দীপ্তিদের দেবতা (২য় পর্ব)
দীপ্তিদের দেবতা (২য় পর্ব)
এ কে আজাদ দুলাল
প্রায় মাসখানেক হলো নতুন কর্মস্থলে যোগদান করেছি। নতুন বাসা নেয়া হয়েছে। গিন্নী তার সংসার গোছগাছ নিয়ে ব্যস্ত। বাচ্চা দুটো নতুন জায়গায় এসে নিঃসঙ্গবোধ করছে। এখনো বন্ধু-বান্ধব জোটেনি। তবে গিন্নীর সাথে পরশিদের আলাপচারিতা চলছে। আমিও কলেজে যাওয়া-আসা করছি আর পাশাপাশি আসাদের ঠিকানাটা মনে করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ড্রয়িং রুমে বসে ভাবছি কোথায় লেখা আছে ঠিকানা।
হঠাৎ গিন্নী এসে পাশে বসে টেলিভিশন অন করল। এ প্রজন্মের তরুণ রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী অদিতি মহসিনের কণ্ঠে ভেসে এলো রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয় গান- ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে’। গানটি শুনতেই গোরা উপন্যাসের কথা মনে পড়ে গেল। আসাদ আমাকে স্মৃতিস্বরূপ এই বইটি উপহার দিয়েছিল। তড়িৎ গতিতে উঠে ছোট স্টাডি রুমে ঢুকে বুকসেলফ তন্ন তন্ন করে খু্ঁজে অবশেষে পেয়ে গেলাম গোরাকে। সযত্নে হাতে নিয়ে পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখলাম। শুধু ছোট করে লেখা আছে-‘ভুল না মোরে’। ভুলিনি বন্ধু তোমার ঠিকানা। নিরাশ হলাম। আনমনে পাতার পর পাতা উল্টিয়ে যাচ্ছি হঠাৎ চোখ পড়লো বইয়ের শেষ পৃষ্ঠার নিচের দিকে। লেখা আছে-‘কখনো যদি মনে পড়ে, তবে চিঠি লিখ এই ঠিকানায়’। এক নিঃশ্বাসে ঠিকানা পড়ে চিৎকার দিয়ে উঠলাম-ইউরেকা ইউরেকা। গিন্নীসহ দুই বাচ্চা এসে হাজির।
- এই, কি হয়েছে?
কোন জবাব না দিয়ে গিন্নীর ডাগর ডাগর দুটো চোখের সামনে আসাদের স্বহস্তে লেখা ঠিকানাটা তুলে ধরলাম।
- আর দেরী নয়। কালই চিঠি লেখে পাঠাও।
রাতেই প্যাডে দু’লাইনের একটা চিঠি লেখে সকালের অপেক্ষায় রেখে সুখে নিদ্রায় গেলাম।
প্রায় সপ্তাহখানেক হলো চিঠি পোস্ট করেছি। পোস্ট অফিস হতে বলেছিল পনের দিনের আগে পাবে না। এই জন্য মনে হয় জনসাধারণ এখন কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবহার করে থাকে।
আরও পড়ুন গল্প মরিচপোড়া
ছুটির দিন। রাত আটটা বাজে। আজ বিটিভিতে হানিফ সংকেতের জনপ্রিয় ‘ইত্যাদি’ প্রচার হবে। পরিবারের সবাই টিভি সেট সামনে করে বসে অপেক্ষা করছি। এমন সময় মোবাইল ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। একটু বিরক্ত হলাম। ছেলেটি মোবাইল সেট দেখে বললো,
- একটা অপরিচিত নম্বর। কেটে দেব?
- না, আমাকে দাও হয়ত কোন প্রয়োজনীয় কল হতে পারে।
হাতে নিয়ে রিসিভ করতে অপর প্রান্তর থেকে ভেসে এলো-
- আপনি প্রফেসর?
- জ্বি বলছি। আপনার পরিচয়?
