তিল-তাল
গল্প,  শফিক নহোর (গল্প),  সাহিত্য

তিল তাল

তিল তাল

শফিক নহোর

 

ক.
প্রচণ্ড শীত। বাড়ি থেকে আসার সময় ছোট একটা চাদর নিয়ে এসেছিল শরিফ। যদিও আজ কয়েক দিনে সে বুঝতে পারছে, চাদর দিয়ে শীতকে কাবু করা যাবে না । শরিফকে এয়ারপোর্ট থেকে আলী নামের একজন ভদ্রলোক রিসিভ করেছে। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কথা হয়েছে। শরিফ অনুভব করতে পারল, ভাপা পিঠা তৈরি করতে যেমন পানির ভাপ বের হয়, কান দিয়ে ঠিক তেমন গরম ভাপ বের হচ্ছে । কেরালা একটা হোটেল থেকে রাতের খাবার খেয়ে, দুজন রওনা হল শরাফিয়া নামক ছোট্ট শহরে। সেখানে তিনতলা একটা বাড়িতে শরিফের থাকার জায়গা ঠিক করে রেখেছে আলী। লোকটাকে আজ ক’দিন দেখে যা বুঝতে পারল শরিফ; সে গাধার মত খেটে মরে। তারপরেও মালিক পক্ষের কাছে তার মূল্য অতি নগন্য। খুব আফসোস করে সেদিন রাতে বলল,
_এ জিন্দিগী কুত্তেকা জিন্দিগী।
কথাটা শুনে পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। একটা কিছু বলতে চাইল, ঠোঁটে কে যেন আঠা লাগিয়ে দিল।
আলী ভাইয়ের মোবাইল ফোনের রিংটোনের শব্দে, শেষ রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। সিঙ্গেল একটা কম্বল গায়ে দিয়ে সারা রাত শীতে কষ্ট করেছি, ঘুম ভেঙে না গেলে বুঝতে পারতাম না। আজ রাতে এতো শীত পড়ছে । ডিজিটাল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, চারটা পনের বাজে। ফজরের ওয়াক্ত হয়ে গেছে। আলী ভাই ফ্রেশ হয়ে এসে বলল,
_তুম যায়েগা মেরা সাথ মসজিদ মে!
_আলী ভাই দু’মিনিট রুখো!
পরবাসে আলী ভাই ষোল বছর অতিক্রম করেছেন। বাঙালি মার্কেটের পাশে বাসা নিয়ে থাকায় বাংলা বুঝতে পারে, বেশ ভালোই। তবে বাংলা বলতে পারে না।

আরও পড়ুন গল্প হাইয়া আলাল ফালাহ

এরাবিয়ান ছুঁকে সস্তা দরে কাঁচা বাজার পাওয়া যায় গল্প শুনে আমার এখানে আসা। এরাবিয়ান বাজারে ভীষণ ভিড়। ভেড়া আর ছাগলের হাট। কাঁচা বাজারে মেয়ে মানুষের ভিড় চোখে পড়ার মত। যাদের স্বামী মাজরা কাজের সঙ্গে জড়িত, তাদের স্ত্রীরা কাচা বাজারে ব্যবসা করে। কেউ কেউ আসে দেখতে। ছেলেদের শাদা পাগড়ি, মাথার উপরে কালো বেল্ট জাতীয় দেখে মনে হয়, সাদাকালো ভূতের বাজার।
চারিদিকে কোলাহল, চিৎকার-চেঁচামেচি, হাঁক-ডাক। বাঙ্গালী লোকজন বাজারের ড্রেনের ময়লা পরিষ্কার করছে। হৈ-চৈ এর সুউচ্চ শব্দ কানে আসল। পালাও পালাও, জাওয়াজাত আসছে, মক্তবে আমেল। অনেক সুবিধা-বঞ্চিত বাঙালি অল্প বেতনে চাকরি করে। তাদের কাছেই দেশের মানুষের চাহিদা থাকে আসমান সমান। নোংরা জামা-কাপড় গায়ে মলিন চেহারায় কেমন কষ্টের কাজ করে। স্বচক্ষে না দেখলে রূপকথার গল্পের মত মনে হবে। কোন কোন দোকান থেকে অট্টহা কানে আসছে। দূর থেকে ভেড়ার ডাক শোনা যাচ্ছে।
বাজারের ভেতর গোয়াল ঘরের মতো গন্ধ। কাচা ঘাসের গন্ধ আর মরুভূমির লোকদের দিনের পর দিন গোসল না করার কারণে গা দিয়ে আধা-মানুষ আধা-পাটা ছাগলের গন্ধ বেরোয়। কাঁচামালের বাজার থেকে ফিরে, সেই গন্ধ দামি পারফিউম ব্যবহার করে দূর করবে। এটা এরাবিয়ানদের খানদানি অভ্যাস। কারো কারো মুখ দিয়ে তীব্র দুর্গন্ধ। গ্রাম্য কৃষকদেরকে বদু বলে ডাকে। জীবন যাত্রার মান খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি কিছু মানুষের।
স্থায়ী একজন আপেল ও খেজুর চাষির সঙ্গে শরিফের কথা হল। তার মুখের হাসির আড়ালে এক ধরণের ব্যর্থতার ছাপ স্পষ্ট দেখে প্রশ্ন করলাম,
_হাবিবী আপনার সংসারের সদস্য সংখ্যা কতজন? বেচারা লাজুক দৃষ্টিতে মুখের দিকে নির্বাক তাকিয়ে রইল। শাদা পোশাক-পরিচ্ছেদ ভদ্র মার্জিত তার চেহারার ভেতরে কেমন অভাব দরিদ্রতার ছাপ প্রকাশ পাচ্ছে। এদের ছেলেমেয়ে আন-লিমিটেড!

