নেপোলিয়ন বোনাপার্টের দেশে (শেষ পর্ব)
নেপোলিয়ন বোনাপার্টের দেশে (শেষ পর্ব)
তাহমিনা খাতুন
প্যারিসে রয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ল্যুভ মিউজিয়াম। ল্যুভ যেন আর এক বিস্ময়ের নাম! এটি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ জাদুঘর। বিশাল এই জাদুঘর অনেকগুলো বিভাগে বিভক্ত । যেমন চিত্রকলা, মিশরীয় এ্যান্টিক, গ্রীক, রোমান, এট্ট্রুসকান, ইস্টার্ন কালেকশন, ভাস্কর্য , ইসলামিক আর্টস, গ্রাফিক আর্টস ইত্যাদি।
মোনালিসা! বিশেষত মোনালিসার হাসি। বিশ্ববরেণ্যে চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা মোনালিসার হাসি, যে হাসিতে রয়েছে এক দারুন রহস্য! চিত্রকলার ইতিহাসে বিশ্বে সর্বাধিক পরিচিত, সর্বাধিক প্রদর্শিত এক চিত্র কর্ম। শুধু তাই নয়, মোনালিসাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশী লেখা হয়েছে, সবচেয়ে বেশী গান মোনালিসাকে নিয়ে গাওয়া হয়েছে, অনেক বেশী গবেষণা হয়েছে। এমনকি মোনালিসা পুরুষ না নারী চরিত্র তা নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্কও হয়েছে। মোট কথা, মোনালিসা চিত্রকর্ম নিয়ে চিত্রবোদ্ধাদের মধ্যে এবং ইতিহাসবিদদের মধ্যেও এক বিভ্রম তৈরী হয়েছে। দ্য ভিঞ্চির সবচেয়ে প্রিয় চিত্রকর্ম মোনালিসা, যা তিনি সব সময় নিজের কাছে রাখতেন। কে এই মোনালিসা? কেউ বলেন মোনালিসা শিল্পীর নিজের মা, কেউ মনে করেন তাঁর বান্ধবী। অনেকের মতে ইতালির ফ্লোরেন্সের ব্যবসায়ী ফ্রান্সিসকো দ্য গিওকন্ডোর স্ত্রী লিসা গেরাদিনি।
ব্যবসায়ী ফ্রান্সিসকো দ্য ভিঞ্চিকে মোনালিসার এই ছবিটি আঁকতে দিয়েছিলেন। দ্য ভিঞ্চি ১৫০৩-১৫০৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এঁকেছিলেন। তবে ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ছবিটি আঁকা অব্যাহত ছিল! এটি একটি তৈল চিত্র। ছবিটির বর্তমান মূল্য ৮৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার! এছাড়া ছবিটি এক শত মিলিয়ন ডলারে বীমাকৃত! শিল্পী ‘রেনেসাঁ’ যুগে ইতালিতে ছবিটি আঁকা শুরু করেছিলেন। শেষ করলেও ছবিটি তিনি কোন কারণে ব্যবসায়িকে ফেরত দেননি। শিল্পী শেষ পর্যন্ত ছবিটি তাঁর শিক্ষানবিশ ‘সালাইকে’ উইল করে যান। সম্প্রতি কম্পিউটার পরীক্ষায় ‘মোনালিসার’ চেহারার সাথে শিল্পীর নিজের চেহারার আদল খুঁজে পাওয়া গেছে! যত বিভ্রমই থাকুক না কেন, ল্যুভ মিউজিয়ামে ছবিটি বুলেট প্রুফ কাঁচের ফ্রেমে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এবং ‘মোনালিসা’কে কাছে থেকে দেখার জন্য দর্শকরা ধৈর্য ধরে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে!
আরও পড়ুন দুলাইয়ের জমিদার আজিম চৌধুরী
মিউজিয়ামে রয়েছে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার অনেক নিদর্শন। মৃত্যু পরবর্তী জীবনে দুনিয়ার বিলাসী জীবনের যাতে কোন ব্যত্যয় না ঘটে, তার সব আয়োজনই করে রাখা হত। মিশরীয় ফাঁরাও সম্রাট, সম্রাজ্ঞী, সন্তান-সন্ততি, তাদের দাস-দাসী, প্রিয় জীব-জন্তু সব কিছুর মৃত দেহগুলো বিশেষ প্রক্রিয়ায় ‘মমি’ করে বিশেষ কফিনে সংরক্ষণ করা হত। সেই সাথে রাখা হত তাদের বহুমূল্যবান অলঙ্কার, পোষাক, ব্যবহার্য জিনিস পত্র। বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম পিরামিডের নমুনা, অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক সিংহের আকৃতির স্ফিংকসও রাখা হয়েছে প্রদর্শনের জন্য। রয়েছে প্রাচীন গ্রীক, এট্টুসকান, রোমান সভ্যতার অনেক নিদর্শন! সেই সাথে রয়েছে ইসলামিক আর্ট, বিশ্ব বিখ্যাত বিভিন্ন ভাস্কর্য ইত্যাদি।
ল্যুভ মিউজিয়াম দেখতে গিয়ে আমাদের বাংলায় কথা বলতে শুনে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশী আর পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালী এসে আলাপ করলেন। এদের মধ্যে অনেকে ইইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে প্যারিসে বেড়াতে এসেছেন। বিদেশ-বিভুঁইয়ে সহজাত স্বাজাত্য বোধ মানুষের মধ্যে বোধ হয় একটু বেশীই উজ্জীবিত হয়!
