন। সন্ধ্যার আগে জমবে না। আপনি আসবেন তা আমরা জানি। আজ আড্ডা ভালোই জমবে।

সাথে নেওয়া ক’খানা বই যুবকটি কাছে রাখতে দিয়ে, স্টলের এক কোণে একটা চেয়ারে বসলাম। কিছু সময় পর আর একজন সহযোগী বিক্রয়কর্মী এসে হাজির। ইতোমধ্যে মেলা জমে উঠেছে। সব বয়সের নারী-পুরুষের সমাগম বেড়ে চলছে। মানুষ করোনাকে উপেক্ষা করে ঘরের বাইরে বের হয়েছে। আর কতকাল। বসে বসে চিন্তার সাগরে ডুব দিয়েছি, এমন সময় আমার প্রকাশক মহোদয় এসে হাজির। আমাকে দেখে খুশি হয়েছেন বলে মনে হল। এমনতেই কম কথা বলেন। আবার শুরু করলে দাঁড়ি-কমা বাদ যায় না। কোন দিনই শুদ্ধ বাংলায় কথা বলেন না। শুনতে কিন্তু মজাই লাগে। তবে সংস্কৃতি মনা এবং লেখক ভক্ত। লেখা পড়া জানেন এবং নিয়মিত বই পড়েন। শুধু তাই নয় যে বই পড়েন তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করেন।
__শামীম, স্যারকে চা দাও তো বাবা। সঙ্গে আমার এককাপ।

আরও পড়ুন গল্প একজন অনন্যা

সন্ধ্যার আর বেশি বাকি নেই। দেখতে দেখতে আরও তিন-চার জন কবি-সাহিত্যিক এসে হাজির। পরিচয় করিয়ে দিলেন আমাদের সুপ্রিয় প্রকাশক। ভাগ্য ভালো পাঁচ খানা বই সাথে ছিল। সবাইকে সৌজন্য কপি দিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করলাম। বিরাট কিছু জয় করে মনে মনে তৃপ্তির হাসি হাসলাম। কেননা এঁরা আমার চেয়ে দামী এবং পরিচিত কবি-সাহিত্যিক। আড্ডা জমে উঠেছে। বই বিক্রি হচ্ছে। সম্মানিত ক্রেতাগণ অটোগ্রাফ নিচ্ছেন। গর্বিত হচ্ছি। সারা বইমেলায় আলোয় আলোকিত। দলবেঁধে তরুণ-তরুণী ঘুরে বেড়াচ্ছে। আলাদা একটা আমেজ। বাঙালি আড্ডা দিতে জানে, আবার উল্টোটা করতেও জানে। এটা বাঙালির চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। প্রকাশক তো ভারী খুশি। মুখখানা পাঁচ টাকার সিলভার মুদ্রার মত চকচক করছে। আমি খুশি এই ভেবে বই বিক্রির সাথে সাথে সব শ্রেণির ক্রেতাদের বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের অটোগ্রাফ দিতে পেরে। হঠাৎ ঊনিশ-বিশ বছরের বয়সী একজন যুবতী মেয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বললো,
__আপনি হাফিজ আকাশ?
__জি।
__আপনার উপন্যাস বেশ চলছে। তবে আমার কেনা হয়নি।
স্টল দেখিয়ে দিলাম। মেয়েটি দেরি না করে বইখানা কিনে আবার আমার সামনে এসে দাঁড়ালো,
__প্লিজ,আপনার অটোগ্রাফ।
এবার মেয়েটির মুখে দিকে নজর দিলাম। ভারী মিষ্টি চেহারা। মায়াভরা মুখখানি। চোখের চাহনির ভেতরে রয়েছে মিনতি ভরা আবেগ। তবে সে আবেগে রয়েছে মানুষের কাছ হতে ভালোবাসা পাওয়ার। যে কোন বয়সের মানুষ ওর দিকে খারাপ নজরে দৃষ্টিপাত করবে না। আমার মেয়ের বয়সী হবে হয়ত।

আরও পড়ুন গল্প সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা

একটু মজা করে বললাম,
__কি লিখতে হবে?
মেয়েটি বেশ উৎসাহের সাথে বললো,
__আমি যা বলবো, তাই তো লেখবেন?
একটু ভাবলাম। কি আর এমন বলবে। অন্যরা যা বলেছে হয়ত তাই বলবে। না হয় কবিতার একটা লাইন।
__বলো।
__ঠিক তো? “আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি।”
শুনে একটু থতমত খেয়ে গেলাম। রবীন্দ্রনাথ তার মুখস্থ। হয়ত তো কারো উপহার দিবে।
__স্যার, কথা দিয়েছেন।
কথা না বাড়িয়ে তার কথা মত সুন্দর হস্তলিপিতে লেখে দিলাম। এর আগে কাউকে এত সুন্দর ঝকমক লেখায় অটোগ্রাফ দেয়া হয়নি। আত্মতৃপ্তিতে মনটা ভরে গেল। মনের ভেতরে একটা প্রশ্ন বেজে চলেছে। এত শব্দ থাকতে “আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি।”এটা লেখিয়ে নিল। কারণ কি? কেমন কথা হল। কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শুধু ধন্যবাদ বলে চলে গেল। নাহ, এর রহস্য উদঘাটন করতেই হবে। একটা গল্প তো চাই। হাতছাড়া করা যাবে না। সন্তর্পণে তার পিছু নিলাম।