আরও পড়ুন একজন অনন্যা

ফিরে আসার পথে পুরনো পত্রিকার একটা পাতা পায়ের কাছে এসে পড়ল। আরবি হরফ দেখে হাতে তুলে চুমু খেতে লাগল শরিফ। পাশেই একটা পুলিশের গাড়ি তাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসল। শরিফ একটু ভয় পেয়ে গেল। তাকে ইশারা দিয়ে কাছে ডাকলো। তার হাতের পত্রিকাটি চেয়ে নিল। পড়ে দেখে চড় বসিয়ে দিল, সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই।
_ইনতা বাঙালি হারামি হায়ওয়ান।
শরিফকে গাড়িতে উঠতে বলল।

খ.
রাতে শরিফের ঘুম ভেঙে গেলে তাকিয়ে দেখে, পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে আছে। নিজের রুমে পুলিশ দেখে অবাক হল। রুমের দরজা বন্ধ কিন্তু ভেতরে কি করে একজন জলজ্যান্ত মানুষ রুমে ঢুকল।
শরিফ পুলিশ অফিসারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সহজে কিছু বলতে পারছে না। সে একবার প্রশ্ন করতে চাইল। আপনি আমার রুমে কি করে ঢুকলেন? কিন্তু প্রশ্নটি করতে পারেনি। হাত পা কেমন জানি অবশ হয়ে আসছিল তখন। ভূতে ধরা মানুষের মতো সুরা ইয়াছিন পড়ছিল; আর আল্লাহ্ আল্লাহ্ করছিল। যাতে কোন বিপদ না হয়। পুলিশ শরিফকে পিছনে হাত বেঁধে গাড়িতে করে থানায় নিয়ে গেল।
সে খুব কাকুতি মিনতি করেছ। আমাকে কেন ধরে এনেছেন? পুলিশ অফিসার তার সঙ্গে কোন কথা বলছে না। চোখের কিনার দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। খুব চেষ্টা করছে, পুলিশকে বোঝাতে। শরিফ দাবি করছে, সে কোন প্রকার খারাপ কাজ করেনি। তবে কেন তাকে ধরে নিয়ে এসেছে ? পুলিশ অফিসার তার মুখের দিকে তাকিয়ে ঘৃণ্য দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ চেয়ে রইল। শরিফ ভেবে চিন্তে উপায়ান্ত খুঁজে পেল না। পরের দিন গাড়িতে করে অন্য জায়গায় নিয়ে গেল। বুঝতে পারছিল, কিন্তু কিছু বলতে পারছিল না। শরিফের মুখে কস্টেপ মারা, হাতে হ্যান্ডকাফ পড়ানো।
অন্ধকার একটি রুমে শরিফকে নিয়ে যাওয়া হলো। কোন প্রকার আলো নেই। সে অনেক চেষ্টা করল, কোন আলো দেখা যায় কি-না। রুমের ভেতর ঢুকিয়ে হ্যান্ডকাফ খুলে দিল। মুখের বাঁধন খুলে দিয়ে বাহিরে তালা লাগিয়ে অফিসার চলে গেলেন।

