জোছনা-মাখা-আলো-২য়-পর্ব
এ কে আজাদ দুলাল (গল্প),  গল্প,  সাহিত্য

জোছনা মাখা আলো (২য় পর্ব)

জোছনা মাখা আলো (২য় পর্ব)

এ কে আজাদ দুলাল

 

একটা জিনিস শামিমের চোখে পড়ে ঘরে ঢুকতেই তা হলো, সামনে দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর একটা ছবি টাঙানো এবং তার পাশে একটু নিচে পাঁচজনের একটা গ্রুপ ছবি। তাদের হাতে যুদ্ধকালীন ব্যবহৃত অস্ত্র। কি সুন্দর উজ্জ্বল সাহসী যুবক। এক নজরে শামিম সব দেখে নিয়েছে। ভেতরে হয়ত আরো দু’তিনটি ঘর বা রুম থাকতে পারে। সব মিলে রুচি সম্পন্ন ভদ্র লোকের বাসগৃহ। গ্রামে এ রকম পরিবেশ খুব কমই চোখে পড়ে। দুজন দুটো চেয়ারে বসে পড়ে। ডান দিকে দরজা দিয়ে মুরুব্বি ভেতরে গেলেন। হয়ত তিনি তার মেয়ের অনুমতি নিয়ে ফিরে আসবেন।

প্রায় পনের মিনিট পর গায়ের পোশাক পাল্টিয়ে এলেন। গায়ে কোন পাঞ্জাবী নয়, আগের ফতুয়ার মতো একটু দামী এবং পরনে আগের লুঙ্গি আছেই। খাটের পাশে একটা ইজিচেয়ার আছে। তবে ইজিচেয়ার বলতে যা বোঝায় তা নয়। বৃদ্ধ মানুষের বসার জন্য আরামদায়ক ব্যবস্থা করা মাত্র। ইজিচেয়ারে বসে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন,
—বাবা, ডিসেম্বর মাস এলেই কত কিছিমের লোক আসে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে। মনের আনন্দে বলতাম সেই অগ্নিঝরা দিনের কথা। এখন দেখি এ সব কাদের বলি। মানুষ পথ হারিয়ে ফেলেছে।

আরও পড়ুন গল্প মামৃত্যু

কথা শেষ না হতেই একজন যুবতী একটা ট্রে হাতে করে ঘরে ঢোকে। বয়স আন্দাজ করা কঠিন। বেশ সপ্রতিভ সুদর্শনা। শহরের মেয়ে হলে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। গ্রামের মেয়ে তাই ফর্সা। মানানসই লম্বা। মেয়েদের এটাই মানায়। চুলের বাহারি আছে। একদম কোমর অব্দি পড়েছে। গায়ে হালকা গোলাপি রঙের কামিজ, পরনে কালো সালোয়ার এবং গায়ে গলার দু’পাশ কাঁদ ওপর দিয়ে কোমর পর্যন্ত কালো ঔড়না। না, কোন রকমের প্রসাধনী ব্যবহার করেনি। প্রথম দর্শনেই শামিমের চোখে ধরেছে। টেবিলের ওপর ট্রে খানা নামিয়ে তিনটি চায়ের কাপ; তার বাবাসহ দুই ভাইয়ের সামনে রেখে দিলো। আলাদা তিনটি মেলামাইলের তৈরি বাটিতে সরিষা-তেল-আদা দিয়ে মাখানো যাকে বলে ঝালমুড়ি; সামনে রেখে একটু কর্কশ সুরে বললো,
—আপনারা আমার বাবার মেহমান। তাই আমাদের সাধ্য মতো যা আছে তাই দিয়ে আপ্যায়ন করছি। দয়া করে খেয়ে আসতে পারেন। বাবার সাথে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোন কথা হবে না।
শামিম বুঝতে পারছে কোথাও কোন গলদ আছে। তাই এই ঝালমুড়ি দিয়ে ঝাল মেটাচ্ছে। যুবতীর রাগ হজম করতে হবে। কিন্তু চেহারার সাথে কথাবার্তা বেমানান। ছয় মাস যাবৎ ছাত্র-ছাত্রী পড়াচ্ছে। কিছুটা হলেও মেয়েদের আচরণ আর চেহারার মধ্যে পার্থক্য বুঝতে শিখেছে। আর সহজে কারো বিষয়ে মন্তব্য করা বা খারাপ ধারণা করা ঠিক নয়। এর শেষটা কোথায় জানতে হবে।
—তোমরা চা-নাস্তা খাও। তারপর কথা হবে।
—বাবা, কথা হবে কিন্তু তোমার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোন কথা নয়।

