জোছনা মাখা আলো (১ম পর্ব)
জোছনা মাখা আলো (১ম পর্ব)
এ কে আজাদ দুলাল
হেমন্ত কাল চলছে। বর্ষা-শরৎ শেষ হলেও হেমন্তে বর্ষায় প্লাবিত ডুবে যাওয়া খাল-বিল এখনো পানিতে থৈ থৈ। গ্রামের নিচু জায়গা নরম কাঁদায় তুলতুলে মাটি। কেমন যেন একটা মিষ্টি গন্ধ শামিমের নাকে এসে ঢোকে । গন্ধটা খারাপ লাগছে না শামিমের। এমন গ্রাম বাংলা পৃথিবীর অন্য কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি” জাতীয় সংগীতের লাইনটি মনের ভেতরে বেজে ওঠে। এই তো মাস ছয় হলো এমপিও ভুক্ত কলেজে পদার্থ বিজ্ঞানে প্রভাষক পদে যোগদান করেছে। হাতের নাগালেই কলেজ।
মায়ের ইচ্ছে তাকে বাড়িতে থাকতে হবে। আর বাবার ইচ্ছে ছোট ভাই তামিম একজন নামকরা আইনজীবী হোক। তাই ছোট ভাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে তৃতীয় বর্ষ অর্নাসের ছাত্র। আর ছোট বোন তার নিজের ইচ্ছে ভালো গৃহিণী হবে। সে এখন নবম শ্রেণির ছাত্রী। শামিমের বাবা একজন প্রান্তিক কৃষক। কৃষক পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে। তার বয়স এখন ষাটোর্ধ। বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণ তার জীবনের সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর ভাষণ। বঙ্গবন্ধু ভাষণে বলেছিলেন- “আমার কৃষক আমার শ্রমিক” এমন করে কে বলতে পারে? বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যার কথা মনে হলেই সারাদিন মন খারাপ করে চুপচাপ থাকে।
শামিম বর্তমান রাজনীতির ধারের কাছে নেই। ভাগাভাগির বেলায় সবাই একজোট। নির্বাচনের সময় মার্কা নিয়ে হৈচৈ। আর্দশের বালাই পর্যন্ত নেই। তাদের কাছে একটাই আর্দশ, নেতা হও পেট ভরো। এ যুগের ছেলে হলেও নিজের পাঠ্য বই ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অনেক বই পড়েছে। জেনেছে একাত্তরের ভেতরে-বাইবে। ‘৪৭ ভারত ভাগ হওয়ার কাহিনী। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের কাহিনী। ছোট ভাই ঠিক তার বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। বাবার রোগ মাথায় ঢুকেছে।
আরও পড়ুন গল্প বড় বাবা
বাবার উৎসাহে মাঝে মধ্যে খেই হারিয়ে ফেলে। অযথা তর্কে জড়িয়ে একবার তো মার খেয়েছিল। তাই প্রতিজ্ঞা আইনজীবী হবে। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে তারও দায়িত্ব আছে। সে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করে । একটা কলেজে পড়ায়। খেয়াল করেছে ছাত্র-ছাত্রীরা নিজের পাঠ্য বই পড়তে অমনোযোগী। পাস করার পর চাকরি কে দিবে। চাচা- মামার জোর নেই। এই ধারণাটা যে ঠিক নয় তা অনেক নজির দিয়ে বোঝানোর চেষ্ঠা করেছে। মেধা এবং পরিশ্রম করে সাফল্য অর্জন করা যায়। সবক্ষেত্রে মামা-চাচার প্রয়োজন হয় না। এটা অযোগ্য মানুষের কথা। সে মেধা দিয়ে চাকরি পেয়েছে। দিনকাল কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে।
