পক্ষিরাজের-ডানা-১ম-পর্ব
গল্প,  বিল,  সাইফুর রহমান,  সাহিত্য,  সুজানগর উপজেলা

পক্ষিরাজের ডানা (১ম পর্ব)

পক্ষিরাজের ডানা (১ম পর্ব)

সাইফুর রহমান

 

চৈত্র মাস প্রায় শেষের দিকে। সুজানগরের গাজনার বিলের বিস্তীর্ণ নাবাল অঞ্চল এ সময়টাতে সাহারা মরুভূমির মত শুষ্ক ও উষ্ণ। অথচ ভরা বর্ষায় এই গাজনা বিলের প্রমত্ত উত্তাল ঢেউ ও জলরাশি দেখে কেউ হয়তো বিশ্বাসই করতে চাইবে না যে, গ্রীষ্মে এই বিলের কী এক করুণ পরণতি দৃশ্যমান হয়।

যদিও চৈত্র-বৈশাখের খরতাপে অনেক প্রান্তিক কৃষক গভীর নলকূপ গেঁড়ে বোরো ধান জন্মানোর জন্যে সেচ ব্যবস্থাটি চালু রাখেন। কিন্তু তারপরও পেঁয়াজ ও অন্যান্য রবি শষ্যের জমিগুলো বেশিরভাগই বিরান, আবাদহীন ও পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে থাকে বর্ষা নামার পূর্ব পর্যন্ত।

তবে এটা দেখে আশান্বিত হতে হয় যে বিরান এই মরুভূমির মধ্যেও মরুদ্দ্যানের মতো এক টুকরো দ্বীপের অস্তিত্ব রয়েছে সেখানে। ঈষৎ টিলার মতো উঁচু এই দ্বীপটিকে আশেপাশের গ্রামের লোকজন বলে “ঘোড়ার ভিটে”। যতদূর চোখ যায় শুধু ধূ ধূ শুস্ক মাঠ। ব্যতিক্রম শুধু এই ঘোড়ার ভিটে। সবুজ ঘাসের গালিচা পাতা এই দ্বীপটিকে ঘিরে অনুগত ও বিশ্বস্ত সৈনিকের মতো দাঁড়িয়ে আছে বিশ পঁচিশটি বাবলা গাছ। সাথে বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দু’তিনটি বকুল, তাল আর নাম না জানা কতক বৃক্ষ।

আরও পড়ুন দীপ্তিদের দেবতা

গ্রীষ্মের নির্জন দুপুর গুলো বড়ই ফাঁকা। চারিদিক খাঁ খাঁ শূন্য। মাঝে মধ্যে দমকা বাতাস এসে ভিটের শুকনো খড়-কুটো, পেঁয়াজের শুকনো খোসা, সিগারেটের খোলের রূপালি রাঙতা কাগজ সঙ্গে ধূলোবালিগুলো ঘূর্ণির মতো পাক খেতে খেতে উঠে যায় উপরের দিকে।

নিজের পিঠটি একটি বাবলা গাছে ঠেস দিয়ে সেই ঘূর্ণায়মান বাতাসের দিকে নিবিষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে জানে আলম। এই বাতাস জানে আলমের খুব চেনা। প্রচণ্ড তাপদাহে যেদিন গরম হাওয়া পাক খেতে খেতে উপরের দিকে উঠে যায়, বিশেষ করে সেদিন বিকেলে সন্ধ্যা নামার আগে কিংবা রাতে কাল বৈশাখীর ভয়ঙ্কর ঝড় বয়ে যায় তাদের গ্রাগুলোর উপর দিয়ে। তার বেশ ভয় হয়, না জানি ঝড়-জলের কী তাণ্ডব লীলা চলে আজ। ঝড়ের কথা ভেবেই যে শুধু জানে আলমের ভয় হয় তা কিন্তু নয়। কাঠফাটা রোদের নির্জন ও জনমানব শূন্য এই ঘোড়ার ভিটে জায়গাটিতেও তার বেজায় ডর। ঘোড়ার ভিটে নামটিতো আর এমনি এমনি হয়নি। গহীন নিরান্ধ্র অন্ধকার রাতে অলৌকিক সব ঘোড়া নাকি চড়ে বেড়ায় এই ভিটেতে। তখন তাদের খুরের টক-টক…টক-টক… টক-টক শব্দ শোনা যায় বহুদূর থেকে। অনেক প্রত্যক্ষদর্শী অবশ্য দাবি করেছে যে ফুটফুটে জোৎস্না রাতেও নাকি তারা সেখানে দেখেছে ঘোড়াদের অবাধ বিচরণ।