তামিম মেয়েটিকে পর্যবেক্ষণ করছে। সে কি কোন বিশ্ববিদ্যালয় হতে পাশ করা অহংকারী মেজাজী মেয়ে। আবার চেহারাটা দেখে সে রকম হচ্ছে না বরং শান্ত স্বভাব হবে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কোন কথা বলা যাবে না। অথচ, বড় ভাইয়ের সাথে এসেছে একজন জীবন্ত মুক্তিযোদ্ধার সাথে আলাপ করার জন্য। দেখা যাক বড় ভাই কিভাবে পরিস্থিতি সামলে নেয়।

আরও পড়ুন গল্প পরাজিত নাবিক

—দেখুন, আপনি কিন্তু অযথা রেগে যাচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কোন কথাই কিন্তু আমরা উঠাইনি। ভালো কথা আমাদের পরিচয়টা আপনাদের জানা দরকার। আমার নাম শামিম ইকবাল, এমপিওভুক্ত একটা কলেজের পদার্থ বিজ্ঞান পড়াই। আর এ হলো আমার ছোট ভাই তামিম ইকবাল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩য় বর্ষ আইন বিভাগে পড়ে। আর গ্রামের নাম পদ্ম নগর। যদিও আমাদের গ্রামে কোন দিন পদ্ম ফুল ফুটতে দেখিনি। আবার কেনোই যে গ্রামের নাম পদ্ম নগর রাখা হয়েছে সে ইতিহাস জানা হয়নি।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য শামিম একটু কৌশলী হলো। পদ্ম নগরের নাম শুনে মুরুব্বি একটু নড়েচড়ে বসলেন। তিনি পদ্ম নগর চেনেন বটে তবে প্রায় চল্লিশ বছর ও দিকে যাওয়া হয় না। শুনেছেন এলাকাটা বেশ উন্নত এবং অনেক শিক্ষিত ব্যক্তি আছেন। দু’ভাইয়ের আসার কারণ জানতে চাইলেন। মেয়েটির দিকে নজর দিতেই মনে হলো বরফ গলতে শুরু করেছে। চেহারার ভেতরে আগের মতো উগ্রভাব নেই। বিকেলের মিষ্টি আলো এসে পড়েছে তার মুখমন্ডলে। দেখতে আরো সুন্দর লাগছে। তবে সে যে দাম্ভিক মেয়ে নয় চেহারা দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। এ বার সে মুখটা নিচু করে বলল,
—মাফ করবেন। আসলে পরিস্থিতি আমাদের এ রকম আচরণ করতে শিখিয়েছে।
পাশে তামিম উৎসাহের সাথে জানতে চাইলো,
—আপা, ঠিক বুঝলাম না।
—আমার ডাক নাম আলো। গত দু’বছর আগে বিএ পাস করে একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতা করছি। সরকারি চাকরি হবে না তাই আর ও পথে যাওয়ার চেষ্টা করিনি। ওটা আমাদের জন্য নয়।
—কেন? শামিম জানতে চাইলো।
—বেশ ক’টা চাকরির জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলাম। পাসও করলাম। মৌখিক পরীক্ষা দিলাম, চাকরি হলো না। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় অন্য একজনের চাকরি হয়ে গেলো। আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আজও পর্যন্ত কোন সনদ পাননি। মানে সরকারি গেজেটে নাম প্রকাশিত হয়নি তাই তিনি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নন। আমাদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কোটা চির দিনের বন্ধ, তাই ও দিকে আর এগুতে ইচ্ছে করেনি। মেয়ে মানুষ তো সমাজে অত মূল্য নেই। তবে স্কুলে বেশ ভালো আছি এবং মাস গেলে নিয়মিত বেতন পেয়ে থাকি।

