চোখে দেখা নীলকণ্ঠ (শেষ পর্ব)
চোখে দেখা নীলকণ্ঠ (শেষ পর্ব)
খ.
সেলিনা চরিত্রের মানুষটি আমার পাশের বাড়ির। স্বামী সংসার নিয়ে তিনি এখন ঢাকার শহরে থাকেন। রংপুর শহরে তিনি প্রথম যখন বাড়ি করেন; বাবা যে খাটে ঘুমাতো তা নিয়ে যেতে সেলিনা ভাবি যে পরিমাণ কূট কৌশল প্রয়োগ করেছিলেন! আমেরিকা ইরাকে যুদ্ধ করবোর সময় প্রেসিডেন্ট বুশ এমন কূট কৌশল অবলম্বন করেছিল না। বাবা মনে মনে ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল। কিন্তু কারো কাছে কখনো মন খুলে কিছু বলেনি। অন্য ছেলের বউ যদি কিছু বলে। বাবা শুধু সন্তানের সুখের জন্য ব্যস্ত ছিল। বউমার কূট কৌশলে পরিবারের সবার কাছে নিজেকে সে এমন একজন খারাপ মানুষ হিসেবে বহিঃপ্রকাশ করেছে; এ বাড়ির কাকপক্ষী তো দূরের কথা, কুত্তাও তার মুখের দিকে তাকাবে না। এখন ঢাকার শহরে বাড়ি। বাবা মাটির নিচে চাপা পরে আছে বছর সাতেক হল। একদিনও মনের ভুলে বাড়ির সদর দরজায় বউকে নিয়ে বাড়ি আসে নি।
সোনালি বাড়ির উঠোনে আগুনের স্তুপ হৃদয়ে নাড়া দেয় গভীর থেকে। বুকের ভেতর থেকে বের হয়ে আসে হাজারো সাজানো স্বপ্ন। মৃত শামুকের মতন পড়ে থাকে বিস্তৃত মাঠ জুড়ে। হালচাষের লাঙলের ফলার মতো বুকে দাগ কেটে যায় প্রতিনিয়ত।
সেলিনা ভাবির কুট কৌশলে আত্মীয়-স্বজন ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। কেউ কী সেচ্ছায় নিজেরে খারাপ মানুষ হিসাবে দাঁড় করাতে চায়? হয়তো কখনো চায় না। চাওয়া বেড়ে গেলে হয়তো কষ্ট বা ব্যথা বেড়ে যায়। সংসারের প্রতি সেলিনা ভাবির প্রেম ছিল ঘৃণ্যতম। ভাবনার এক বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল তার প্রত্যেকটি আচার-আচরণে। শহরমুখী হয়েছিল সেলিনা ভাবি। গ্রাম, গ্রামের মানুষ, বাড়ির সদর দরজা তার কাছে সব সময় মনে হত জঙ্গল। গ্রামের প্রতি ঘৃণা থেকেই পরিবার ও আত্মীয়স্বজন থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখলেও তার সহজাত চরিত্র কাল্পনিক অস্তিত্বহীন। লেবাস ছিল শুধুই মাত্র মানুষ দেখানো; ভেতরে সবকিছু মেকি ।
আরও পড়ুন গল্প রাজামারা
একটা সময় তার আলিশান বাড়ি হয় রাজধানীর বুকে একাধিক। সেখানে সুখের শহর গড়ে উঠবার কথা হলেও দাবানল বহমান ছিল মনের গহীনে। সংসারের কোনো মানুষকে; মা-বাবা, ভাইকে অবহেলা করে নিজে কখনো সুখী হওয়া যায় না। চাকচিক্য অভিজাত্যের ভেতরে নিজে সে কথা নিশ্চয়ই ভুলে গিয়েছিল। একবিন্দু অনুশোচনা তার ঠোঁটের কিণার দিয়ে উচ্চারিত হয়নি কখনো
গ.