কোন রকম ভনিতা না করে সরস কণ্ঠে ভেসে এলো,
- আমি রমজান চাচার জামাই।
বলেই হো হো করে হেসে উঠলো। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম। গাধাটার এখনো রমজান চাচার কথা মনে রেখেছে। অনেক সময় ধরে কুশালাদী বিনিময় হলো। পারিবারিক কথা জানতে চাইলে সাফ জানিয়ে দিলো স্বচক্ষে এসে দেখে যাও। শুধু এটুকু বললো তাদের দুটো রাজকন্যা। তারা আগামী বছরে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। এর বেশি ফোনে কিছু বলা যাবে না। গিন্নী ‘ইত্যাদি’ নিয়ে ব্যস্ত। তাকে বলতেই আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন। হতাশ সুরে বললাম, মোবাইলে কোন খবরই বলবে না। একই কথা চাক্ষুসে সব হবে। মেয়ে দুটোর কথা গিন্নীকে বললাম এবং এ-ও বললাম তারা নাকি রাজকন্যা।
- হবে না রাজকন্যা। ভাবী যা সুন্দরী। ভালই হলো। আগামী মাসে তো বেশ ক’দিন ছুটি আছে, ঘুরে এসো। শোন এবার একাই যাও। দেখে এসো, এরপর সপরিবারে শীতে উত্তরবঙ্গ ভ্রমণে যাবো।
যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। গিন্নী তার সাধ্যমত ভাবী এবং দু’রাজকন্যার কিছু উপহার সামগ্রী ক্রয় করেছে এবং সুন্দর কাগজে প্যাকিং করে আমার ট্রাভেলিং ব্যাগে রেখে দিয়েছেন। ইতোমধ্যে আসাদ মেসেঞ্জারে তার আবাসিক ঠিকানা এবং কোথায় নামতে হবে স্ববিস্তারিত লিখে পাঠিয়ে দিয়েছে। আমিও প্রতিউত্তরে যাত্রাকালীন সময় এবং মোটর যানবাহনের নাম ক্ষুদে বার্তায় প্রেরণ করে শুভ দিনের অপেক্ষায় রইলাম। মনের ভেতর কেমন শিহরণ দিয়ে উঠছে। আসাদ এবং আসাদের পরমা সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে দাম্পত্য জীবন সুখে-শান্তিতে আছে তো। শুনেছি সুন্দরী মহিলারা নাকি বেশ অহংকারী হয়। স্বামীকে বেশি প্রশ্রয় দেয় না। একটু চাপে রাখে। কতটা সত্য তা জানি না।
আরও পড়ুন গল্প পেতনি
আসাদ অনেকটাই সহজ সরল। কি জানি ওর জীবনটা কেমন চলছে। হয়ত সুন্দরী বৌয়ের অনুমতি নিয়েই আমাকে তাগিদ দিয়েছে। রাত এগারটার গাড়ীতে নির্দিষ্ট আসনে বসে পড়লাম। আসনটা জানালার ধারে। গরমের প্রকট কিছুটা কমেছে। পাশের যাত্রী আমার চেয়ে বয়সে অনেকটাই ছোট, তবে ভদ্র বলে বিবেচিত হলো। তিনি নিজেই পরিচয় দিলেন। পরিচয় পর্ব শেষ হলো। গাড়ী যথাসময় ছেড়ে দিলো পঞ্চগড়ের উদ্দেশ্যে। পোঁছাবে সকাল সাতটার দিকে। রাতে ভ্রমণ সুখকর নয়। পথের দু’ধারের আবছা ঘনকালো অন্ধকার ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না।
ট্রেন ভ্রমণে একটা মজা আছে। সারা রাত আলো জ্বালানো থাকে। ফলে বই পড়ার সুযোগ হয়। মোটরযানে মোটেই সম্ভবপর নয়। তাই সাথে কোন বই নেয়া হয়নি। কত সময় জেগেছিলাম মনে নেই। হঠাৎ হেলপারের চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে গেল। পাশে বসা ভদ্রলোক বললেন, এখানে পনের মিনিট বিরতি। তারপর গন্তব্যস্থল। তবুও সিট ছেড়ে বের হলাম। জায়গাটা মন্দ না। নিশিরাতের একাকী পথ হারা পাখীর ক্রন্দন এখানে শুনা যাচ্ছে না।