আরও পড়ুন ওরা তেরোজন

কালো-সাদা-লাল-খয়েরী নানা রঙের ঘোড়া। ঘোড়ার ভিটের এসব ভৌতিক ও অলৌকিক ব্যাপার-স্যাপারগুলো অবশ্য গ্রামের দু’চার জন ছাড়া সবাই বিশ্বাস করে। যে দু’চার জন বিশ্বাস করে না তাদের মধ্যে একজন হলেন চরদুলাই বি আর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল কাশেম। জানে আলমের বুঝে আসে না আবুল কাশেম স্যার কেন বিশ্বাস করেন না যে, সেখানে রাতের বেলা নানা রঙের সব ঘোড়ারা চড়ে বেড়ায়, ঘাস খায়। তাদের নিজেদেরও তো চার-পাঁচটি গরু আছে। যে গরুটা সাদা সেটাকে তারা ডাকে ধবলা বলে, যেটা কালো সেটার নাম কালু আর যে গরুটা লাল সেটাকে তাদের পরিবারের সবাই ডাকে লালী বলে। গরুদের মধ্যে যদি সাদা-কালো-লাল থাকতে পারে তাহলে ঘোড়াদের মধ্যেও তো সেরকম থাকবে নিশ্চই।

ঘোড়ার ভিটেতে যখন অন্য কোন রাখাল-বাখালের উৎপাত থাকে না তখন চারদিক বেশ শুনশান ও নিস্তব্ধ। রৌদ্রতপ্ত দুপুরগুলো তাই প্রায়ই উদাস হয়ে ওঠে জানে আলমের। একটু আগেই বাড়ি থেকে নিয়ে আসা মাঝারি সাইজের একটি গামলায় পেঁয়াজ সহযোগে হরিদ্রা রঙের বোরো চালের এক গামলা খিচুরী উদরপূর্তি করেছে সে। জানে আলমের মা জুলেখা বিবি পরম যত্ন করে ফিনফিনে জীর্ণ একটি গামছায় বেঁধে দিয়েছিল খিচুরীর ডিশটি। এক পাশে অল্প একটু সরিষার তেল ও গোটা কয়েক পেঁয়াজ। পেট ভর্তি করে খেয়ে ওঠার পর কেমন জানি আলস্যে ভরে যায় সম্পূর্ণ শরীরটি। নিজের অলক্ষ্যে বেশ কয়েকটি ঢেঁকুর তোলে জানে আলম। চোখ দুটো যেন বুঁজে আসতে চায় নিজেরই অজান্তে।

আরও পড়ুন অন্তর্জাল ও মৃত্যু

হঠাৎ করেই জানে আলম দেখলো দশ-বিশটা ঘোড়া উড়ে বেড়াচ্ছে আকাশে। প্রত্যেকটি ঘোড়ার পিঠেই দুটো করে পাখা। ঠিক যেন একেবারে পক্ষিরাজ ঘোড়ার মত। তারপর একসময় আকাশ থেকে উড়তে উড়তে ঘোড়াগুলো নেমে এলো ভিটেতে। দ্রুত গতিতে উড়ছিল বলে নিজেদের ভারসাম্য রক্ষার জন্য নেমেই সবুজ ঘাসের জমিতে বেশ খানিকটা দৌড়াতে হলো তাদের। কুচকুচে কালো রঙের একটি ঘোড়াতো রীতিমত দৌড়াতে দৌড়াতে চলে এলো একেবারে জানে আলমের মুখের সামনে