আরও পড়ুন তবুও ভালোবাসলাম

—সে কি, আমরা তো ওনার নাম অনেকের কাছে শুনেছি।
—শোনা এক কথা আর প্রমাণাদি আরেক কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে মেরিট লিষ্টে নাম থাকার সত্বেও মুক্তিযোদ্ধা সনদ না দেখানোর জন্য ভাল সাবজেক্টে ভর্তি হতে পারিনি। তাই রাগে পাস কোর্স ভর্তি হয়ে বিএ ডিগ্রি নিয়েছি। আরো শুনবেন? আমার বড় দুই ভাই তারা আমার মতো পড়াশোনা করে সরকারি চাকরি পায়নি। বেসরকারি অফিসে চাকরি করেন। ঢাকায় স্বপরিবারে বসবাস করেন। তবে আমাদের ভরণপোষণ বাবদ খরচ পাঠাতে কৃপণতা করে না। অনেক দুঃখ আছে,কষ্ট আছে আর আছে অপমান। বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো আলো। এ যেন তার বাবার একার কষ্ট নয় গোটা পরিবারের কষ্ট। আলো তার ঔড়না দিয়ে চোখ মুছে তাদের কষ্টের কথা দ্বিধাহীনভাবে বলতে বলতে শুরু করে।
—জানেন, ডিসেম্বর মাস আসলেই সাংবাদিক নামে কত মানুষের আনাগোনা হয়। বাড়িতে হাট বসে যেত। সবাইকে চা-নাস্তা তৈরি করে দিতে আমার পড়াশোনা ব্যাহত হত। গর্ব করতাম আমাদের বাবা মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু ডিসেম্বর মাস শেষ আর সব আনাগোনাও শেষ। বাবাকে নিয়ে লেখা হত, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তাকে কেন তালিকা ভুক্ত করা হচ্ছে না, ব্যাস এখানেই শেষ।

আরও পড়ুন গল্প রাজামারা

সাত মার্চ এলেই বাবা সারাদিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনেন আর পনের আগস্ট আসলেই রাতভর কাঁদতে থাকেন। এখান থেকে মাইল দেড়েক দক্ষিণে যান দেখতে পাবেন বিল্ডিং ওয়ালা একটা বাড়ি। তিন ছেলে কোনো রকম এসএসসি পাস করে পুলিশে ঢুকেছে, তাদের বাবার মুক্তিযুদ্ধ সনদের জোরে। বাবা বলেন, রহিম আবার কবে কোথায় ট্রেনিং নিয়েছিলো এবং কার কমাণ্ডে যুদ্ধ করেছে? জানেন, এ এলাকার লোকজন ব্যঙ্গ করে বলে “আসল মুক্তি পায় না ভাত, দুই নম্বরীর অভিজাত।” এটাও শোনা যাচ্ছে রহিমের ছোট ভাইয়ের নাকি নতুন তালিকায় নাম উঠেছে।
—কেন নতুন তালিকায় আপনার বাবার নাম নেই?
—সে আরেক কাহিনী। আমি তখন এসএসসির পরীক্ষার্থী। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অফিসে যাচাই বাচাই হবে। আমাদের ইউনিয়নের আবেদনকারীদের ডাকা হয়েছে। বাবার সঙ্গে আমি গিয়েছিলাম। যাচাই-বাছাই বোর্ডে দু’জন ভদ্রলোক দেখিয়ে বাবা বললেন, ক্যাম্পে এদের সঙ্গে বেশ ক’দিন ছিলেন। তারপর ট্রেনিং শেষে একজন কমান্ডারের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধার সাথে বাবা বাংলাদেশের ভেতরে এসে বিভিন্ন স্থানে অপারেশনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বাবার বড় আশা ছিলো এবার তার নাম তালিকাভুক্ত হবে। কিন্তু আশাভঙ্গ হলো আর তালিকায় নাম উঠলো রহিমের ছোট ভাইয়ের।

আরও পড়ুন জোছনা মাখা আলো-
১ম পর্ব
৩য় পর্ব
শেখ পর্ব

 

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

জোছনা মাখা আলো (২য় পর্ব)

Facebook Comments Box

এ কে আজাদ দুলাল মূলত একজন গল্পকার। এছড়াও তিনি কবিতা ও উপন্যাস লিখছেন। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: বিবর্ণ সন্ধ্যা, তুমি রবে নীরবে; উপন্যাস: জোছনায় ভেজা বর্ষা। তিনি ১৯৫১ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালী ইউনিয়নের নুরুদ্দীনপুর গ্রাম তাঁর পৈতৃক নিবাস ।

error: Content is protected !!