তৃষ্ণার পৃথিবী ছুঁয়ে
তৃষ্ণার পৃথিবী ছুঁয়ে
আদ্যনাথ ঘোষের কবিতার সাহিত্য রস
লতিফ জোয়ার্দার
বয়স একটা সংখ্যা মাত্র। তারপরও পঞ্চাশ বছর বয়স প্রতিটি মানুষের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। আর সেই বয়স যদি হয় একজন কবির বয়স, তবে তা সেই কবির কাছে বয়সটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ। তার সংসারের কাছে, তাঁর সমাজের কাছে, তাঁর বন্ধুদের কাছে, পাঠকের কাছে ও আশেপাশের মানুষগুলোর কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। আজ আমি যে কবির কথা বলছি। সেই কবি বাংলা সাহিত্যের কবি আদ্যনাথ ঘোষ। এক সময় এই কবির সাথে পরিচয় না থাকলেও কবির কবিতার সাথে পরিচয়ের সুযোগ হয়েছিলো আমার। প্রথম কবিতা পড়ে কেমন যেন ঘোরের মধ্যে ছিলাম দীর্ঘসময়। এমন সময় সাহিত্য সম্পাদক অচিন্ত্য চয়ন আমাকে ফোন দিয়ে বললো, আদ্যনাথ ঘোষকে চিনি কিনা? কিন্তু তখন তাঁর সাথে আমার কোনো পরিচয় ছিলো না। আমি তাঁকে বললাম না। চিনি না। সে আমাকে বললো, আপনাদের পাবনার কবি অথচ আপনি তাঁকে চেনেন না?
অতঃপর একদিন পাবনা শহরে কবি মজিদ মাহমুদের অফিসে পরিচয় হলো তাঁর সাথে। প্রথম দেখাতে একজন সাদামাটা মানুষ বলেই মনে হলো আমার। সেদিন তার সাথে, তাহার সাথে কী কথা হয়েছিলো, আজ তা ঠিক মনে করতে পারছি না। তবে দিনাকদিন এই কবির সাথে আমার সম্পর্ক আরও বেশি গাঢ় হয়েছে। আমাদের হৃদয়ের সম্পর্ক বেড়েছে। আমার সবুজস্বর্গে বারবার এসেছে এই কবি। বারবার কবিতা আড্ডা হয়েছে তাঁর সাথে। তাঁকে দেখার, তাঁকে জানার সুযোগ হয়েছে আমার। তাঁকে পাঠ করার সুযোগ এসেছে আমার জীবনে।
আরও পড়ুন অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল জব্বারের বই পর্যালোচনা
আদ্যনাথ ঘোষ প্রকৃতই একজন কবি। কবিতা চাষ করেন তিনি। কবিতার ঘর গৃহস্থালীতে অবিরত বিচরণ তাঁর। তবে এই কবির গ্রামীণ যে জীবন, যেখানে তার যৌবন। যে গ্রামের কাদামাটির সাথে সম্পর্ক তাঁর। যে গ্রামের মাটির সাথে, যে গ্রামের মাঠের সাথে, ফসলের সাথে সম্পর্ক যার। সবুজঘাসের ডালা মাথায় তুলে যে কবি একদিন ঘরে ফিরতো। একজন ঘোষ বাড়ির সন্তান হয়ে দই ফেরি করতো। এমন জীবন ক’জনার থাকে? এমন জীবনের সাথে বসবাস ক’জনার? আর তাঁর কবিতায় সেই গ্রাম থাকবে, নদী থাকবে, গ্রামীণ জীবন থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তাঁর কবিতায় সেই গ্রামের মেঠোপথ ছড়িয়ে থাকবে। আলপথ দিয়ে হেঁটে যাবে কিশোর কিশোরী। তাঁর খোঁপায় রক্তজবা ফুল থাকবে। বুড়ো বটের গাছ থাকবে। ঘোষ বাড়ির জীবন থাকবে। এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু তাঁর কবিতায় দেখি নগর জীবন, নগর জীবনের যন্ত্রণা। নগর জীবনের কোলাহল। ব্যস্ত পথের সীমানা। তিনি হয়তো শৈশব, কৈশোর, যৌবন ভুলে নগর জীবনের কাছে সপে দিয়েছেন নিজেকে। তারপরও মানুষ স্মৃতি ভুলতে পারেন না। বারবার ছুটে যায় তার ফেলা আসা সেই স্মৃতির কাছে। বারবার ফিরে যায় ফেলা আসা সেই দিনের কাছে। তাই তো তিনি বলতে পারেন।
