গল্প,  রাতুল হাসান জয় (গল্প),  সাহিত্য

জীবনের উপহাস (১ম পর্ব)

জীবনের উপহাস (১ম পর্ব)

রাতুল হাসান জয়

 

পড়ার টেবিলে বসে রাজ্যের মন খারাপ নিয়ে আমায় জিজ্ঞেস করলো আর্শি।

~ মাস্টারদা আপনি বাবাকে বলেছেন আর পড়াতে আসবেন না। কেন?

কোন কথার উত্তর না দিয়ে বইটা বের করে চূড়ান্ত হিসাব করতে দিলাম। সে চুপচাপ বসে রইলো। তার হাত কাঁপছে। বুকের ভিতর অনেক না বলা কথা জমে আছে যার জন্য, তার সামনে থেকেও বলতে না পারলে এমন হাত পা কাঁপে। আর্শি চোখের জল লুকাচ্ছে। নাক টানছে বারবার। সে জানে আজকেই শেষ আজকের পর আর দেখা হবে না কখনো।
~ মাস্টারদা আমায় নিয়ে পালাবেন? যেমন রাখবেন তেমন থাকবো শুধু পাশে রাখবেন আজীবন।
~ আর্শি, পড়ায় মন দাও। কথা বাড়াবে যত আমি তত দ্রতই উঠে চলে যাবো।

বাকিটা সময় একটা শব্দও করেনি সে। ফুফিয়ে কাঁদছে শুধু। আসার সময় ব্যাগে একটা কাগজ রেখে দিয়েছে। তার বাসা থেকে বের হয়ে হাঁটতে শুরু করলাম।

আগের টিউশনিটা একই কারণে ছাড়তে হয়েছে।
কলেজ পড়ুয়া মেয়েরা একটু বেশিই আবেগী হয়। এদের সাথে কেউ মিষ্টি করে কথা বললেও তারা প্রেম মনে করে নেয়। একটু বেশি সময় যাকে কাছে পায় তাকে নিয়েই স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।

আরও পড়ুন গল্প সোনালী সকাল

শহরের আলো ঝলমলে রাত। ওভারব্রিজ এ দাঁড়িয়ে কাগজটা খুললাম…

মাস্টারদা,
একদিন আপনাকে বলবো ভূত আর ভবিষ্যৎ সবটাই প্রেমিকার মতো। আমি আরো একশো চিঠি লিখবো আপনাকে, লিখবো তদ্দিন ধরে যদ্দিন না কঠিন আপনি ভাঙছেন। জানি ভিতরে ভিতরে শুধুই ভাঙেননি একেবারে গলে গেছেন। আপনার করানো অংকের চেয়েও খুব দ্রুত আমি আপনার চোখের আড়াল বুঝতে পারি।
অথচ আপনি…

থাক আর কথা বাড়াবো না মাস্টারদা। চলে যাবেন যান। এতটুকু জেনে যান মেয়েদের মনে একবার যে মানুষটা বসে যায়। সে থেকে যায়। দেখা না হতে হতে হয়তো চেহারা অস্পষ্ট হয়ে যায়। তবু হঠাৎ তার নাম শুনলে ভিতরে ভিতরে জলোচ্ছ্বাস হয়ে যায়।
ইতি
আপনার কেউ না

চিঠিটা পকেটে ভাঁজ করে রেখে হাঁটা দিলাম। অনেক রাত, আমি এখনও বাসায় যাচ্ছি না, সম্ভবত বাসায় যেতে চাইছি না আমি। নিয়ন বাতির আলোয় রাতের শহর খারাপ লাগে না। এই রাতে মানুষ আর কুকুর এক ছাদের নিচে, একই বিছানায় ঘুমায় হর্ণের আওয়াজে। মানুষগুলো ঘুমিয়ে গেলেও ফুটপাতে শুয়ে থাকা কুকুর তাকিয়ে দেখছে আমার হেটে চলা। এরা আমার বাসায় ফেরার নিত্যদিনের দর্শনার্থী। হয়তোবা এরা আমার পায়চারীর মানে বুঝতে পারছে, কিংবা বুঝতে চাইছে।

ঘরে চালের অভাব, ভাইয়ের স্কুল ফি বাকি, ঘরভাড়া বাকি। একজোড়া জুতাও কেনা দরকার। সামনেই ঈদ একটা শাড়ি কেনা দরকার মায়ের জন্য। নতুন একটা টিউশনি খুঁজতে হবে। তাছাড়া ক’দিন বাদেই আসছে বাবার মৃত্যুবার্ষিকী। মা সেদিন কিছু মানুষ খাওয়ান। এবার আর সেটা হচ্ছে না বোধহয়। হাটতে হাটতে হঠাৎ মনে পড়লো, গতকাল আমজাদ চাচার কাছ থেকে চাকরির খবর পত্রিকাটা নেওয়া হয়নি।

