চোখের আলোয় দেখেছিলেম (৫ম পর্ব)
চোখের আলোয় দেখেছিলেম (৫ম পর্ব)
এ কে আজাদ দুলাল
জামী এখন চাকুরিতে যোগদানের বিষয় নিয়ে ভাবছে না। হাতে বেশ সময় আছে। একবার যোগদান করলে সময় দিতে পারবে না। কিন্তু যার জন্য এত ভাবনা সে কি আদৌ নিয়োগপত্র পেয়েছে। চুপিসারে সব কাজ সম্পন্ন করেছে। কিন্তু যদি নিয়োগপত্র পেয়ে থাকে তার মতো বেশ কিছু ডকুমেন্টস তেরি করতে হবে। যেমন পুলিশ তদন্ত সংক্রান্ত; তবে অন্যান্য কাগজ হয়তো অফিস থেকে সাহায্য পেয়ে যাবে। তিন দিন অতিবাহিত হতে চলেছে। তিন তলায় আগের মতো ভূতুরে বাড়ির মতোই আছে। রাজন নিয়মিত জামীর কাছে পড়ে যাচ্ছে তবে প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া বাড়তি কোনো কথা বলে না। দুপুরে খাবার পর টিউশনিতে গিয়েছিল। ফিরল রাত নয়টার দিকে। আঙ্গিনায় ঢুকতেই নিচের তলায় সবগুলো কক্ষে আলো দেখে অবাক হয়ে যায়। নিশ্চিত এ বাসায় নতুন কোনো সুসংবাদ আছে। দেখা যাক। ফ্রেশ হয়ে পুরানো একখানা খবরের কাগজ হাতে নিয়ে পড়তে থাকে। এমন সময় রাজন এসে রুমে ঢোকে। তবে হাতে খাবার নেই।
— দেরি হলো যে।
হঠাৎ রাজনের কথার ধরন দেখে জামীর মনে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হতে শুরু হলো। একটু ধীরে বৎস। সবুরে মেওয়া ফলে। ভাবনাটা শেষ না হতেই রাজনের মা হাসি মুখে খাবার নিয়ে রুমে ঢুকল। টেবিলের ওপর খাবার রেখে আঁচলের ভেতর হতে মোটাসোটা বড়ো একটা খাম জামীর দিকে এগিয়ে ধরে। জামী তো বুঝতেই পারছে খামের ভেতরে কী আছে।
— এর ভেতরে কী আছে?
— দীপ্তির ব্যাংকের চাকুরির নিয়োগপত্র।
দরজার দিকে তাকায় কেউ আছে কি না। না কারো ছায়া পর্যন্ত চোখে পড়ছে না। তবুও ভদ্রতার খাতিরে ধন্যবাদ বলল। সে তো জানে ভেতরে কী আছে। তবুও খুলে দেখে বলল,
— এগুলো পূরণ করে অফিসে জমা দিয়ে যোগদান করতে বলেন। অগ্রণী ব্যাংক। মনে হয় বেশি দূরে হবে না।
— বাবা, তোমার কোন ব্যাংকে চাকুরি হয়েছে?
এবার মহিলা নিজেই ধরা দিলো জামীর জালে।
— কিন্তু বাবা, পুলিশ রিপোর্ট আমাদের কে দিবে?
— কিন্তু কেন?
