তিনি-একজন-মহিলা-মুক্তিযোদ্ধ-৪র্থ-পর্ব
খলিফা আশরাফ (গল্প),  গল্প,  সাহিত্য

তিনি একজন মহিলা মুক্তিযোদ্ধা (৪র্থ পর্ব)

তিনি একজন মহিলা মুক্তিযোদ্ধা (৪র্থ পর্ব)

খলিফা আশরাফ

 

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। কাল রাত্রে ঢাকায় হাজার হাজার নিরস্ত্র নিরীহ বাঙ্গালীকে হত্যা করলো বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী। নৃশংস হত্যাকান্ড। রাস্তা-ঘাট, অলি-গলি, ঘরে-বাইরে সর্বত্র লাশের স্তুপ। পুড়িয়ে দেয়া হলো ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট, অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ঢাকা নগরী ভাগাড়ে পরিণত হলো। জীবন বাঁচাতে সব কিছু ফেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে মানুষ পালাতে শুরু করলো। কেউ পারলো, আবার কেউবা পালাতে গিয়ে বেঘোরে প্রাণ দিলো। ২৬ মার্চে হাজি সাহেব দোকানও খোলেননি, বাইরেও বের হননি। বংশাল মেইন রোডের সাথেই তিন তলা বিশাল বাড়ি তাঁর। দোকানের ম্যানেজারও তাঁর বাড়িতেই ছিলেন। কিন্তু কেউই বাঁচতে পারেনি। কসাই পাকসেনারা নির্মমভাবে হত্যা করেছিলো পুরো পরিবারকে। ভয়ে যারা বাঁচার জন্যে হাজি সাহেবের বিশাল বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলো, তাদের কেউই রক্ষা পেল না। রাস্তার পাশে বলে সুন্দর বাড়িটা সহজেই টার্গেট হয়েছিলো পাক সেনাদের।

কিন্তু ভাগ্য জোড়ে বেঁচে গেলো নিমতলী গলির ভাড়াটে মধু-ময়না। লাশের পাহাড় ডিঙিয়ে একটা সুটকেস নিয়ে কোন রকমে পালালো তারা। সে রাতেই গলি-ঘিঞ্জি পেরিয়ে ছুটলো হাজি সাহেবের বাড়িতে। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। হাজি সাহেবের বাড়িতে তখন লাশের স্তূপ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে বীভৎস মৃতদেহ সব। গুলিবিদ্ধ ক্ষতবিক্ষত বাবার লাশ দেখে মূর্ছা গেলো ময়না। মৃত হাজি দম্পতিকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলো মধু। বেঁচে যাওয়া লোকজন সান্ত্বনা দিলো তাদের। কিন্তু কোথায় যাবে তারা? অনেক চিন্তা করে বেদনাকাতর ময়নাকে মধু নিয়ে গেলো পাবনাতে, ছোটবেলায় ফেলে আসা তার তিক্ত স্মৃতি-বিজরিত পৈতৃক ঠিকানায়। কিন্তু বাবার বাড়িতে ঠাঁই হলো না তাদের। সৎ মায়ের তখন ভরপুর সংসার। চার ছেলে, তিন মেয়ে। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে তারা শ্বশুর বাড়িতে। এক ছেলেরও বিয়ে হয়েছে। তিন ছেলে-মেয়ে এখনও অবিবাহিত। তিনটা ছোট্ট খড়ের ঘরে গাদাগাদি করে থাকে সবাই। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা। উটকো ঝামেলা দেখে সরাসরি না করে দিলো সৎ মা। অগত্যা দূর সম্পর্কের এক চাচার বাড়িতে আশ্রয় নিলো মধু-ময়না।

আরও পড়ুন গল্প বৃষ্টিভেজা গোলাপের ঘ্রাণ

কিছু দিনের মধ্যেই বাঙালিদের প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে কিশোর-যুবক দলে দলে ভারতে ছুটলো প্রশিক্ষণ নিতে। জোয়ান মধুর মধ্যেও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলো। ঢাকায় পাক হানাদারদের অমানুষিক হত্যাযজ্ঞ সে দেখেছে। অজস্র মৃত দেহ ডিঙ্গিয়ে পার হয়েছে সে ঢাকা। চোখের সামনে দাউদাউ করে ভষ্মিভূত হয়েছে তার সাধের দোকান, ভবিষ্যতের সকল স্বপ্ন। একটা অদম্য ক্রোধ তার বুকের ফণা তুলে আছে। তীব্র ঘৃণা আর প্রতিশোধের প্রবল আকাঙ্ক্ষা তাকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করে তুলছে। যে করেই হোক এই বর্বর পাকিদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতেই হবে।