“আমার ভরাট নদী
খালি হয় শুধু ভোর বিহান বেলায়।
জেগে থাকে একটি পাখি অনিমেষ চোখে
অতীত বিস্মৃত ধূমে
আড়িপাতা চাঁদে।”
(কবিতাংশ: পোড়া রাত ও তৃষ্ণার জল, কাব্যগ্রন্থ: তৃষ্ণার পৃথিবী ছুঁয়ে)
আরও পড়ুন অধরা চাঁদ উপন্যাস রিভিউ
একজন কবির হাতে যখন এমন অসাধারণ পঙক্তিমালার জন্ম হয়। আমরা তাঁকে তো কবিই বলবো। সে কালের বিবর্তনে টিকবে কি টিকবে না, সেটা কাল নির্ধারণ করবে। আমরা শুধু তাঁর সাহিত্যের রসটুকু খেঁজুর রসের মতো উপভোগ করে যাবো। তাঁর গ্রন্থ সংখ্যা এগারো। এই এগারটি গ্রন্থের সবগুলো কবিতাকে হয়তো কবিতা বলা যাবে না। আর একজন কবির, একজন লেখকের সব লেখাই লেখা হয়ে ওঠে না। কিছু কিছু হয়। আমার তো মনে হয় সবার ক্ষেত্রেই এমনি হয়। তাঁর প্রথম দিকের লেখা কবিতার চেয়ে এখনকার কবিতাগুলো বেশ পরিপক্ক বলে মনে হয় আমার কাছে। মনে হয় অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছেন কবি। কবিতা লেখার জন্যেই জন্ম হয়েছে তাঁর । তাই তো তিনি বলে ওঠেন-
“এই রক্তমুখী চাঁদ আমাকে সন্ধ্যা বিছিয়ে দেয়।
দখিনা বাতাস বয় জীবনের ঘেরে- সাপ পথে।
পশ্চিম ঘনিয়ে আসে- তপ্ত সন্ধ্যা, বিষাদের ঢেউ
ক্ষয়িষ্ণু জীবন পাঠে, ভুল করে খেয়ে নিই পুঁথি।
(কবিতাংশ: রক্তমুখী চাঁদ, কাব্যগ্রন্থ: তৃষ্ণার পৃথিবী ছুঁয়ে)
আরও পড়ুন অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের প্রকাশনা
তাঁর এগারোটি গ্রন্থের সর্বশেষ গ্রন্থ “তৃষ্ণার পৃথিবী ছুঁয়ে”। পর্ববর্তী গ্রন্থের কবিতাগুলো বিচ্ছিন্নভাবে পড়া হলেও এই গ্রন্থটি আমি বেশ মনোযোগ সহকারেই পড়েছি। আমাকে পড়তে হয়েছে। ওই যে সেই তাঁর পঞ্চাশ বছর বয়সের কারণে। তাকে নিয়ে লিখতে বসেছি আজ আমি। যে গ্রন্থটি নিয়ে লিখতে বসেছি গ্রন্থটি কবিতার। ছোট বেলায় হাটে গেলেই কবিতা শুনতাম। কবি কবিতা পড়া শেষে সবার মাঝে তার কবিতা ধরিয়ে দিচ্ছেন অথবা কোনো পণ্য। তন্ময় হয়ে শুনতাম সেই কবিতা। “সাপ খেলায় সাপুড়ে কন্যা নামে জরিনা। জরিনার বাপ নাই মা নাই দাদির সাথে থাকে।” কবি যখন থামতেন। নিজে নিজেই ভাবতাম, কবি মাত্র দুই টাকার জন্য হাটে হাটে কবিতা বিক্রি করছে। এই সব হাটের কবি, স্টেশনের কবি, লঞ্চের কবি আর এখন নেই।
আমরা নাগরিক জীবনের ক্ষত অথবা অপ্রাপ্তি, মিথ ব্যবহার করে কবিতা লিখি। আমাদের কবিতার সংসারে উপমাগুলো ফুলের মত। ফুল আমিও ভালোবাসি। সে কারণে কবির প্রতি ভালোবাসা নয়। কবিতার প্রতি ভালোবাসা আমার আজন্মকাল। আমি হাটের কবি না হলেও বেঁচে থাকার প্রয়োজনে কবিতা লিখি। সে বেঁচে থাকা মানে কবি হয়ে বেঁচে থাকা। কারো জন্য নয় নিজের জন্য কবিতা লিখি আমি। আর কবি আদ্যনাথ ঘোষ এর বাইরে নয়। বেঁচে থাকার জন্য কবিতা লিখেন কবি। তিনি হাটের কবিতা, মাঠের কবিতা হৃদয়ে ধারণ করে নাগরিক কবি হয়ে ওঠেন। আর সে কারণে তাঁর কবিতায় খুঁজে পাই নিসর্গ। খুঁজে পাই ধূসর অন্ধকার। বুকের যন্ত্রণা বুকে রেখে কবি হেঁটে চলেন কখনও আলোর পথে। সে কারণে কবি লিখতে পারেন