আরো পড়ুন গল্প জীবনের উপহাস
— বাবা, আমাদের পরিবারের উপর দিয়ে বিরাট একটা সাইক্লোন বয়ে গেছে। সবকিছু তচনচ করে দিয়েছে। নিজের গর্ভজাত সন্তান আমাদের ছেড়ে আলাদা সংসার পেতেছে। কী আর বলব। দীপ্তি চায় না এসব ঘটনা পুনারবৃত্তি করি। কিন্তু তোমাকে তো বলতেই হবে। যদি তোমার দ্বারা সম্ভব হয়। আমাদের সংসারটা এমন অস্বচ্ছল ছিল না। দীপ্তির বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ হতে এমবিএ। আমি পদার্থ বিজ্ঞানে মাস্টার্স। দীপ্তির বাবার সিনিয়র ক’জন বন্ধুর একটা নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে চাকুরি নেয়। যথেষ্ট সুনামের সাথে কর্মরত ছিলেন। আমিও একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষকের চাকুরি পাই। ভালোই চলছিল আমাদের সংসার। পরিবারে দুই ছেলে এক মেয়ে। নিজেদের আয়ের টাকা আর দীপ্তির বাবা তার অফিস হতে কিছু লোন নিয়ে এই বাড়িটি তৈরি করেছিলাম। কিন্তু পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই ঝড় শুরু হয়।
কিছু সময় কথা বন্ধ রাখেন মহিলা। চোখের কোণে বেদনার অশ্রু আঁচল দিয়ে মুছে নেন।
— অফিসে ম্যানেজিং ডাইরেক্টরে ছেলে এবং শ্যালক প্রতি সপ্তাহে অফিস হতে টাকা ধার নিত। মাস শেষে বেতন হতে কর্তন করার প্রতিশ্রুতিতে এই ঋণটা দেয়া হতো। শুনেছি তাদের অফিসে এ ধরনের প্রথা চালু ছিল। কিন্তু ছেলে-শ্যালক এই প্রথা মেনে চলত না। এমন অবস্থা দাঁড়ায় দু’জনই কোম্পানির কাছে প্রায় ছয় লক্ষ টাকা ঋণী হয়ে যায়। বিষয়টি কর্তৃপক্ষ গোচরে নিলে হিতে বিপরীত হয়। ছেলে-শ্যালক হুমকি দিতে থাকে। কিন্তু ততক্ষণে ঘটনা কর্তৃপক্ষের কানে পৌঁছেছে। ঋণ গ্রহিতাদের সবার ডকুমেন্টস আছে কিন্তু কোম্পানির বড়ো কর্তার ছেলে-শ্যালক তাদের কাছ হতে কোনো ডকুমেন্টস রাখেনি। উল্টো ফেঁসে যায় দীপ্তির বাবা।
নিজের ছেলে আর ভাইকে বাঁচাতে মাঠে নামে ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের স্ত্রী। মামা-ভাগ্নের স্বভাব চরিত্র সুবিধাজনক ছিল না। তবুও নিজের গর্ভজাত সন্তান আর আপন ভাই। এটা মনে হয় মহিলাদের বৈশিষ্ট্য, নিজের সন্তান এবং নিজের আপন ভাইকে সহজেই দোষী ভাবতে পারে না। এক পুলিশ অফিসার ভাইকে দিয়ে মিথ্যে তহবিল তছরুপ ঘটনায় আটক করে হাজতে নিয়ে যায় আর চাকুরি হতে বরখাস্ত করে। অনেক তদবির পর জেলহাজত হতে ছাড়া পায়। কিন্তু চাকুরি ফিরে পায়নি।
আরো পড়ুন গল্প হাতে চুড়ি
তাকে বলেছিলাম বাড়িটা বিক্রি করে কোর্টে মামলা করতে। কিন্তু রাজি হননি। বলতেন এই বাড়ি তোমাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল হবে। প্রতিদিন ভোরে নাস্তা খেয়ে বের হতেন। ফিরতেন ঠিক দুপুরে। বর্ষাকাল। সে দিন সকালে বেশ বৃষ্টি নেমেছিল। ছাতাটা হাতে নিয়ে বের হলেন। অভাবী সংসার। উপার্জনকারী ছেলে বাবার দুর্নীতি মেনে নিতে পারেনি। বাবার ওপর দোষ চাপিয়ে বৌয়ের মা-বাবার পরামর্শে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। অপমানিত জীবন নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। সেই দিন দুপুরে ফিরে এলেন না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো কিন্তু তার কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। কে খোঁজ দিবে। দীপ্তি সবেমাত্র কলেজে পড়ে। রাজন ছো্টো। সন্ধ্যার পর এই পাড়ার একটা ছেলে খবর দিলো শাহজাহানপুর রেলক্রসিংর কাছে একজন লোক আত্মহত্যা করেছে; সাথে একটা ছাতা এবং পকেটে ছোটো চিঠি। তাতে লেখা আছে, এই পথই আমার জন্য উত্তম।
দীর্ঘদিনের জমে থাকা পরিবারে ঘটে যাওয়া ঘটনা বলে মহিলা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল এবং চোখ মুছে বলল,
— এবার বলো কে দিবে ভালো রিপোর্ট?