কিন্তু ময়নার জন্যে মনটা ওর খুব পোড়ায়। বড্ড লক্ষী মেয়ে সে। সদ্য পিতৃহারা নব পরিনীতা এই মেয়েটা, সব কিছু ছেড়ে তার হাত ধরে গভীর আস্থায় অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়িয়েছে। এখন তাকে একা ফেলে কি করে ভারতে যাবে সে? কদিন মনের সাথে প্রচন্ড যুদ্ধ করলো মধু। একদিকে প্রিয় দেশ, অন্যদিকে পরাশ্রিত নতুন বধু ময়নার প্রতি কর্তব্য, ভালবাসা। গভীর টানাপোড়েন শেষে দেশ মাতৃকার ডাকই অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হল তার কাছে। মনে মনে স্থির সিদ্ধান্ত নিলো, দেশের জন্যে যুদ্ধেই যাবে সে। কোন রকমে ময়নাকে বুঝিয়ে-শুঝিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে মধু চলে গেলো ভারতে।

তার প্রশিক্ষণ হলো দার্জিলিংয়ের পানিঘাটায়, নিবিড় শালবন ঘেরা পাহাড়ি অঞ্চলে। ২১ দিনের কঠোর যুদ্ধ প্রশিক্ষণ শেষে এলাকার একদল গেরিলার সাথে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলো মধু। তাদের দায়িত্ব পড়েছে পাবনায়, নিজেদের পাশের উপজেলাতে। নগরবাড়ি ঘাট ও ওই ট্রুপের এরিয়াতেই। তাদের যে ‘স্কোয়াড লিডার’ তার বাড়িও মধুদের পাশের গ্রামেই। ২/৪ জন ছাড়া অন্যরাও প্রায় সবাই একই এলাকার। মধু ছোটবেলা থেকে ঢাকায় থাকলেও ওদের বাপ-দাদাদের ভালো করেই চেনে সবাই। ফলে খুব সহজেই সবার মধ্যে একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠলো।

আরও পড়ুন গল্প কবর

গেরিলা যুদ্ধের কৌশল ছিল Hit & Run. মধুদের ‘স্কোয়াড’ এর দায়িত্ব ছিলো নগরবাড়ি ফেরিঘাটকে আতংকিত রাখা। সে সময় ঢাকা থেকে উত্তর বঙ্গে যে সব সৈন্য মোতায়েন হয়েছিলো, তার সিংহ ভাগ যাচ্ছিলো নগরবাড়ি ঘাট হয়ে। এই যাতায়াতকে বাধাগ্রস্থ করা, অ্যামবুশে ফেলে পাকি সৈন্যদের হতাহত করা, ভীত-সন্ত্রস্ত রাখাই ছিলো তাদের প্রধান কাজ। পুরো উত্তরবঙ্গে Force Deployment-এ নগরবাড়ি ঘাট মুক্ত এবং নির্বিঘ্ন রাখা পাকসেনাদের কাছে অপরিহার্য ছিলো বলেই ঘাটেই তারা স্থায়িভাবে বেশকিছু সেনা মোতায়েন করেছিলো। ফলে ঘাট এলাকায় ‘অপারেশন’ চালানো মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো। এজন্যে পরিপূর্ণ এবং নিখুঁত ‘রেকি’ করা ছাড়া কোন আক্রমণ মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে মারাত্মক বিপর্যয় হতে পারে বলে তারাও খুব সতর্ক থাকতো।

মধুদের ‘স্কোয়াড’ এর সাথে স্থানীয় প্রশিক্ষিত যুবকেরা যোগ দেয়ায় ক্রমে ক্রমে এটা একটা বিশাল বাহিনীতে রুপ নেয়। বেশ কিছু সফল ‘অপারেশন’ চালাতেও সক্ষম হয় তারা। এলাকার মানুষের মধ্যে তাদের উপর আস্থাও বেড়ে যায়। প্রশংসিত হতে থাকে তারা সবার কাছে। ইতোমধ্যে মধু সাহসী আর নির্ভরযোগ্য হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। এখন কোন ঝুঁকিপূর্ণ সাহসী ‘অপারেশন’ হলেই মধুকে নেয়া হয়। অকুতোভয় আত্মপ্রত্যয়ী মধু ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে বাহিনীর কাছে। কিন্তু সবার অলক্ষ্যে বিধাতা তার জন্যে রচনা করলেন নিষ্ঠুর নিয়তি। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে পাকসেনাদের অ্যামবুশে ফেলতে গিয়ে নিজেরাই Trap-এ পরে যায়। ৮/৯ জন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মধুও শহিদ হন সেই যুদ্ধে।

