তিনিদ-একজন-মহিলা-মুক্তিযোদ্ধ-২য়-পর্ব
খলিফা আশরাফ (গল্প),  গল্প,  মুক্তিযুদ্ধ,  সাহিত্য

তিনি একজন মহিলা মুক্তিযোদ্ধা (২য় পর্ব)

তিনি একজন মহিলা মুক্তিযোদ্ধা (২য় পর্ব)

খলিফা আশরাফ

 

গরিব মুদি দোকানদার সহ-মুক্তিযোদ্ধা শফি সাহেব, তাঁর ঘরের বারান্দায় থাকতে দিয়েছেন বীর মহিলা মুক্তিযোদ্ধাকে। বাঁশের চাটাই দিয়ে চার পাশটা ঘিরে দিয়ে একটা ঘরের মতো করা হয়েছে। সেখানেই থাকেন তিনি। কোন ভাড়া দিতে হয় না। শুধু তিন বেলা খাবারের জন্যে প্রতি মাসে যা পারেন দেনতিনি। তাও ধরাবাঁধা কিছু নেই। কোন মাসে একেবারেই দিতে পারেন না। আবার কোন মাসে হয়তো প্রয়োজনে মুক্তিযোদ্ধা ভাতার পুরোটাই দিয়ে দেন। এ নিয়ে আশ্রয়দাতার কোন অনুযোগ বা চাহিদা নেই। একজন অসহায় সহ-মুক্তিযোদ্ধাকে যে তিনি সহযোগিতা করতে পারছেন, সেটাই বড় কথা তার কাছে। বরং সবিনয়ে তিনি বলেছেন,
“আপা, আমি গরিব মানুষ, আপনাকে হয়তো আমি যোগ্য সম্মানে রাখতে পারবো না। তবে আমি বেঁচে থাকতে আপনার কোন অমর্যাদা হবে না। যতদিন আপনি থাকবেন বড়, বোনের মতো মাথায় করে রাখবো আমি।”
এই উদার মানুষটা আপন বোনের মতোই শ্রদ্ধা করেন তাঁকে। ছেলেটাও ফুপু বলে ডাকে, খুব ভালবাসে। একেবারে আপনের মতো। এই পরিবারের উদারতার কথা বলতে বলতে চোখে পানি এসে গেলো তাঁর। অভাব অনটনের সংসারে যাতে তাঁর কোন অসুবিধা না হয়, সেদিকে সবাই খেয়াল রাখেন। বউটাও বেশ ভালো। খুব সম্মান করে তাঁকে। বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সবার কাছে গর্ব ভরে পরিচয় করিয়ে দেয়, তাঁর বীরত্বের গল্প শুনায়। তিনি যেন এ পরিবারের গর্বের ধন। এদের সবার ভালবাসা পেয়ে, অনেক হারানোর ব্যথার কিছুটা হলেও ভুলতে পেরছেন তিনি৷

আমরা বাসার কাছে পৌঁছুতেই এক অবুঝ শিশু ‘ফুপু’, ‘ফুপু’ বলতে বলতে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো তাঁকে। কোনো মতো বগলে ক্র্যাচটা চেপে ধরে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিলেন তিনি। ওই একটিই সন্তান দম্পতির। তাও এসেছে অনেক দেরিতে, হাজার রকম চিকিৎসার পরে। যখন তারা সন্তানের আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন, তখনই প্রায় পৌঢ় বয়সে আল্লাহর রহমতে কোল জুরে জন্ম নিলো ফুটফুটে ছেলেটি। মা-বাবার চোখের মনি শিশুটা আবার খুব বেশি ফুফু-নেউটা। ফুফু থাকলে মায়ের কাছেও যেতে চায় না। নিঃসন্তান ময়নাও, তার সকল স্নেহ-মমতা উজাড় করে দিয়েছে। বুক দিয়ে আগলে রাখেন সারাক্ষণ।