জামী একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে মনে মনে হাসে। খালাম্মা ব্যবস্থা তো করেই রেখেছি। শুধু সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে।
— এখনো অনেক সময় আছে। এর মধ্যে একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। চিন্তা করবেন না।
সকাল দশটার দিকে মিশু ভাইকে মোবাইলে ফোন করে সময় নিল। আজ বিকেল তিনটায় তার সাথে দেখা করতে চায়। পুলিশ অফিসার মিশু নির্দিষ্ট সময়ে আসতে বলল। এবার পাগলা কী আরজি নিয়ে আসে। আগেই বলে রেখেছে একটা আবদার আছে। তবে সে যে টাকা পয়সা সাহায্য চাইবে না, এটা নিশ্চিত। তার ছোটো ফুফুর আত্মার সন্তান। ছোটো ফুফুকে তো ভালো করেই চেনে। অনেকটাই তাদের সমবয়সী। ছোটো ফুফু, মিষ্টি আর মিশু এককালে তাদের পরিবারের ডানপিটে সন্তান ছিল। তাদের ছো্টো ফুফু-খালা ছিল সব কাজের ওস্তাদ। মিশুর বাবার হাতে কতবার পিটুনি খেয়েছে তার কোনো হিসেব নেই। কিশোরকালের কথা মনে পড়তেই মিশু মনের আনন্দে একা একাই হেসে ওঠে। আহা ! কিশোর কালটা কত মধুময় ছিল।
আরো পড়ুন ভৌতিক গল্প অশরীরী আত্মা
ঠিক তিনটায় ডিএমপি’র হেড কোয়ার্টারে গিয়ে উপস্থিত হয় জামী। রিসিপশনে আগেই বলে রেখেছে। বেশি সময় ব্যয় করতে হলো না জামীর। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে জোরে করে একটা সালাম হাঁকলো জামী। মিশু আগেই জানে জামীর সোনালী ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার পদে নিয়োগপত্র পেয়েছে।
— অভিনন্দন মি. মোহাম্মদ জামী।
— ধন্যবাদ।
টেবিলে ডান হাতের দিকে রাখা প্যাকেটটা খুলে বড়ো একটা মিষ্টি তুলে জামীর মুখের সামনে ধরে। জামী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মিশুর হাসি মাখা মুখের দিকে। জামীর দু’চোখ ছলছল করেছে।
— কী রে, কী হলো টপ করে খেয়ে নে।
— ভাইয়া, তোমরা না সবাই ছোটো চাচির মতো খুব ভালো।
— না রে পাগলা, তোর ছোটো চাচির মতো হতে পারলাম কোথায়? নতুন চাকুরিতে যোগদান করেছে?
— না, এখনো করিনি। তবে আশা করি সোমবারে সব কাগজপত্র প্রস্তুত করে যোগদান করবো ইন-শা-আল্লাহ।
— বেশ সুখবর। এবার বলো কী জরুরি প্রয়োজন?
জামী একটু মাথা চুলকিয়ে বলল,
— ভাইয়া যা বলব তা কিন্তু ছো্টো চাচি আর মিষ্টি ভাইয়াকে এখনই বলা যাবে না।
— ঠিক আছে।
পকেট হতে পুলিশ ভেরিফিকেশন একটা পূরণ করা ফরম মিশুর হাতে দিয়ে বলল,
— ভালো করে পড়ে দেখ। তারপর বলবে তোমার কিছু করণীয় আছে কি না।
আরো পড়ুন গল্প মামৃত্যু
মিশু ফরমখানা হাতে নিয়ে মনোযোগ সহকারে পড়ে বলল,
— এটা তো একটা মেয়ের জীবনবৃত্তান্ত। পুলিশের চাহিদা মোতাবেক চাকুরির ক্ষেত্রে এসব তথ্যাবলি প্রয়োজন। তা কত দিনের পরিচয়?
— ধ্যাৎ, পরিচয় তো দূরের কথা চোখে দেখা মেলেনি।
— না দেখে প্রেম! তা আমাকে কী করতে হবে?