আরও পড়ুন গল্প রঙিন ঘুড়ি

মধুর মৃত্যু সংবাদ শুনেই মূর্ছা গেল কিশোরী বধু ময়না। সবাই মাথায় পানি ঢেলে, সেবা শুশ্রুসা করে সুস্থ্য করে তুললো তাকে। কিন্তু ততোক্ষণে মাথার উপর থেকে ছাদ সরে গেছে তার। এ বিশ্ব সংসারে তার আর কেউ রইলো না। বাবা গেছেন, স্বামীও তাকে ফেলে চলে গেলো। কি নিয়ে এখন বাঁচবে সে? কার জন্যে বাঁচবে? কি হবে এ জীবন রেখে? নাওয়া খওয়া বাদ দিলো ময়না। আত্মহত্যার কথা ভাবলো সে। উপরে তাকিয়ে দেখলো ঘরের আড়ার সাথে দড়ি বেঁধে সহজেই আত্মহত্যা করা যায়। মনে মনে ঠিক করলো আজ রাতেই সব জ্বালা শেষ করে দেবে সে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মত পাল্টালো ময়না। ঠিক করলো, যে দেশের জন্যে তাঁর স্বামী প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে, সেই দেশের স্বাধীনতার জন্যে সেও যুদ্ধ করবে। মরতে হলে দেশের জন্যেই মরবে সে। যে হানাদার পাকবাহিনী তার স্বামীকে, বাবাকে হত্যা করেছে, তাদের মেরেই মরবে সে। তাতে তার স্বামীর আত্মা শান্তি পাবে। সব ভেবে মুক্তিযুদ্ধে যাবারই সিদ্ধান্ত নিলো ময়না।

বাড়িতে সে যখন তার সিদ্ধান্তের কথা জানালো, একবাক্যে সবাই নিষেধ করলো তাকে। মেয়ে মানুষ যুদ্ধে যাবে এ কেমন কথা? মুরুব্বিরা সবাই রা রা করে উঠলো। কিন্তু অনড় ময়না। সকল নিষেধ অমান্য করে সবার অগোচরে একদিন সকালে সে গিয়ে উঠলো মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে। ক্যাম্পের অনেকেই চিনতো তাকে। তার স্বামীর মৃত দেহ তারাই বহন করে নিয়ে গিয়েছিলো গ্রামে। হঠাৎ ময়নাকে দেখে অবাক হল তারা। আরও বেশি অবাক হল, যখন সে যুদ্ধ করার সংকল্প ব্যক্ত করলো। গ্রামের লোকের মত তারাও বোঝালো ময়নাকে। তাকে বিরত রাখতে যুদ্ধের কষ্ট, ভয়াবহতা, মৃত্যু-ঝুঁকির কথাও বলা হলো তাকে। কিন্তু অবিচল ময়নার সাফ কথা, হয় তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিতে হবে, নয় সে আত্মহত্যা করবে। শিক্ষিত ‘স্কোয়াড লিডার’ ময়নার দৃঢ় সংকল্পের কথা বিবেচনা করেই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিয়ে নিলেন তাকে। গৃহবধূ ময়না হয়ে গেলো ‘মুক্তিযোদ্ধা ময়না’।

আরও পড়ুন গল্প বাক্সবন্দি প্রেম

প্রথম প্রথম ময়নাকে খবর সংগ্রহের কাজে লাগানো হল। এ ব্যাপারে সতর্কতা গ্রহণ, পরিস্থিতি অনুসারে বেশ ধারণ, তথ্য সংগ্রহণের খুঁটিনাটি প্রশিক্ষণ ‘স্কোয়াড লিডার’ই দিলেন তাকে। প্রত্যাশার চেয়েও ভালো কাজ করতে লাগলো ময়না। তার ইনফরমেশনের উপর ভিত্তি করে বেশ কয়েকটি সফল অপারেশনও করা হল। সবাই প্রশংসা করতে লাগলো তার। কিন্তু এতে তৃপ্ত হয় না ময়না। তার বুকের ভিতর প্রতিশোধের প্রজ্বলিত শিখা, স্বামী হন্তারক পাক বাহিনীকে বিনাশের অদম্য প্রতিজ্ঞা। জিঘাংসার মরণ পণ তাকে তাড়িত করছে সর্বক্ষণ। কি করে তৃপ্ত হয় সে? কি করে প্রশমিত হয় বুকের জ্বালা?