_কী, আলম মিয়া এখানে তুমি গরু চড়াচ্ছো! সাহস তো কম নয় হে তোমার। জানো না এটা ঘোড়াদের ভিটে। মানে আমাদের ভিটে। এখানে মানুষের প্রবেশাধিকার একেবারে নিষিদ্ধ।
জানে আলম ভয়ার্ত কণ্ঠে বিপন্নের মতো বলল,
_সেতো রাতের বেলায় তোমরা আসো। তখনতো আর আমরা ভিটের ত্রি-সীমানার মধ্যেও আসিনে কিন্তু এখনতো দিন। দিনের বেলা সব সময়ই তো আমরা গরুগুলেক ঘাস খাওয়াবের নিয়ে আসি এহানে।
_ দিন হোক আর রাত হোক কখনোই আসতে পারবিনা তোরা। তোদের উপস্থিতি আমাদের নির্বিঘ্নে ও অবাধ চলাফেরায় অসুবিধা তৈরি করে।
_ঠিক আছে আর আসবো না কখনো। এইতো এখনই চলে যাচ্ছি।
_এখানে এসে যে ভুল করেছিস, তার খেসারত কে দেবে শুন? এর জন্যে তোকে দণ্ড পেতে হবে।

আরও পড়ুন গল্প জীবনের উপহাস

এসব বলে কালো রঙের ঘোড়াটি মস্ত বড় চোয়াল দুটো হা করে আস্ত মুন্ডুটি যেন গিলে নিতে আসলো জানে আলমের। আর ঠিক তখনই সমস্ত শরীরে ঘাম ছেড়ে মুদিত চোখ দুটো খুলে গেল তার। হঠাৎ জানে আলমের খেয়াল হলো আরে লালী, ধবলা, ভুলু (ভোলা ভোলা চোখ বলে নাম ভুলু) আর একটা এঁড়ে বাছুর ঘোড়ার ভিটেতে ঘাস খাচ্ছে। কিন্তু কালুটাও তো এখানেই ছিল ওটা গেল কোথায়? চারদিকে তাকিয়ে ভালো করে দেখলো জানে আলম আরেকবার। নাহ্ কোথাও তো দেখা যাচ্ছে না। বদমাশটা নিশ্চই পুঁটিগাড়া নয়তো মাসকাটির ভূঁইয়ে গৃহস্থ্য কৃষক ছাদেক মোল্লা যে বীজ তলা তৈরি করেছে সেখানকার কচি কচি সব চারা ধান গাছে মুখ দিয়েছে।

জানে আলম ফিতে হীন তাপ্পিমারা পেন্টুলটি নাভির উপর টানতে টানতে দৌড়াতে লাগলো সেদিকে। মনে মনে যা ভেবেছিল হয়েছে আসলে তা-ই। ঘোড়ার ভিটে থেকে সাত-আটশ গজ দূরে মাসকাটির বীজ তলায় সদ্য গজিয়ে ওঠা টিয়া রঙের চারা গুলো সাবাড় করায় ব্যস্ত কালু।

কালুটা ছোট থেকেই ডানপিটে ও বেপরোয়া। ওটাকে নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সময়ই বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। কত মানুষের ধানক্ষেত, লাউ ক্ষেত, পুঁইয়ের মাচা ও খড়ের গাদা যে সাবাড় করেছে তার কোন লিখাঝোকা নেই। কালুর অত্যাচারেই হয়তো একবার প্রতিবেশিদের মধ্যে কেউ একজন খড়ের সাথে বিষ মিশিয়ে খাইয়ে দেয় কালুকে। তবে জানে আলমের ধারণা, নুরু মণ্ডলই এই কাজটি করে থাকতে পারে। কারণ বিষ খাওয়ার পর কালুর মুখ দিয়ে যখন অজস্র বুদবুদের মতো সাদা ফেনা উঠছিলো তখন নুরু মণ্ডলই প্রথম দৌড়ে এসে বলেছিলো ‘তোয়ারে গরু মনে হয় ভুল কইরে ধুতরা পাতা খাইয়ে ফেলেছে রে আলম। তাড়াতাড়ি হারেন ডাক্তারকে ডাইকে নিয়ে আয়’।