— তেমন কিছু না। উল্লেখিত থানার বড়ো বাবু যেন ঝামেলা না করে।
— ঝামেলা করার মতো কিছু তো দেখছি না।
গতকাল রাতে বাড়িওয়ালি মহিলা যা বলেছিল সেই ঘটনা বিস্তারিত খুলে বলল জামী।
— চিন্তা করতে পার কার অপরাধে একটা পরিবারের তিনজন প্রাণী শাস্তি পাচ্ছে। তাই ভাবলাম যদি উপকার করতে পারি মন্দ কি। একটা পরিবার মস্ত একটা বিপদ এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যত হতে মুক্তি পাবে। জানো মিশু ভাইয়া এদের পরিবারের দুর্দশার কাহিনি শুনে আমার বড়ো মামা বীর মুক্তিযোদ্ধার কথা মনে পড়ে গেল। তিনি আমাদের একটা ঘটনার কথা বলেছিলেন।
সবেমাত্র দেশ স্বাধীন হয়েছে। মামাসহ তাদের গ্রুপের সকল মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্পে তাদের আর্মস, গোলাবারুদ জমা দিয়ে একখানা ছাড়পত্র হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। কলেজ বন্ধ। বন্ধুরা মিলে মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলে সময় কাটাচ্ছেন। তো হঠাৎ একদিন সকালে তাদের সিনিয়র বড়ো ভাই মুক্তিযোদ্ধা একটা ছেলেকে মারতে মারতে নিজেদের বাড়িতে দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা কি। পরে গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে গেল। ছেলেটি ওদের আত্মীয় এবং রাজাকার। শুধু তাই নয় রাজাকার কমান্ডারের বডিগার্ড ছিল। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু সপরিবার নিহত হওয়ার পর সেই রাজাকারের বাচ্চা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের চাকুরি করেছে। শহরে বাড়ি করেছে এবং ওর চৌদ্দগোষ্ঠির সরকারি চাকুরি দিয়েছে। তাদের কোনো দোষ নেই। এখন তো আমাদের রক্তের শিরায় শিরায় রাজাকারের রক্ত প্রভাবিত হচ্ছে। কোম্পানির মালিকের ছেলে আর শালা বাবুর দুর্নীতির দায় কাঁধে নিয়ে জেলহাজত; অতপর আত্মহত্যা। কী বিচার, তাই না? তাই ভাবলাম অন্তরালে থেকে কিছু করা যায় কি না। মিষ্টি ভাই তুমি আমাকে অনেক সাহায্য করেছ।
আরো পড়ুন গল্প হাইব্রিড
মিশু চেয়ার হতে উঠে জামীকে জড়িয়ে ধরে বলে,
— আসলেই তুমি আমার ছোটো ফুফুর যোগ্য আত্মার পুত্র। কাগজখানা রেখে যাও। আমি নিজে এর দায়িত্ব নিচ্ছি। মেয়েটিকে চাকুরিতে যোগদান করতে বলবে। কোনো অসুবিধা হবে না ইন-শা-আল্লাহ। তা এই খুশিতে আরো একটা মিষ্টি হোক এবং সাথে আমাদের ক্যান্টিনের সিঙ্গারা এবং কফি।
সেই দিন মনের আনন্দে রুমে ফেরে জামী। রাত নয়টার দিকে রাজন খাবার নিয়ে রুমে ঢোকে।
— রাজন, খালাম্মাকে একটু ডাকবে?
রাজন কোনো কথা না বলে ঝড়ের বেগে রুম হতে বের হয়ে গেল। ঠিক দশ মিনিটের মধ্যে রাজন তার মা সাথে রুমে ঢোকে। জামী প্রস্তুত হয়ে বসে আছে।
— বাবা, ডেকেছ?
— জি, আপনার মেয়েকে আগামী সোমবারে যোগদান করতে বলবেন। থানা-পুলিশ নিয়ে ভাববেন না। বিপদের পর স্বস্তি আছে। আপনাদের বিপদ একদিন কেটে যাবে ইন-শা-আল্লাহ।
আরও পড়ুন চোখের আলোয় দেখেছিলেম-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে
চোখের আলোয় দেখেছিলেম (৫ম পর্ব)