শামিমের দীর্ঘদিনের বাসনা একজন একাত্তের বীর মুক্তিযোদ্ধার সাথে আলাপ করবে, তাদের অভিজ্ঞতার কথা শুনবে। তাদের মা সৈয়দ নাজমুল হকের নাম বলছে। মায়ের অনুপ্রেরণায় নিজ গ্রাম হতে প্রায় মাইল তিনেক দূরে উজানপুর গ্রামের সৈয়দ নাজমুল হকের বাড়ির পথে সাইকেল যোগে রওনা হয়েছে। সঙ্গী ছোট ভাই তামিম। মার উৎসাহটাই বেশি। মা এটাও মনে করিয়ে দিয়েছে যে নাজমুল সাহেবকে সৈয়দ বলা যাবে না। এই সৈয়দ উপাধী তার একদম অপছন্দ। উপাধী অভিজাত বংশ পরিচয় নাকি মানুষে মানুষে দূরত্ব বাড়িয়ে দেয়।
বৃটিশ সরকার ভারতবর্ষের মানুষকে বিভিন্ন উপাধী-খেতার দিয়ে তাদের সমর্থন আদায় করেছে। এ ধারাবাহিকতায় পাক-ভারত স্বাধীন হওয়ার পরও ছিলো। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। এরা আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে। কথায় কথায় বৃটিশ-পাক আমলের তাদের বংশীয় মর্যাদা কথা কাতরস্বরে স্মরণ করে।শুধু সেই আমলে কথা কাতরস্বরে স্মরণ করে থাকে। সৈয়দ বংশীয় উপাধির সাথে তাদের বর্তমান অবস্থা বেমানান। তিনি একজন একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। এই পরিচয় দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। বয়স প্রায় পঁচাত্তর। তবে শামিম তাঁকে কখনো দেখেনি। যা জেনেছে তার বাবা-মার কাছ থেকে। তাও নাকি অনেক বছর হয়ে গেলো তাদের দেখা সাক্ষাৎ নেই। হক সাহেবের সাথে শামিমের বাবার তেমন ঘনিষ্ট সম্পর্ক নেই। তাদের উদ্দেশ্য একজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে আলাপ করা। শামিম সাইকেল চালাচ্ছে আর তামিম সামনে বসা।
আরও পড়ুন গল্প নীরুর মা
দু’পাশের দৃশ্যগুলো মনোমুগ্ধকর। সবুজ ধান খেত। ধান যখন পাকা শুরু করবে মাঠে ভরে ওঠে সোনালী ধান। নাজমুল সাহেবের বাড়ি পোঁছেতে আরও মিনিট পনের মত সময় লাগবে। পথে ক’জন লোকের কাছে হক সাহেবের বাড়ির রাস্তার কথা জেনে নিয়েছে। মোটামুটি এলাকার লোক হক সাহেবকে ভালোই জানে তবে মাস্টার হিসেবে বেশি জানে। সময় এখন চারটার ওপরে। সন্ধ্যার আগেই ফিরতে হবে। মা বার বার বলেছে ভদ্রলোকের সাথে যেন মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হয়।
বাড়ির কাছাকাছি যেতেই সামনে একটা ঝামেলার সম্মুখীন হলো দু’ভাই। সামনে ছোট একটা ছোট্ট খাল। খালের ওপাড়ে সৈয়দ সাহেবের বসত বাড়ি। কিন্তু এই খালটা রাখার স্বার্থকতা খুঁজে পাচ্ছে না শামিম। ইচ্ছে করলেই রাস্তা হতে সৈয়দ সাহেবের বাড়ি পর্যন্ত সুন্দর একটা রাস্তা বা কালভার্ট তৈরি করে নিতে পারে স্থানীয় প্রসাশন। পাতি নেতাদের শোবার ঘর পর্যন্ত পাকা রাস্তা। তবে পারাপারের জন্য আছে জোড়া বাঁশের সাঁকো। সাইকেল নিয়ে পাড় হতে হবে। এ যেন মুক্তিযোদ্ধার বাড়ির সামনে বেরিকেট। তারা সাবধানে সাঁকো পার হয়ে যায়।