একদিন ময়না সরাসরি যুদ্ধ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করলো স্কোয়াড লিডারের কাছে। এতোদিনে তার দৃঢ়- প্রতিজ্ঞ অনমনীয় মনোভাব বুঝে ফেলেছেন তিনি। ময়নাকে যে নিবৃত করা যাবে না, তা তিনি ভালো করেই জানেন। শহিদ মধুর স্ত্রী বলে তাকে তিনি যথেষ্ট সম্মানও করেন। তাই তার প্রস্তাবে সম্মত হয়ে ময়নাকে তিনি পরম যত্নে ৩০৩ রাইফেল, S.L.R, L.M.G চালনা প্রশিক্ষণ দিলেন। গভীর দরদ দিয়ে প্রতিটি অস্ত্র part by part খুলে খুলে দেখালেন, শেখালেন। শেখালেন গ্রেনেড চালনাও।

স্কোয়াড লিডারের নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি অপারেশনে সফলভাবে অংশ নিলো ময়না। তার ‘পজিশন’ জ্ঞান আর নির্ভুল নিশানা দেখে অবাক হল সবাই। মাত্র কদিনের প্রশিক্ষণে এমন সাফল্য আশাতীত। আসলে মানুষ যখন সমস্ত হৃদয়, মন দিয়ে একাগ্র নিষ্ঠা নিয়ে কোন কাজে নিবেদিত হয়, তখন অনেক কঠিন কাজও সহজ হয়ে যায়। ময়নার জীবন-প্রতিজ্ঞা আর কঠোর নিষ্ঠাই তাকে দুর্দমনীয় করে তুলেছিলো। প্রতিশোধের সুতীব্র যন্ত্রণা থেকেই জীবন বাজি রেখে তার যুদ্ধ করা। ‘হয় শত্রু নিধন, না হয় শরীর পতন’ এই যখন হয় সাধনা, তখন দুরুহ লক্ষ্যভেদও অনায়াসসাধ্য হয়ে যায়, দুর্জয়কে জয় করা সহজ হয়ে ওঠে। এখন ক্যাম্পের সবাই তাকে সমীহ করে, প্রশংসা করে, অপারেশনে তার অসামান্য ভূমিকার কথা তুলে ধন্যবাদ জানায়। ‘স্কোয়াড লিডার’ও তাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেন। কোন জটিল ‘রেকি’ হলে পাঠানো হয় তাকে, কঠিন অপারেশন হলেও তার সাথে আলোচনা করেন।

আরও পড়ুন গল্প স্বর্ণলতা

ময়নাও অনেকগুলো সফল অপারেশনে অংশ নিয়ে, অনেক বেশি আত্মপ্রত্যায়ী হয়ে উঠেছে। সে নিজ হাতে গুলি করে, বেয়োনেট চার্জ করে বেশ কিছু পাকসেনাকে হত্যা করেছে। আগে গরু জবাই করা দেখে যে ময়না শিউরে উঠতো, সে এখন অনায়াসে গুলি করে উড়িয়ে দিতে পারে খুলি, বেয়োনেটে পেট চিড়ে বেড় করে আনতে পারে রক্তসিক্ত নাড়িভুঁড়ি। মহিলা বলে এখন আর তার মধ্য কোন জড়তা নেই, দ্বিধা নেই। কেউ আর অপাংতেয় ভেবে চোখ সরু করে তাকায় না তার দিকে। বরং স্কোয়াডের জন্যে সে এখন গুরুত্বপূর্ণ অকুতোভয় সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু চূড়ান্ত বিজয় যখন সন্নিকটে, স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য যখন উঁকি দিচ্ছে পুবের আকাশে, ঠিক তখনই নভেম্বরের শেষ দিকে এক অপারেশনে শত্রুপক্ষের রকেটের গোলার আঘাতে উড়ে গেলো ময়নার ডান পা। হাঁটুর নিচের অংশ একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। প্রাণে বাঁচলেও চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হল তাকে।