মেয়েটি অতিদ্রুত হেঁটে চলেছে আমিও চলার গতি বাড়িয়ে দিলাম। অবশেষে মেয়েটি পুকুর পাড়ে শান বাঁধানো একটা ব্রেঞ্চিতে বসা একজন মধ্যম বয়সী মহিলার হাতে বইখানা তুলে দিল। মহিলা পরম যত্নে বইখানা হাতে নিয়ে একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টোপাল্টা করে দেখছে, আর মেয়েটির সঙ্গে কি যেন বলছে। মেয়েটি হাসি মুখে জবাব দিচ্ছে। মনে হলো অটোগ্রাপটা বার বার মনোযোগ সহকারে দেখছে। মহিলা যে মেয়েটির মা, এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। তাহলে কি মহিলার শিখিয়ে দেওয়া গানের কলি?

আরও পড়ুন গল্প ও রিহানা

লাইট পোস্টের আলো দীঘির পানির ওপরে ছড়িয়ে পড়েছে। অপূর্ব শান্ত দেখাচ্ছে। আবার সেই লাইট পোস্টের আলো মহিলার মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়েছে যেন দীঘির পানির মতই শান্ত। মহিলার যৌবনকালে মেয়েটির মত চেহারা-সুরুত ছিলো এতে কোন সন্দেহ নেই। ছিলো মানে এখনো আছে। কিন্তু চেহারার ভেতরে উচ্ছ্বাস একটু কম। বেমানান লাগছে। দেখে মনে হলো মনের ভেতরে পুরানো কোন দুঃখ-কষ্ট জমে আছে। ভাবছি কাছে গিয়ে পরিচয় জানবো কি-না। আবার ভাবছি এটা সৌজন্যবোধের মধ্যে পড়ে না। পাঠক তার ইচ্ছে মত লেখককে দিয়ে অটোগ্রাফ নিতেই পারে। তবুও মনের ভেতরে হাজারো প্রশ্ন, তাই বলে “আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি।” এটা কেমন বাক্য যা আমাকে দিয়ে লিখে নিল। বুঝতে পারছি লেখকের সাথে মজা করছে। আমি মনোমুগ্ধ হয়ে মেয়েটির মিষ্টি কথায় তার পছন্দের বাক্যগুলো গদ গদ করে লেখে দিয়ে এখন তাদের পিছনে গোয়েন্দাগিরি করছি। এটা আমার পক্ষে শোভনীয় কর্ম নয়। ফিরে যাই স্টলে।

মহিলার সাথে বার-তের বছরের একটা ছেলে। উঠে দাঁড়াল। লাইট পোস্টের আলোতে চেহারা আরো পরিস্কার দেখাচ্ছে। আসলেই মহিলার চেহারা এককালে তার মেয়ের আদলেই ছিল, এতে কোনো সন্দেহ নেই। হঠাৎ নজরে পড়লো মহিলার ঠোঁটের দিকে। পরিস্কার দেখা যাচ্ছে নিচের ঠোঁটের ডান দিকে কাটা দাগ। নিমিষে মন হাওয়ায় উড়ে গেলো আজ থেকে ত্রিশ বছর আগের ফেলে আসা ঘটনার করতলে। শ্যামলী নাসরিন মানে শ্যামলী নামের পনের বছর বয়সী এসএসসি পরীক্ষার্থী, সেই মেয়েটির কথা। এখন বধু হতে মাতা-গৃহিণী। তার সঙ্গে দুটো বাচ্চা। মেয়েটি ঠিক তার মতন শারীরিক গঠন। বাগানের সেই ফুল,ফুলদানিতে যত্ন করে রাখার মত।

আরও পড়ুন পথভোলা এক পথিক-
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
শেষ পর্ব

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

পথভোলা এক পথিক (১ম পর্ব)

Facebook Comments Box

এ কে আজাদ দুলাল মূলত একজন গল্পকার। এছড়াও তিনি কবিতা ও উপন্যাস লিখছেন। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: বিবর্ণ সন্ধ্যা, তুমি রবে নীরবে; উপন্যাস: জোছনায় ভেজা বর্ষা। তিনি ১৯৫১ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালী ইউনিয়নের নুরুদ্দীনপুর গ্রাম তাঁর পৈতৃক নিবাস ।

error: Content is protected !!