বিকেলের সুর্য অনেকটাই পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে, তাপহীন রোদ্দুর। পুবমুখী বাড়ি। দক্ষিণ দিকে দিগন্ত মাঠ। উত্তর দিকে ছোট একটা বিলের মতো। এখনো বর্ষার পানিতে ভরে আছে। ঘোমটা পরা শালুক ফুল পানির ওপর ভাসছে। দেখতে অসাধারণ।
দু’জনকে দেখে একজন বয়স্ক মুরুব্বী বাড়ির বাইরে এসে জানতে চাইলেন তাদের পরিচয় কি। মুরুব্বি দিকে চোখ পড়তেই শামিমের স্থির বিশ্বাস এই ভদ্র লোকই নাজমুল হক হবেন। একহারা মেদহীন শরীর। সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা, মাথা ভরা সফেদ চুল এবং মুখমন্ডল ভরা দাঁড়ি। ঘাড়ে ওপর যেন সাদা বক বসে আছে। তবে সফেদ চুল-দাঁড়িতে পরিপাটি। চেহারার সাথে মানানসই। পাওয়ায় ওয়ালা চশমা চোখে। এত বয়স হলেও এখনো যথেষ্ট শক্তসামর্থ্য বলে মনে হলো। চোখের দিকে তাকালেই মনে হয় চোখের ভেতরে না পাওয়ার বেদনার আগুনে জ্বলছে। তবে তা দমিয়ে রাখার যথেষ্ট ধৈর্য আছে এমনটি মনে হলো শামিমের। পরনে সবুজ সাদা চেকের লুঙ্গি এবং গায়ে অল্প দামের ফতুয়া।
আরও পড়ুন ভৌতিক গল্প অশরীরী আত্মা
ছোট ভাই তামিম বড় ভাইয়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
—আরে এ যে বিখ্যাত অভিনেতা আবুল হায়াত। মাথায় চুলগুলো না থাকলে এক কথায় আবুল হায়াত। ছোট ভাইয়ের কথায় কোন কান না দিয়ে ডান হাত উপরে তুলে ছালাম দিয়ে বলল,
—আমরা পদ্মনগর হতে এসেছি। নাজমুল হক সাহেবের সাথে একটু কথা বলতে চাই।
—আমি তো নাজমুল। কিন্তু বাবা, আমার মেয়ের অনুমতি ছাড়া তো তোমাদের সাথে কোন কথা হবে না।
তামিম বলল,
—না, না। আমরা কোন সাংবাদিক নই। আমরা দু’ভাই। শুধু কিছুটা সময় আলাপ করবো।
—বেশ ভেতরে গিয়ে বসা যাক।
পাকা লম্বা চারচালা টিনের ঘর। মাঝখানে বসার ঘর বলে মনে হলো শামিমের। তবে পাকা ওয়াল। গ্রামানুযায়ী মানান সই। মুরুব্বির সঙ্গে ভেতরে যেতেই বসার আসন দেখিয়ে বসতে বললেন। একটা বেতের গোল টেবিল, তার চারপাশ ঘিরে চারখানা বেতের চেয়ার। ঘরের উত্তর পাশে একটা খাট। পরিপাটি বিছানা। পাশেই একটা বুকসেলফ। অনেকগুলো বই সযত্নে সাজানো। এ ছাড়া আরো আছে বাঁশের তৈরি বেশ ক’টি বসার জন্য মুড়া। মাঝেমধ্যে এখানে অনেকে আসেন বলে অনুমান করছে শামিম। উত্তর দেয়ালে একটা লোহার গ্রিল জানালা। অল্প দামের পর্দা ঝুলছে। প্রতিদিন যে ঝাড়ামোছা করা হয় চোখ পড়তে বুঝে নেয় শামিম। রুচিসম্মত কারো হাতের ছোঁয়া লাগে প্রতিদিন। এই ঘরে তিনটি দরজা। একটা ঢুকতে, অপরটি পশ্চিম দিকে এবং অন্যটি দক্ষিণ দিকে। মনে হয় বাড়িতে ঢোকার আর কোন পথ নেই। তিনটি দরজায় অল্প দামের সুতির চেক কাপড়ের পর্দা। একই ধরনের পর্দা উত্তর পাশে জানালায় টানানো।
আরও পড়ুন জোছনা মাখা আলো-
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
জোছনা মাখা আলো (১ম পর্ব)