বেশ কিছু দোকানদার রাতের খদ্দের আশায়, মরা কার্তিকে কুয়াশা ভরা চোখ নিয়ে লোভাতুর চোখ মিলে সামনের মানুষের দিকে তাকিয়ে আছে। মিনিট পাঁচেক ঘুরাফেরা করে আবার সিটে গিয়ে বসলাম। গাড়ী তার শেষ গন্তব্যের পথে সাঁ সাঁ শব্দ করে রাতের অন্ধকার ভেদ করে ছুটে চলেছে। পথের দু’ধারে শুধু আঁধারের খেলা। এই নিশিত রাতে আমার মনের ভেতর উঁকি দিচ্ছে বন্ধু আসাদের মুখ। তাকে কেমন দেখব। এক নজরে চেনাজানা হবে তো। নাকি বিস্ময় চোখে একে অপরের দিকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে থেকে বলবো-‘আমি—’ । ঘুমে চোখ ভারী আসছে। এক সময় আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। কত সময় ঘুমিয়ে ছিলাম জানিনা। সকালের নরম আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। দু’ধারে বিস্তৃত সবুজ জমিন। দিনাজপুর,পঞ্চগড়ে চালের জন্য বিখ্যাত। এই সেই মাঠ যেখানে সোনালী রঙের ধান হয়। দেখে চোখমন সার্থক হলো।
আরও পড়ুন গল্প পাথরে শৈবাল খেলে
প্রায় আধা ঘন্টার মধ্যে গাড়ী এসে নির্দিষ্ট বাস স্টপেজে থামলো। যাত্রীগণ নামছেন। প্রায় চল্লিশ জনের মত হবে। মনে হলো আমি নতুন এবং আনারি। যাইহোক নেমে নিজের লাগেজটা নেয়ার জন্য হেলপারের দারস্থ হলাম। বাসে উঠার সময় কলেজ বেয়ারা হেলপারকে বলে দিয়েছিল। হেলপার তার দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করলো। আসাদ একটা দোকানের নাম দিয়েছিল। হেলপারকে বলতেই সেই দোকান ঘরের সামনে লাগেজসহ আমাকে পৌঁছিয়ে দিল। বকশিস দিতে চাইলে সে বিনয়ের সাথে অপারগতা প্রকাশ করলাম। ধন্যবাদ বলে তাকে বিদায় করলাম।
জায়গাটা পঞ্চগড় শহর হতে বেশ ভেতরে। একটা উপজেলার মত। মনে হলো উপজেলা শহরের একটু বাইরে, যেটা বাইপাস রোড বলা হয়ে থাকে। সবেমাত্র দোকানপাট খোলা শুরু করেছে। জায়গাটা খারাপ না। সামনের দিকে তাকাতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সীমানা চোখে পড়লো। কড়িডোর-তিনবিঘা আর কত কি। তবুতো মিমাংসা হয়েছে। সীমান্ত নিয়ে আর বিরোধ নেই। আছে শুধু চোরাকারবাবীদের অবৈধ ব্যবসা। আর সাথে জড়িয়ে পড়ে নিরিহ হতদরিদ্র মানুষ। এই মানুষগুলোই বর্ডার ক্রস করতে মারা যায়। হঠাৎ ভাবনার ছেদ পড়লো। একটা অটোরিক্সা এসে সামনে থামতেই সাড়ে পাঁচফুট লম্বা হালকা পাতলা আমার বয়সী একজন ভদ্র লোক নেমে এলেন। চোখে মুখে আনন্দের তৃপ্তি হাসি। গোঁপের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছে হাসি।
- কি রে, চিনতে পারলি না? আমি রমজান চাচার জামাই।
আমি আবেগাপ্লুত হয়ে আসাদকে জড়িয়ে ধরলাম। সকালের নরম রোদে আমাদের মিলনটা আর মধুময় করে তুললো। কত বছর পর দুজনের আবার দেখা হলো। ‘আবার যদি হলো দেখা প্রাণের মাঝে আয়’।
- দোস্ত, তুই তো আগের মতই আছিস। ভুলে যাসনিস রমজান চাচাকে।
- তুই তো মাস্টার মানুষ, তাই চেহারায় ভারকি ছাপ। তাড়াতাড়ি অটোরিক্সায় উঠে পরো। নাস্তার টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে বসে আছেন তিনি, যিনি শেষ রাত হতে অতিথি সেবা করা নিয়ে উদ্বেগ।