১৬ ডিসেম্বরে স্বাধীন বাংলাদেশ যখন আনন্দ জোয়ারে ভাসছে, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা ময়না তখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। রণাঙ্গনের সাথী মুক্তিযোদ্ধারা এসেছিলো ফুলের মালা নিয়ে, ধরাধরি করে তাকে তারা নিয়ে গিয়েছিলো হাসপাতালের বাইরে মুক্ত প্রাঙ্গণে। চোখে তার আনন্দাশ্রু। স্বাধীন দেশের নির্ভার মুক্ত নীলাকাশ, দিগন্ত বিস্তৃত নিঃসীম শ্যামল প্রান্তর। অনাবিল মুক্ত বাতাসে সেদিন খুব ভালো লেগেছিলো তার। এই স্বাধীন দেশের জন্যেই শহিদ হয়েছেন তার স্বামী, বাবা, হাজি সাহেবের পরিবার, মুক্তিযোদ্ধা, অগণিত বাঙালি নারীপুরুষ। সেদিন খুব বেশি মনে পড়ছিলো তার স্বামী মধুর কথা। যেদিন সে মুক্তিযুদ্ধে যাবার জন্যে বাড়ি ছাড়লো, সেই বিদায়লগ্নে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিলো ময়না। ‘আবার আসবো’ বলে সেই যে মধু বেড়িয়ে গেলো, আর আসেনি। এসেছিলো তার লাশ, ময়নার চির বৈধব্যের পরোয়ানা।

আরও পড়ুন গল্প বিপরীত

ভাবতে ভাবতে চোখ ভিজে ওঠে তার। ছলছল চোখে সে তাকিয়ে দেখে হাজার হাজার মানুষ উচ্ছ্বল আনন্দে মেতেছে আজ, স্বাধীন বাংলাদেশের ছোট ছোট পতাকা হাতে মিছিল করছে তারা, বাজি-পটকা ফোটাচ্ছে, একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করছে। অফুরন্ত আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছে ছোট্ট শিশু-কিশোররাও। চোখ বন্ধ করে বুক ভরে প্রশান্তির মুক্ত বাতাস নেয় ময়না। নিমিষেই ভুলে যায় সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে পা হারানোর কথা, স্বামী বিয়োগের বেদনা। বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতা’ প্রাপ্তি তার সকল কষ্ট, সকল বেদনা-গ্লানি মুছে দিয়ে ভগ্ন হৃদয়ে আবার নতুন করে আশার সঞ্চার করে, বুকের মধ্যে হতাশা জর্জরিত স্বপ্নগুলো ডানা ছড়িয়ে উঁকি দিয়ে ওঠে। নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছে করে ময়নার।

আরও পড়ুন তিনি একজন মহিলা মুক্তিযোদ্ধা-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
শেষ পর্ব

 

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

তিনি একজন মহিলা মুক্তিযোদ্ধা (৪র্থ পর্ব)

Facebook Comments Box

খলিফা আশরাফ জীবন ঘনিষ্ঠ একজন কবি ও গল্পকার। তাঁর লেখায় মূর্ত হয়ে ওঠে সমসাময়িক কাল, মূল্যবোধের অবক্ষয়, নৈতিকতার বিপর্যয় এবং মানুষের অভাবিত সার্থলোলুপতার ক্লিষ্ট চিত্র। তিনি বৈরী সময়কে গভীর ব্যঞ্জনায় অনুপম রূপায়ন করেন তাঁর লেখায়, সামাজিক অন্যায় অসঙ্গতি এবং নির্মমতার কারুণ্য ফুটিয়ে তোলেন অন্তর্গত তীক্ষ্ম অনুসন্ধিৎসায়। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: বিপরীত করতলে, কালানলে অহর্নিশ, অস্তিত্বে লোবানের ঘ্রাণ; গল্পগ্রন্থ: বিল্লা রাজাকার ও সেই ছেলেটি, অগ্নিঝড়া একাত্তুর, একাত্তরের মোমেনা, পাথরে শৈবাল খেলে; ছড়াগ্ৰন্থ: ভুতুড়ে হাওয়া, কাটুশ-কুটুশ। তিনি  ১৯৫২ সালের ১ জানুয়ারি, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। 

error: Content is protected !!