Notre-dame-de Paris (নত্রে-দেম দ্য প্যারিস) বা প্যারিস ক্যাথেড্রাল মধ্যযুগের সবচেয়ে বিখ্যাত চার্চ। দুটি প্রাচীন চার্চকে একীভূত করে গ্রীক পুরানের কথিত সূর্য দেবতা জুপিটারের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয় প্যারিস ক্যাথেড্রাল। তৎকালীন নিরক্ষর মানুষদের মধ্যে শিক্ষা এবং জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে এই সব ক্যাথেড্রালগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো।
আরও পড়ুন সুরেন বাবু
প্যারিসের সেইন্ট পিয়েরে মঁ মার্ত ১৩০ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট সুবিশাল এক পাহাড়ি এলাকা। এই পাহাড়ি ভূমিতে রয়েছে বেশ কয়েকটি চার্চ বা গির্জা। এখানকার প্রধান গির্জাটির বাইরের বিশাল চত্বরে দাঁড়ালে চোখে পড়বে অনেক নীচে শহরের অপূর্ব দৃশ্য, বাগান, পর্যটকদের বিনোদনের জন্য ট্রেনে চড়ে পুরো পাহাড় ঘুরে দেখার ব্যবস্থা। এখানে রয়েছে ‘ওয়াল অব লাভ’ বা ভালোবাসার দেয়াল! এই দেয়াল জুড়ে ঝুলে আছে একটির পর একটি হাজার হাজার ছোট ছোট তালা! জানা গেল, যে কোন নারী অথবা পুরুষ তার কাঙ্খিত জীবন সঙ্গী কামনা করে এই দেয়ালের গায়ে একটি তালা লাগিয়ে তালার চাবিটি এমন কোথাও ফেলে দেয়, যাতে তালাটি আর কখনও খোলা না যায়!
প্যারিস শহরে ‘সীন’ নদীর তীর থেকে শুরু করে ‘আইফেল টাওয়ার’ সহ আরও অনেক গুলি জায়গাতেই এ ব্যবস্থা রয়েছে! সম্ভবত এ সমস্ত কারণেই প্যারিসকে ‘সিটি অব লাভ’ বা ভালবাসার শহর বলা হয়ে থাকে। কেবলমাত্র প্যারিসের মানুষের নয়, সারা দুনিয়ার তরুণ-তরুণীদের হয়তো এ এক অদ্ভুত চিন্তা ভাবনা! এ কারণে প্যারিসে বেড়াতে আসা তরুণ-তরুণীরা এ পাগলামী করে আনন্দ পায়!
মঁ মার্তে আরও এক চমৎকার দৃশ্য দেখা হল! আর তা হল, বিশাল এলাকা জুড়ে একদিকে অসংখ্য খাবারের দোকান এবং অন্যদিকে সখের চিত্র শিল্পীদের ছবি আঁকার ব্যবস্থা। দেখে মনে হয় যেন চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। কয়েক শত চিত্রশিল্পী নিজেদের জন্য নির্ধারিত স্থান ছাড়াও রাস্তার পাশে, খাবারের দোকানের সামনে ছবি আঁকার সরঞ্জাম সহ প্রস্ততি নিয়ে আছেন। পর্যটকরা নিজেদের পছন্দ মত ছবি কিনে নিচ্ছেন অথবা বিভিন্ন ভঙ্গিমায় নিজেদের ছবি আঁকিয়ে নিচ্ছেন।
আরও পড়ুন রাধারমণ মন্দির
‘সীন’ বা ‘সেইন’ নদীর তীরে গড়ে উঠেছে প্যারিস শহর। ছোট্ট নদীটি সত্যি অবাক করার মতো। এ যেন ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে’- সেই অবস্থা! এ কারণে সীনের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আর গভীরতা জানতে ইন্টারনেটের দ্বারস্থ হলাম। যে তথ্য পেলাম তাতে বিস্ময় বাড়ল বৈ কমল না! প্যারিস শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া অংশের দৈর্ঘ্য মাত্র আঠার মাইল, প্রস্থ ৬৫৬.২ ফুট এবং গভীরতা ১০-২০ ফুট! এত ছোট একটি নদী, অথচ প্যারিসের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এর গুরুত্ব অচিন্তনীয়! ‘সীনে’ নৌ ভ্রমণ পর্যটকদের নিকট অত্যন্ত জনপ্রিয়। এছাড়া এ নদীর তীর ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ! বিশ্ব বিখ্যাত বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখতে যাওয়া আসার পথে দেখা হলো বৃটিশ রাজবধু প্রিন্সেস ডায়না প্যারিসের যে টানেলটিতে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে জীবন হারিয়েছিলেন সেই টানেলটি। এমন একজন বিশ্ব বরেণ্য নারীর বেদনাদায়ক অকাল মৃত্যুর স্মৃতির সাথে যে টানেলটি জড়িয়ে আছে-সেখানে এলে দর্শক হৃদয় স্বভাবতই বেদনার্ত হয়ে ওঠে।
শিক্ষায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে, সাহিত্যে, শিল্পকলায়, ফ্যাশনে আধুনিকতায় বহু শতাব্দী ধরেই প্যারিস বিশ্বব্যাপী মানুষের নিকট এক স্বপ্নের শহর। সেই স্বপ্নের শহরে কয়েকদিন বেড়িয়ে, অনেক বিশ্বখ্যাত স্থান দেখার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে হলো! প্যারিস ভ্রমণের স্মৃতি মন ভরিয়ে রাখবে আজীবন।
নেপোলিয়ন বোনাপার্টের দেশে-
ঘুরে আসুন আমাদের ফেসবুক পেইজে
নেপোলিয়ন বোনাপার্টের দেশে (শেষ পর্ব)