আরও পড়ুন গল্প পুরাতন বটবৃক্ষ

ফুফুর কোলে উঠেই ৪/৫ বছরের শিশুটি কলকল করে বলে উঠলো,
“ফুপু তুমি দেরি করছো ক্যান? আমারে ভাত খাওয়ায়ে দিবো ক্যাডা?”
শিশুটির গালে চুমু খেয়ে তিনি বললেন,
“আহারে আমার সোনামণি, চলো অহুনি তুমারে খাউয়াইয়া দিমু।”
খুশিতে একেবারে ডগোমগো হয়ে উঠলো শিশুটি। ওকে কোলে নিয়ে ক্র্যাচে ভর করে বারান্দার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন,
“আহো বাবা।”
শিশুটিকে কোল থেকে বিছানায় বসিয়ে হাত ধুয়ে এলেন তিনি। সাথে সাথে খাবার নিয়ে এলেন গৃহিণী। থালায় ভাত, একপাশে ডিমের তরকারি আর বাটিতে ডাল। ঘোমটা টেনে তিনি বললেন,
“ওরে কতো কইরা কইলাম, ল আমি খাউয়াইয়া দেই, খাইল না। কয়, ফুফুর হাতে খামু। পোলাডা আপনারে ছাড়া ঘুমাইবারও পারে না।”
শিশুটা ততোক্ষণে ফুফুর কোলে জেঁকে বসেছে। অনেক পরে মাঝ বয়সে এসে সন্তান লাভ করেছেন ওই মুক্তিযোদ্ধা। তাই বাচ্চাটা সবারই খুব আদরের। ওকে খাওয়াতে খাওয়াতেই তিনি বললেন,
“ভাবী, এইডা আর এক মুক্তিযোদ্ধার পোলা। আমারে বাসের মইধ্যে দেইখ্যাই লগে আয়া পড়ছে। কয়, আপনার গল্প শুনুম। কি পাগলামি, কও তো?”
“আইবই তো, মুক্তিযোদ্ধার পোলা না? আপন-পর তো হেরা চিনবোই। আচ্ছা, আপনারা বন, আমি আপনাগো খাওন নিয়া আহি।” ভেতরে চলে গেলেন তিনি।
কিছুক্ষণ পরেই খাবার এসে গেলো। একেবারে সাধারণ খাবার। শাক ভাজি, আলু দিয়ে ডিমের তরকারি আর ডাল। কোন ‘ডাইনিং টেবিল’ নয়, বিছানার উপর একটা চাদর পেতে তাতেই খাবার দেয়া হলো। সংকোচ করে তিনি বললেন,
“বাবা আমরা গরিব মানুষ, খাওনও গরিব, একটু কষ্ট করে খাও বাবা।”
আমি তাড়াতাড়ি বললাম, “কি যে বলেন আন্টি! আমরাও গরিব। পঙ্গু বাবা অনেক কষ্ট করে সংসার চালান। আমাদের কাছে এটাই অনেক ভালো খাবার।”

আরও পড়ুন গল্প সাদা কাগজে প্রেম

তিনিই থালায় ভাত, তরকারি বেড়ে দিলেন। ঘরে কোন ফ্যান নেই। আমি ঘামছি দেখে, তিনি তাড়াতাড়ি ঘর থেকে হাতপাখা এনে বাতাস করতে লাগলেন আমাকে। আমার তখন খুব মায়ের কথা মনে পরছিলো। মা অনেক দিন আগে মারা গেছেন। তিনিও খাবার দিয়ে আমাকে-বাবাকে এমনি করেই বাতাস করতেন। আজও যেন হাতপাখার বাতাসে মায়ের স্পর্শ অনুভব করলাম। অজান্তেই চোখ ভিজে উঠলো আমার। আমি মাথা নিচু করে সংগোপনে অশ্রু আড়াল করার চেষ্টা করলাম।

খাবার পরে শুনলাম বীর মহিলা মুক্তিযোদ্ধার করুণ জীবন গাঁথা। তাঁর স্বামী মধু মণ্ডলের বাড়ি ছিল, পাবনা জেলার সুজানগর থানার নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নে। বাবা নোয়াই মণ্ডলের অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। এদিক-ওদিক টুকটাক করে কায়ক্লেশে সংসার চলতো। তাই লেখাপড়া তেমন করতে পারেনি সে। ক্লাস ‘ফাইভ’ পাশ করলেও টাকার অভাবে বেতন দিয়ে হাই স্কুলে আর পড়া সম্ভব হয়নি তার। অভাবের সংসারে বাবা তাকে সামান্য বেতনে এক গেরস্থের বাড়িতে রাখালের কাজে লাগিয়ে দিলো। কিন্তু এ কাজে মন দিতে পারেনি সে। ফলে কাজে অবহেলার জন্যে প্রায়ই মালিকের হাতে মার খেতে হত বালক মধুকে। বাবাকেও কাজ ছাড়ার কথা বলতে সাহস হত না তার। একবার কাজে না গিয়ে বাড়িতে থাকায় বেশ মেরেছিলো বাবা তাকে। ঠোঁট কেটে রক্ত পড়েছিলো অনেক। সেই রক্তাক্ত অবস্থায়ই জোড় করে পাঠানো হয়েছিলো রাখালের কাজে।

খুব ছোট রেখে তার মা মারা যাবার পর, বাবা আবার বিয়ে করেছে। আরও একটা ছোট বোন হয়েছে তার। সৎ মায়ের কাছে সান্তনার জায়গাও ছিলো না তার। বরং সৎ ছেলে হিসেবে আপদই ভাবতো তাকে। মাতৃ আদর কোনদিন জোটেনি তার কপালে। বাবার কাছেও আবদারের স্থান সংকুচিত হয়েছে। বরং তার বেতনের টাকা প্রাপ্তি আর ভরণপোষণের দায়মুক্তি, বাবার অভাবের সংসারে সহায়তাই করছিলো। ছেলের ভালো লাগা না লাগার তোয়াক্কা করেনি সে কোনদিন। এ নিয়ে ভেতরে ভেতরে খুব ক্ষুব্ধ ছিলো বালক মধু। প্রচণ্ড অনিচ্ছা আর অশান্তি নিয়ে রাখালের কাজ করতো সে। সব সময় মাথার মধ্যে পালিয়ে যাবার চিন্তা কাজ করতো তার।