আরও পড়ুন গল্প  স্বপ্ন জল

বাথরুমে যাবো কিন্তু চারিদিকে অন্ধকার। কোন বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। সকালে ও রাতে খাবার দিত। কারো সাথে কথা হত না। তের দিন পরে শরিফকে স্থায়ী আদালতে তোলা হল। তখন জানতে পারল। তাকে আইএস ও যৌন ব্যবসায়ী হিসেবে সন্দেহ বশত গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ অফিসার সন্দেহ করেছিল, শরিফ এরাবিক পত্রিকার পরিত্যক্ত কাগজে কেন চুমু খেয়ে ছিল।
পত্রিকায় চুমু খাওয়ার অপরাধে, পুলিশ অনেক দিন আগে থেকেই চোখে চোখে রেখেছিল এবং গোয়েন্দা বিভাগের লোক তাঁদের নজরদারিতে রেখেছিল। শরিফ কোথায় যায়, কী করে, সব তারা খোঁজ-খবর রাখত। একদিন রাতে শরিফ বাসায় প্রত্যাগমন করার আগেই তার রুমের ডুবলিকেট চাবি বানিয়ে রুমের ভেতরে ঢুকেছিল। যাতে শারিফকে হাতে-নাতে ধরতে পারে।
সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই বুকের ভেতরে ছ্যাঁত করে উঠল। শরিফ নিচে থাকতেই, কেন জানি তার মনে হয়েছিল, আজ তার অমঙ্গল হবে।

গ.
পরের দিন সকালে শরিফকে আল মাহাইল থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হল। সে নিজেকে একের পর এক প্রশ্ন করেও সদুত্তর পেল না নিজের নিকট। পাহাড়ি রাস্তায় বের হয়ে সে হাঁটতে লাগল। চারিদিকে কোন ঘরবাড়ি নেই, সে পথ ভুলে হয়তো মরুভূমির ভেতরের রাস্তা দিয়ে হাঁটা ধরেছ। সামনে এগিয়ে যেতেই একজন বৃদ্ধলোক তাকে দুপুরের খাবার জন্য আহ্বান করল। সে অনেকটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে গেল।

আরও পড়ুন গল্প লালু

নিজেকে খুবই ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। সে বৃদ্ধের আমন্ত্রণ স্বাগতম জানাল। আলফাহাম তার সাথে পেপসি ডায়েট পেট ভরে খেল। খাবার খেতে খেতে অনেক গল্প হল বৃদ্ধ লোকটির সঙ্গে। এমন হাল কি ভাবে হয়েছে সে শরিফের কাছে খুঁটিনাটি সবকিছু জানতে চাইল।
শরিফ নিজের কষ্টটা দূর হোক ভেবে, মনের জমানো কষ্ট তাকে বলল।
মন্দ কথা বাতাসের আগে উড়ে। ঠিক তেমনি পরের দিন সকাল থেকেই শরিফের পরিচিত অপরিচিত লোকজন ফোন করে জানতে চাইল, তাকে পুলিশ কেন ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তার অপরাধ কি?
আমি কী কোন মানুষ খুন করছি, নাকি কোন নারীর সাথে অবৈধ কোন কাজ করেছি, বাড়ির মানুষও জানতে চাইত। দিন দিন শরিফের কাছে মানুষের প্রশ্ন বিষের মতো শরীরে ঢুকতে লাগল। সে নিজেকে আড়াল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। একই কথা একই প্রশ্ন পাগল ছাড়া সুস্থ মানুষ দিনে হাজার বার সহ্য করতে পারে না।
পুলিশের সন্দেহ হয়েছিল, কেন পথে পড়ে থাকা পুরনো পত্রিকার পৃষ্ঠা তুলে বার বার চুমু খেয়েছিলাম। যেখানে শিরোনাম হিসেবে লেখাছিল, ‘বাংলাদেশি কিছু যুবক মিলে এরাবিয়ান কিশোরী মেয়েকে ধর্ষণ করেছে।’ আরবি হরফে লেখা সে কাগজটি আমি তুলে বার বার চুমু খেয়েছিলাম। সেটাই ছিল আমার অপরাধ। আরবী হরফ পড়তে না পারাটা একটা অপরাধ হয়ে যাবে, তা ভাবিনি কখনো।
একটা সময় পরিবেশ আমাকে ধর্ষণকারী বানিয়ে ফেলছে। সত্য মিথ্যার বিচার কেউ করছে না। আমি সহ্য করতে পারিনি।
দেশ ত্যাগ করে সুখী হতে চেয়েছিলাম। শরীর আমার নীল হতে লাগল। দিনের পর দিন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে গেলাম।
পাথরের শহরে আলোকিত চাঁদ মৃত্যেুর অপেক্ষায় আমার প্রহর গুনা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না।

আরও পড়ুন শফিক নহোরের গল্প-
চোখে দেখা নীলকণ্ঠ
আড়ালের চোখ
নীরুর মা

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

তিল তাল

Facebook Comments Box

শফিক নহোর মূলত একজন গল্পকার। এছাড়া তিনি প্রতিনিয়ত অণুগল্প, ছোট গল্প ও কবিতা লিখে চলছেন। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: মায়াকুসুম, বিষফুল, কসুর; কাব্যগ্রন্থ: মিনুফুল তিনি ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই নভেম্বর পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের নওয়াগ্রামের শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!