ভাবছি, আসাদ বলে কি। পরমা সুন্দরী স্ত্রী, সে নাকি অচেনা অতিথির অপেক্ষায়। এর জন্য তো ঝিঁ-চাকরের অভাব নেই। এটা কি আসাদের হেয়ালীপনা।স্ব ভাবটা আর গেল না।
আরও পড়ুন গল্প স্বপ্ন গোধূলি
- কত সময় লাগবে।
- আধা ঘন্টা। ডাগর ডাগর ভরা আঁখি বৌদি কেমন আছেরে।
- ভাল।
- মন দিয়ে শুনে রাখ, আমার বাড়ীতে গিয়ে কোন রকম অস্বস্তিবোধ করবি না। মনে করবি আবার দুজনে জোহা স্যারের হলে অবস্থান করছি। গিয়ে দেখবি রমজান চাচার মেয়ে সব কিছু প্রস্তুত করে রেখেছেন। গোসল, নাস্তা তারপর দুজনে সারাদিনের জন্য ফুড়ুৎ।
আসাদের কথাগুলো শুনছি আর পথের দু’ধারে দৃশ্যাবলী মন-প্রাণ দিয়ে অবলোকন করছি। রমজান চাচার নাম শুনে চমকে উঠলাম। রমজান চাচার মেয়ে? তাহলে ঔ পরমা সুন্দরীর ছবি কি, না মাথার ভেতর ঘিলু কাজ করছে না। আধা ঘন্টার পর প্রকাণ্ড একটা দীঘির সামনে এসে থামলো অটোরিক্সা। দীঘির উত্তর পাশে কাঁচা বাড়ী। বাড়ীর ভেতর বেশি লোকের সমাগম বলে মনে হলো না। শান্ত এবং নীরব। অটোরিক্সাওয়ালা ট্রাভেলিং ব্যাগটা বাড়ীর ভেতরে নিয়ে গেল। আসাদের পিছনে এদিক-ওদিক হরিণচোখে দেখতে থাকি কিছু দেখা যায় কি না। নাহ, তেমন কিছু চোখে পড়লো না। ধরে নিলাম রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে আগমন হলো।
গ্রাম হলে কি হবে, বাড়ীর বাইর হতে ভেতর আঙ্গিনায় তেলাপোকা নজরে পড়বে না। আমাকে একটা রুমে রেখে আসাদ বের হয়ে গেল। বেশ গোছানো, পরিপাটি রুমটা। সেগুনকাঠের তৈরী পুরনো আমলের খাট। মার্জিত একটা বিছানা চাদরে আচ্ছন্ন এবং পাশে আলনা। খাটের এক পাশে সিঙ্গেল সোফা। সোফার সামনে ছোট ডিম্বাকৃত টি- টেবিল। শুধু তাই নয় সংলগ্ন বার্থরুম। রাত জাগা পাখী শরীরে ক্লান্তি ভর করেছে। সোফায় বসে পড়লাম। প্রায় পাঁচ মিনিট পর একজন বয়স্ক মহিলা এলেন। দেখেই মনে হলো আসাদের মা। মহিলার চেহারায় ফুটে উঠেছে আভিজাত্যের ছাপ। দাঁড়িয়ে ছালাম দিলাম।
- বাবা, রাস্তায় অনেক কষ্ট হয়েছে। ওর বাবার কাছে তোমার কথা শুনেছি। তুমি তো আমার আর একটা সন্তান। আসাদের বাবা বেঁচে থাকলে খুব খুশি হতেন। দেখ, গোসলখানায় সব বন্দোবস্ত করা আছে। গোসল করে এস। এক সাথে নাস্তা করব এবং বাকী কথা হবে।
আরও পড়ুন গল্প সোনালি সকাল
আসাদের বাবা বেঁচে নেই শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। গাধাটা জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি। জানাবেই বা কেমন করে, ঠিকানা তো আমি দেইনি। আসাদের বাবা ছিলেন একজন ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। তিনি যে একজন মার্জিত- রুচিবোধসম্পন্ন মানুষ ছিলেন তা বাড়ীর পরিবেশ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। নিজের পায়ে চলার পরামর্শ দিয়েছিলেন সেই কত বছর আগে। তার একটা কথা এখনো মনে পড়ে,
– বাবা, যা করবে নিজের বিশ্বাস থেকে করবে। যে কাজটা করবে তা যেন অন্তত অতি সাধারণ মানুষের কল্যাণ হয়। কত মানুষের রক্তে ভেজা এই দেশ।
দীপ্তিদের দেবতা গল্পের-
১ম পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
দীপ্তিদের দেবতা (২য় পর্ব)