আরও পড়ুন গল্প চোখে দেখা নীলকণ্ঠ

একদিন সুযোগও এসে গেলো। তার দূর সম্পর্কের এক মামা কাজ করতো ঢাকায়। সব শুনে মধুকে ঢাকায় নিয়ে আসতে রাজি হলেন তিনি। বাবাকে কিছু না জানিয়ে সেই আত্মীয়ের সাথে জীবিকার অন্বেষণে একদিন ঢাকায় চলে এলো মধু। তিনিই এক দোকানে পেটে-ভাতে ফুটফরমায়েশের চাকুরি নিয়ে দিলেন তাকে। শুরু হল মধুর নতুন জীবন, সংগ্রামের জীবন। এরপর মধু আর কোনদিন গ্রামের বাড়িতে যায়নি। হয়তো মা না থাকাতেই, কোন টানও অনুভব করেনি সে। সৎ মা আর বাবার দুর্ব্যবহার তার কোমল শিশু মনকে বিষিয়ে তুলেছিলো। মাঝে মাঝে বাড়ির জন্যে মন খারাপ হলেও কষ্ট আর বঞ্চনার স্মৃতি বারবার তাকে বিরত রেখেছে বাড়ি যেতে।

দোকানের মালিক ছিলেন ঢাকাইয়া। হাজি মানুষ। খুব ভালো। দিল দরিয়া টাইপের। ছোট্ট মধুকে বেশ স্নেহ করতেন তিনি। তার বাড়িতেই থাকার জায়গা হল মধুর। বাড়ির গৃহিনীও মধুকে আদর করতো। মধু তাকে ডাকতো ‘আম্মা’ বলে। মধু ছিলো স্নেহের কাঙ্গাল। মায়ের ভালবাসার স্পর্শ তার কাছেই পেয়েছে মধু। মধুকে তিনি সন্তানের মতোই স্নেহ করতেন। ভালবাসা বঞ্চিত মধুর বুভুক্ষু হৃদয়ে প্রশান্তির ছোঁয়া লাগলো। মনপ্রাণ ঢেলে দিলো সে তার কাজে। বিশ্বাসী মধু কিছুদিনের মধ্যেই তার পরিশ্রম আর বিশ্বস্ততা দিয়ে মালিকের মন জয় করলো। এক বছর যেতে না যেতেই মধুকে তিনি ‘সেলস ম্যান’ করে কাজে লাগিয়ে দিলেন। মাসিক বেতনও ধরা হল। এতো ছোট বাচ্চাকে সেলসের দায়িত্বে দেয়ায় অনেকে অবাক হলেও, পাকা ব্যবসায়ী হাজি সাহেব হিসেবে ভুল করেননি। অল্পদিনেই মধু তাঁর যোগ্যতা-বিশ্বস্ততা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছিলো।
আগে থেকেই মালিকের বাড়িতেই মধুর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ছিলো। এবার বেতনটা এলো উপরি। বুদ্ধিমান মধু বেতনের টাকা খরচ না করে মালিকের কাছেই জমাতে শুরু করলো। ওর কাজে হাজি সাহেব আগে থেকেই খুশি ছিলেন। এবার তার আক্কেল দেখে মালিকের স্নেহ আরও বেড়ে গেলো। পুরো দশ বছর মধু ‘সেলস ম্যান’ হিসেবে কাজ করলো সেই দোকানে। এরমধ্যে তার বেতনও বেড়েছে ধাপে ধাপে।

আরও পড়ুন তিনি একজন মহিলা মুক্তিযোদ্ধা-
১ম পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
শেষ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

তিনি একজন মহিলা মুক্তিযোদ্ধা (২য় পর্ব)

Facebook Comments Box

খলিফা আশরাফ জীবন ঘনিষ্ঠ একজন কবি ও গল্পকার। তাঁর লেখায় মূর্ত হয়ে ওঠে সমসাময়িক কাল, মূল্যবোধের অবক্ষয়, নৈতিকতার বিপর্যয় এবং মানুষের অভাবিত সার্থলোলুপতার ক্লিষ্ট চিত্র। তিনি বৈরী সময়কে গভীর ব্যঞ্জনায় অনুপম রূপায়ন করেন তাঁর লেখায়, সামাজিক অন্যায় অসঙ্গতি এবং নির্মমতার কারুণ্য ফুটিয়ে তোলেন অন্তর্গত তীক্ষ্ম অনুসন্ধিৎসায়। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: বিপরীত করতলে, কালানলে অহর্নিশ, অস্তিত্বে লোবানের ঘ্রাণ; গল্পগ্রন্থ: বিল্লা রাজাকার ও সেই ছেলেটি, অগ্নিঝড়া একাত্তুর, একাত্তরের মোমেনা, পাথরে শৈবাল খেলে; ছড়াগ্ৰন্থ: ভুতুড়ে হাওয়া, কাটুশ-কুটুশ। তিনি  ১৯৫২ সালের ১ জানুয়ারি, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। 

error: Content is protected !!