“আমার দহন রাত
তোমাকে দিলাম তুলে জলচোখ তৃষ্ণায়।
শূন্যের উপর বাঁধা এই মোহ রাত
গেরুয়া মাটির সিঁথি এঁকে
নির্মোহে বিষফণা তোলে স্বেচ্ছায় আড়ালে-
নোনাজলে, নৈনিতালে।”
(কবিতাংশ: ঢেউতলে, কাব্যগ্রন্থ: তৃষ্ণার পৃথিবী ছুঁয়ে)
আরও পড়ুন সরদার জয়েনউদদীনের সাহিত্য মূল্যায়ন
কবিকে প্রতিনিয়ত হাঁটতে হয় বন্ধুর পথ ধরে। বুকের যন্ত্রণা বুকে রেখে এগুতে হয়। এই অবিনশ্বর পৃথিবীর বুকে কবি আঁচড় রেখে যায়। “তৃষ্ণার পৃথিবী ছুঁয়ে” কাব্যগ্রন্থটিতে মোট তেতাল্লিশটি কবিতা আছে। কিছু কিছু কবিতায় অনুভবে স্বাক্ষর রেখে যায়।
“দেখো, গোটা দুপুর আজ উন্মাদ; আগুন আগুন খেলা।
পোড়াও শস্যক্ষেত, পাখিডানা ভোর, জ্যান্ত পৃথিবীর গোলকধাঁধাঁ।”
(কবিতাংশ:অনুভব)
তারপরও কবিকে আগামী দিনের কবিতা লিখতে হয়। আগামী দিন কবির কাছে এসে ধরা দেয়। একটা দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি নিয়ে কবিকে কবিতার পথে এগিয়ে যেতে হয়। কবিকে ছন্দ জেনে ছন্দ ভাঙতে হয়। “তৃষ্ণার পৃথিবী ছুঁয়ে” গ্রন্থটিতে সামান্য কিছু অসঙ্গতি রয়েছে বলে মনে হয় আমার। তবে সে আমার চোখের ভুল হয়তো। তবে আমার কাছে কেন জানি মনে হয়েছে, বার বার ব্যর্থ হবার পরও কেউ কেউ জয়ের জন্য মরিয়া হয়। অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। তবে আমার মনে হয় লেখালেখির বিষয়টা অন্যরকম। চেষ্টা করে কেউ কখনো লেখক হতে পারে না। কেউ কখনও কবি হতে পারে না। তবে লেখার সাথে নিরলস লেগে থাকতে হয়। পাঠ ও পঠনের মধ্য দিয়ে নিজেকে তৈরি করে নিতে হয়। তখন দেখবেন আপনা-আপনি আপনার উপর নাজিল হচ্ছে সাহিত্য।
আরও পড়ুন সত্যের ভোর কাব্যগ্রন্থ ভাবনা
সাহিত্যের রস যেমন আহরণ করতে হয়, সেই সাথে শিল্প-সাহিত্য ইতিহাসের সাথে নিজেকে যোগ করতে হয়। চারপাশ ধারণ করতে হয়। কেউ কেউ আবেগ নিয়ে লিখেন বটে। তবে তা সাময়িক। তবে একটা কথা মনে হয় সবার জন্য প্রযোজ্য,সাহিত্যের পাশাপাশি অংক জানতে হয় একজন সাহিত্যিককে। সাহিত্যের গণিত জানা মানুষগুলোই যুগে যুগে সেরা সাহিত্যিক হয়েছে। সেই সেরাদের দলে একদিন হয়তো আদ্যনাথ ঘোষের নাম যোগ হবে। সেই প্রত্যাশা রাখি।
আরও পড়ুন আদ্যনাথ ঘোষ-
আদ্যনাথ ঘোষ
আদ্যনাথ ঘোষের কবিতায় প্রান্তিক প্রতিধ্বনি
আদ্যনাথ ঘোষের কবিতার সাহিত্য রস
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর-এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে
তৃষ্ণার পৃথিবী ছুঁয়ে