বিশাল জমিদারি ফকির সাহেবের। কিন্তু এ সম্পত্তি ভাগের জন্য ছেলের বউ; রাত নেই, দিন নেই জমি ভাগের জন্য একটা সময় মরিয়া হয়ে ওঠে। শকুনের মতন সামনে পেলেই বুঝি ছিঁড়ে খাবে এ সংসার, এ সংসারের মানুষকে।
‘মনের ভেতরে ঘৃণা ঢুকে গেলে মানুষকে খেয়ে ফেলতে পারে মানুষ।’
শিউলি এখন ঠিক তেমনটি হয়েছে। একটা সময় স্বামীর সংসার, শ্বশুর বাড়ির লোকজনের কাছে এমন হয়েছিল যে, স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে বাবার বাড়ি চলে যায়। চলে যাওয়ার পরে সে বুঝতে পারে মা হতে চলছে। তখন না ফিরে যেতে পারছে, না পেটের ভেতরের মানুষটাকে বড় করতে পারছে। দিনদিন পেটে ভেসে উঠতে লাগল। মানুষের চোখ শকুনের চোখের মত পেটের দিকে তাকিয়ে থাকতে লাগল একটা সময়। লোকজন দিয়ে সমঝোতা করবার একটা মাধ্যম খুঁজে বের করবার জন্য চেষ্টা করে শেষ অবধি ব্যর্থ হয়েছিল শিউলি।
অনেক দিন হয়ে গেল। শ্বশুর বাড়িতে কেউ কখনো খোঁজ নেয়নি। স্বামী হয়তো চক্ষু লজ্জায় কখনো কারও কাছে কিছু খুলে বলেনি। আষাঢ় মাসের বৃষ্টির দিনে শিউলির কোল জুড়ে সুজন আসে। সেদিন রাতে এমন বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। মনে হয়েছিল আকাশ ফুঁটা হয়ে গিয়েছিল। কাঁচা রাস্তায় কাদা মাড়িয়ে দাই বেটিকে আনতে যেতে হয়েছিল।
আরও পড়ুন গল্প ও রিহানা
সেই সব পুরোনো দিনের স্মৃতির পাতা খুলে বসেছিল সেদিন পুকুর ঘাটে ফকির সাহেবের স্ত্রী। আমি ঢাকা থেকে আজই কিছুক্ষণ আগে বাড়িতে এসেছি। সেকথা কোন ভাবেই বোঝাতে পারলাম না। অনর্গল কথা বলে যেতে লাগল। আমি বধির ব্যক্তির মতো তার মুখের দিকে তাকিয়ে শুনতে লাগলাম।
_চাচি, তোমার ঘরে নাতি আসলো শোনলাম। তারে এবার ঘর আনতে হবে না?
_ঘরে কি করে আনবো রে বাজান। হারামজাদি তো কোনো রাস্তা রাখেনি।
_আমি তোমার নাতির ছবি দেখছি। কী সুন্দর! পরীর মতো মুখ।
_তোমার ছেলে তো একটা অমানুষ। তোমরা কি তার সঙ্গে বউয়ের মতো আচরণ করছো কোনোদিন?
ফকির সাহেবের স্ত্রীর মুখ কালো হয়ে গেল। পৃথিবীর যে কোন মানুষকে তার মুখের সামনে সত্য কথা বললে তার মুখ মেঘের মতো কালো হয়ে ওঠে। ঠিক তেমনি ফকির সাহেবের স্ত্রীর মুখ কালো মেঘের মত হয়ে রইল কিছুক্ষণ।
পরের দিন চাচি আমার খুব কাছে এসে বলল,
_খোদার দোহাই লাগে, তোর হাত জোড় করে বলছি। আমার নাতিরে তুই এনে দে। এক নজর আমার বংশের আলো আমি দেখব।
_এতকাল তো তোমরা বলছো বন্ধ্যা বউমা। তোমরা তো কম নাজেহাল করোনি তাকে। তোমার ছাওয়াল হয়েছে, তোমাদের দলের নেতা। চাচি একখান কথা কই, কিছু মনো কইরো না। ছাওয়াল বিয়ে করলে তাদেরকে নিজেদের মত করে সংসার করতে দেওয়া উচিত। তোমার ছাওয়াল বাড়ি আসলে, তোমার বেটি, মেয়ের জামাই তোমার বাড়ি দখল করে রাখে। তোমার বাড়িতে ঘর একটা তোমার বাড়িতে তোমার ছেলের, বউ আগে। হ্যাঁ ঠিক আছে তোমার বেটি আসবে, জামাই আসবে, থাকবে খাবে। তোমরা কি করো, বউরে পাশের রুমে রেখে তোমরা সবাই মিলে এক রুমে থাকো। এগুলো অন্যায়। তোমরা শুধু নিজের স্বার্থ দেখছো। এমন ঠিক না চাচি। ছেলের টাকা পয়সা বউকে না দিয়ে সব সময় বেটির দিকে দেখছো কেন?