আরও পড়ুন অশরীরী আত্মা

এতো বড় বিপদের মধ্যেও হাসি চেপে রাখতে পারেনি জানে আলম। নুরু মণ্ডলের এতোটুকু জ্ঞানও নেই যে, গরু, গরু হলেও কখনো বিষ জাতীয় কিছু খায় না। কোন কিছু খাওয়ার আগে শোঁক শোঁক করে শুকে নিয়ে তারপর সেটা খায় গরু। জং ধরা মরচে পরা পুরোনো একটা সাইকেলে চেপে রোদের তীব্রতা থেকে বাঁচতে তাল পাতার টোকা মাথায় হারান ডাক্তার এসে হাজির হয়েছিলো অবশ্য। নানা রকম ঔষধপত্র ইনজেক্শন ইত্যাদি করে কালুকে সে যাত্রা সারিয়ে তোলা সম্ভব হয়। গ্রাম গঞ্জে হরহামেশাই প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করে শত্রুতার জের হিসেবে বোবা গৃহপালিত জীবজন্তুদের খাবারের সাথে অনেকে বিষ খাইয়ে তাদের হত্যার চেষ্টা করে।

আবার কখনো-সখনো মাছ ভর্তি পুকুরে গ্যালন-গ্যালন বিষ ঢেলে দেয়। সকালে দেখা যায় পুকুরের সব মাছ মরে ভেসে উঠেছে উপরে। মানুষ কেন যে নিরপরাধ, নির্বাক এই প্রাণীগুলোর সঙ্গে এমন করে, জানে আলমের সেটা মাথায় ধরে না। এ কারণেই বোধ করি গ্রাম্য ডাক্তারগুলোও বেশ অভিজ্ঞ হয়। তাদের জানা থাকে কোন ঔষধ প্রয়োগ করে সাধারণত পশুগুলোকে কোনো মতে বাঁচিয়ে তোলা যায়।

ক্ষুদ্র শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে জানে আলম গরুর দড়িটি জোরে টানতে থাকে-“কালু তোর ভালর জন্যিই কচ্ছি তাড়াতাড়ি বীজ তলাতিন উইটে আয়, সাদেক মোল্লা দেখলি পরে তোর পিটি পাঁচখান লড়ি ভাঙবিনি”।

জানে আলমের হ্যাঁচকা টানে অবশেষে বীজতলা থেকে উঠে আসে কালু। এখন ওখান থেকে না সরে পড়লে সাদেক মোল্লা তার পিঠে লাঠি না ভাঙ্গলেও জানে আলম যে তাকে এতটুকুও খাতির করবে না এতদিনের অভিজ্ঞতা থেকে কালু সেটা ভাল করেই জেনে গেছে।

আরও পড়ুন পক্ষিরাজের ডানা-
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
শেষ পর্ব

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

পক্ষিরাজের ডানা (১ম পর্ব)

Facebook Comments Box

সাইফুর রহমান মূলত একজন গল্পকার। মানবজীবনের বৈপরীত্য ও মনস্তাত্ত্বিক বহুমুখিতা তাঁর লেখার প্রধান উপজীব্য। প্রকাশিত নিবন্ধনগ্রন্থ: জানা বিষয় অজানা কথা, যুক্তি তর্ক ও গল্প, ভিঞ্চির কালো জুতো, করোনায় শেক্সপিয়র রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য; গল্পগ্রন্থ: শরৎচন্দ্রের শরৎ উপাখ্যান ও অন্যান্য গল্প, পক্ষিরাজের ডানা, মরিচপোড়া। তিনি ১৯৭৭ সালের ১২ ডিসেম্বর, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত দুলাই ইউনিয়নের চরদুলাই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!