আরও পড়ুন গল্প বিপরীত

মাস্টারদা,

শান্ত দিন শেষ হলে যখন খুব-চেনা কোলে হেলান দিতে ইচ্ছে করে। তখন ঘরের সেই একটিমাত্র জানালার শার্সিতে গা এলিয়ে বসে ছাদে ওঠা চাঁদের দিকে নিষ্পলক চেয়ে থাকি। যে সন্ধ্যায় অমাবস্যা কিংবা খুব মেঘ, সে আকাশে কল্পনার চাঁদ এঁকে নিই মনে-মনে। হ্যাঁ, ছোটবেলা থেকেই ঘরের এই কোণটা ভীষণ সামলেছে আমায়— সামাজিক নিয়মের আপনজনেরা যখন পরমানুষদের থেকেও দূরের মনে হয়, তখন এই বোবা জানালা, ঘুলঘুলি দিয়ে দেখা-যায় অমন আকাশ আর ওই রোজকার রূপালী চাঁদের সাথেই রান্নাবাটি খেলি।

এসব কেন লিখছি? এগুলো কি ফোনে বলা যেত না? যেত বৈকি। আপনি তো আমার ফোন ধরবেন না। ধরলেও হারিয়ে যাবে আমার কথারা।
এই চিঠিটা থেকে যাবে জানি। আপনি আমার কোন চিঠিই ফেলে দেননি, হয়তো পড়েন নি কিন্তু যত্ন করে রেখেছেন। চোট খাওয়া মানুষগুলো আবেগ যত্ন করতে জানে। জানেন অনেকদিন চিঠি লিখিনি।
সেই যে আপনি গেলেন সেই শেষবার লিখছি। তারপর আজ।

একটা মানুষ চলে গেলে বুঝি এমন দমিয়ে দমিয়ে বুকে ব্যথা হয়, জমানো শখ আল্লাদগুলো এমন হঠাৎ করে মরে যায়?
এত ব্যথায় থাকলে কেউ কি করে শান্ত থাকতে পারে? নিস্তব্দ থাকতে পারে? পাবোনা জেনেও কি করে প্রতিক্ষায় থাকতে পারে?

কত স্বপ্ন ছিলো আমারো। বই পড়তে পড়তে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবেন। আমার হাতের বই সরিয়ে চোখে চুমু এঁকে দিবেন। আর আমি জড়িয়ে ধরে আপনার গাঁয়ের গন্ধ নেবো।

আরও পড়ুন গল্প রঙিন ঘুড়ি

ভীষণ হাঁফিয়ে উঠেছি, চব্বিশ ঘন্টা ধোঁয়া ছাড়া ইট ভাটার চিমনির মত বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে নিতে। ভাবতে ভাবতে অনিদ্রায় দু’চোখের পাটাতনে ছোটো ছোটো কালশিটে দাগের গিরিখাত তৈরী হয়েছে। আমার এখন অনেকটা আদর দরকার। অনেকটা যত্ন দরকার। যত্ন পেলে মরুভূমিতেও তরতরে বেড়ে ওঠে রক্ত গোলাপ। আমার আপনাকে দরকার।
ভিতরে ভিতরে কেমন ভেঙে গেছি।
আপনি তো বাস্তবতার সূত্রে মন বেঁধে চলে গেলেন। কখনো বলেননি আমায় ভালোবাসেননি। আপনার পায়ে দায়িত্বের শিকল। দায়িত্ব কাঁধে থাকলেই কি মনের কথা শুনতে হয় না?
এখন মন খুলে কথা বলতে গেলেই ঢোঁকের সাথে আটকে যায় কথারা। নির্বাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে আয়নায় নিজের মুখের দিকে তাকাই, জলের ফোঁটা পরে দু’গালের পাশ বেয়ে। কেন এমন কঠিন হয়ে যাচ্ছে জীবন, কেনোই বা আয়ত্তের বাইরে আজকাল আমার মন আমার থেকে বলতে পারবেন?

আপনি বলেছিলেন, “কলেজ পড়ুয়া মেয়েরা একটু বেশিই আবেগী হয়। এদের সাথে কেউ মিষ্টি করে কথা বললেও তারা প্রেম মনে করে নেয়। একটু বেশি সময় যাকে কাছে পায় তাকে নিয়েই স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।!”

আচ্ছা কলেজ শেষ হলেই ভুলে যায় কি? দুই বছর হলো কলেজ শেষের। ভুলতে পারিনা কেন?

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ঠিকানা পেয়েছি আপনার।
তাই লিখতে বসা। বাবা বিয়ে ঠিক করেছে। খুব তাড়াতাড়িই বিয়েটা হবে সম্ভবত। ছেলেদের খুব তাড়া বিয়ের পর ছেলের সাথে দেশের বাহিরে…

ভালো থাকবেন, দায়িত্ব দায়িত্ব করে নিজের স্বপ্নের তো মাটি দিলেনই। এবার প্রিয়তমার দায়িত্ব নিতেও শিখবেন একটু।

ইতি
আর্শি

আরও পড়ুন জীবনের উপহাস-
শেষ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

জীবনের উপহাস (১ম পর্ব)

Facebook Comments Box

প্রকৌশলী আলতাব হোসেন, সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশ এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত অলাভজনক ও অরাজনৈতিক সংগঠন ‘আমাদের সুজানগর’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সাধারণ সম্পাদক। তিনি ‘আমাদের সুজানগর’ ওয়েব ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও প্রকাশক। এছাড়া ‘অন্তরের কথা’ লাইভ অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক। সুজানগর উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, কৃতি ব্যক্তিবর্গ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে ভালোবাসেন। বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি স্বনামধন্য ওয়াশিং প্লান্টের রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেকশনে কর্মরত আছেন। তিনি ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুন পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালি ইউনিয়নের সাগতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!