আরও পড়ুন গল্প রোদেলা দুপুর কাঁদে
তোমার বেটির জামাই জুয়া খেলে, মদ খায়। তাকে তো একটা কাজের কথা তোমরা বলতে পারতে। নিজের বেলায় তোমরা ষোলো আনা বুঝ। এমন করলে তোমার সংসারে কোন বেটি সংসার করবে কও তো দেহি?
শিউলি ভাবি তো তাও এত বছর সংসার করছে। ছেলের মা হয়েছে, তোমরা তাকে জবরদস্তি করে বাধ্য করছো ডিভোর্স দিতে।
_বাপ রে আমার নাতির জন্ন্যি আমার অন্তর পুড়ে। তারে একবার চোখের দেখা যাতে দেখতে পারি সে ব্যবস্থা করে দে না।
_আমার কাছে কইয়ে কী লাভ চাচী? তোমার বেটার বউ ভালো মানুষ। কেউ তো তারে কখনো খারাপ বলেনি। শুধু তোমার বেটির কথা শুনে আর এক মায়ের বেটিরে স্বামীর ভাত-কাপড় থেকে পৃথক করে দিছো। কী সব কাণ্ড করছো!
আমি তখন কামারহাট স্কুলে পড়তাম, ভাবি দেখতাম গরুর চাড়িতে পানি দিবার জন্য পুকুর থেকে পানি নিত। তোমার গরু-বাছুর সেই তো দেখত। সংসারটা একেবারে নিজের করে নিয়েছিল কিন্তু তোমরা সবাই তার বিপক্ষে ছিলে। সংসারে নতুন বউ কী বাঘ না সাপ তার সঙ্গে সবাই মিলে কুত্তার ল্যাহান ব্যবহার করছো?
গরমে ঘেমে বৃষ্টিতে ভেজার মত ভিজে উঠত। রোদে পুড়ে সারা দিন ধান শুকাতো। সংসারী মেয়ে ছিল। তার কপালে ডিভোর্স জুটছে। যেখানে কাচ আর হিরের একই দাম হয়, সেখানে নিজেকে প্রকাশ করতে যাওয়াও একটা বোকামি।
আরও পড়ুন গল্প একজন কিশোরীর প্রেম
স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে শিউলি ভাবির সেই ডাক, সেলিম স্কুলে যাবার পথে তুই আমার তেঁতুল আর একটা ডাব পেড়ে দিবি ভাই। মনে হতো এই মানুষটা আমার আপন, আমার শত জনমের পরিচিত মানুষ।
আহা রে! সত্যি তার এই বেদনাময় ব্যথার সাগরে ভেসে যায়, না বলা কষ্টের স্রোত। আমি মনে মনে ভেবেছি, দু একের ভেতরে গিয়ে শিউলি ভাবির হাত ধরে বলব,
_ভাবি, আপনি আপনার ছেলেসহ আমার সঙ্গে চলেন। চাচি আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছে। তাঁর নাতিকে দেখতে চায়।
সাত পাঁচ ভেবে পরের দিন সকালে বাজারে যাব, ঠিক সে সময় দেখলাম, আয়নাল ভাই একটা সুন্দরীর হাত ধরে বাড়ির অভিমুখে এগিয়ে আসছে। না-কি আমি ভুল দেখছি! হয়তো কোনো কোনো দেখা চোখের ভুল হতে পারে।
আরও পড়ুন চোখে দেখা নীলকণ্ঠ-
১ম পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
চোখে দেখা নীলকণ্ঠ (শেষ পর্ব)