নারীর অধিকার রক্ষায় একধাপ অগ্রগতি
নারীর অধিকার রক্ষায় একধাপ অগ্রগতি
‘বাবার পরিচয় নেই, বন্ধ হলো মেয়ের লেখাপড়া’ শিরোনামে ২০০৭ সালের ২৮ মার্চ দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ২৪ জানুয়া্রি ২০২৩ প্রথম আলোসহ দেশের অনেকগুলো দৈনিকের মাধ্যমে জানা গেল শিক্ষাক্ষেত্রে নারী ও শিশুর আইনগত অধিকার বিষয়ে বাংলাদেশের মহামান্য হাইকোর্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ ও যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে ফর্ম পূরণের সময় শুধু বাবা নয়, লেখা যাবে মা ও আইনগত অভিভাবকের নাম। দৈনিক প্রথম আলোর প্রতিবেনটি ছিল এরকম- শিক্ষাক্ষেত্রের বিভিন্ন স্তরে ব্যবহৃত সব ফর্মে অভিভাবকের ঘরে বাবা মা অথবা আইনগত অভিভাবক শব্দ বাধ্যতামূলকভাবে যুক্ত করতে হাইকোর্ট রায় দিয়েছেন। প্রথম আলোর প্রতিবেদনটি থেকে আরো জানা গেল ২০০৯ সালে করা একটি রিটের প্রাথমিক শুনানীর ১৪ বছর পরে চূড়ান্ত শুনানী শেষে মহামান্য হাইকোর্ট এই রায় ঘোষণা করেন!
প্রতিবেদনটি থেকে আরও জানা গেল, ২০০৭ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনটির আলোকে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এবং নারী পক্ষ এই তিন আইন সহায়তা সংস্থা সম্মিলিত ভাবে মহামান্য হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দাখিল করে। উক্ত রিট পিটিশন দাখিলের পর হাইকোর্ট প্রাথমিক শুনানির পর বিষয়টি নিয়ে সরকারের দায়িত্ব পালনকারী সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উপর রুল জারী করেন। রুল জারীর দীর্ঘ ১৪ বছর পর পিটিশনটির চূড়ান্ত শুনানি হলো এবং একটি যুগান্তকারী রায় ঘোষণা করা হলো। এই রায় ঘোষণার মাধ্যমে নারী এবং শিশুর অধিকারের স্বীকৃতি কিছুটা হলেও পূরণ হল।
আরও পড়ুন ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা
একটি সন্তানকে গর্ভে ধারণ করা থেকে শুরু করে জন্ম দেওয়া, লালন-পালন করা, অসুস্থ হলে দিন রাত সেবা শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তোলাসহ সমস্ত কঠিন কাজগুলো সম্পন্ন করেন একজন মা। অথচ সেই সন্তানের আইনগত অভিভাবক হওয়ার ক্ষেত্রে চরম বৈষম্যের শিকার হন তিনি! বাংলাদেশের প্রচলিত আইন একজন মাকে তাঁর প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে! কোন শিশুর পিতামাতার বিচ্ছেদ হয়ে গেলে ওই শিশুর আইনগত অভিভাবক হওয়ার কোন অধিকার মায়ের নাই! একইভাবে কোন শিশু পিতৃহীন হলেও আইন গত অভিভাবক হওয়ার অধিকার চলে যায় শিশুর দাদা, চাচা বা পিতৃকূলের কোন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের কাছে! শরিয়া আইনের দোহাই দিয়ে একজন নারীকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে যেমন বঞ্চিত রাখা হয়েছে, একইভাবে একটি শিশুকেও তার মাতৃস্নেহের অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে!
অথচ বাংলাদেশে প্রচলিত মুসলিম পারিবারিক আইনও শরিয়া আইন থেকেই উদ্ভুত। ১৯৬১ সালে পাকিস্তানী স্বৈরশাসক আইয়ুব খান একজন মুসলিম নারীর স্বামীকে তালাক দেওয়ার অধিকার এবং উত্তরাধিকার আইনের ব্যাপক পরিবর্তন করে দিয়ে গেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বায়ান্ন বছর পার হওয়ার পরেও বাংলাদেশে বসবাসকারী কোন ধর্মাবলম্বী মানুষদের জন্যই পারিবারিক আইনগুলোকে যুগোপযোগী করার চেষ্টা করা হয় নাই-যা অত্যন্ত দুঃখজনক এবং তা মানবাধিকারেরও চরম লঙ্ঘন।
আরও পড়ুন একটি বহুল কাঙ্ক্ষিত আইনী সংশোধনী
ইসলাম অত্যন্ত আধুনিক ধর্ম। পবিত্র কুরআন থেকে উদ্ভুত কুরআনিক আইনকে ইজমা, ক্বিয়াস এবং ইসলামী আলেম ওলামাগণের কোরআন-হাদিসের আলোকে যুক্তি-তর্কের ভিত্তিতে যুগোপযোগী করার বিধান রাখা হয়েছে। যে কারণে একজন পাকিস্তানি স্বৈরশাসক শরিয়া আইনকে যুগোপযোগী করার মতো এত বড় একটি অসাধারণ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ সম্মিলিত জাতিসংঘের একটি সক্রিয় সদস্য এবং ১৯৭৯ সাল থেকে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহিত Convention of elimination of all forms of discremination against women(CEDAW) বা নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদে স্বাক্ষরকারী ও অনুসমর্থনকারী একটি দেশ। একইভাবে ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত Child Right Convention(CRC) বা শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী ও অনুসমর্থনকারী দেশও। তবে শরিয়া আইনের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশ দুটি আন্তর্জাতিক সনদেরই কিছু অংশ সংরক্ষিত রেখে সনদ দুটি সাক্ষর এবং অনুসমর্থন করেছে। অথচ ইজমা, ক্বিয়াসের আলোকে শরিয়া আইনকে যুগোপযোগী করা হলে এতিম, অসহায় শিশুদের দত্তক নেওয়ার বিষয়টি আইনী সুরক্ষা লাভ করতো এবং নারী-শিশুর প্রতি বৈষম্য মূলক আইগুলো দূরীভূত হতো! এছাড়া বাংলাদেশের অন্য ধর্মাবলম্বী নাগরিকদের পারিবারিক আইনগুলোকেও যুগোপযোগী করা সম্ভব হতো।
সব শেষে মহামান্য হাইকোর্টের প্রতি কৃতজ্ঞতা এমন একটা যুগান্তকারী রায় ঘোষণার জন্য। এ রায়ের ফলে নারী ও শিশুর অধিকার আংশিক হলেও পুরণ হয়েছে। একই সঙ্গে নারী শিশুর আইনি অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনগুলোকে আহ্বান জানাতে চাই, ভবিষ্যতেও তাদের এ ধরনের মহৎ এবং মানবিক উদ্যোগ অব্যাহত রাখার জন্য।
ঘুরে আসুন “আমাদের সুজানগর” এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
নারীর অধিকার রক্ষায় একধাপ অগ্রগতি