চোখের আলোয় দেখেছিলেম (৪র্থ পর্ব)
চোখের আলোয় দেখেছিলেম (৪র্থ পর্ব)
এ কে আজাদ দুলাল
রাজনের সাথে জামীর বেশ জমে উঠেছে। রাজন খোলাখুলি মনে কথা বলে। তবে নিজেদের দুর্ঘটনার কথা মুখ ফুটে এখনো জামীকে বলেনি। জামী অপেক্ষায় আছে একদিন বিস্তারিত ঘটনা সে জানতে পারবে। রাজনের এইচএসসি পরীক্ষা সামনে আবার জামীর যে কোনো সময় লিখিত পরীক্ষার কার্ড পেয়ে যেতে পারে। ছোটো চাচির বড়ো ভাইয়ের ছেলে মিশু। ছোটো চাচুর বিয়ের সময় দেখেছিল। চেহারা মনে নেই। এখন বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডারের অফিসার। ছোটো চাচির লেখা একটা চিঠি মিশু ভাইকে দিতে হবে। অনেকদিন হলো যাওয়া হয়নি। অফিসের ঠিকানা নিয়েছে। ডিএমপির হেড অফিসে বসেন। মিষ্টি ভাইয়ার কাছ হতে ঠিকানা নিয়েছে। মিষ্টি ভাই মিশুর ভাইয়ের সাথে কথা বলে সময় ঠিক করেছে; আগামীকাল সকাল দশটায়।
ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় দশটার সময় পৌঁছে যায় ডিএমপির হেড অফিসে। আগেই বলা ছিল। একজন পুলিশ জামীকে নিয়ে একটা দোতলার শেষ মাথায় একটা কক্ষের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ওয়ালে লাগানো পিতলের উপর নাম লেখা মিছবাহুল হক মিশু, ডেপুটি কমিশনার (তদন্ত)। দরজা ঠেলে জামীকে ভেতরে যেতে বলে সে বেরিয়ে আসে। মিশু চোখ তুলে তাকায়। একটু হেসে বলে,
— তুমি সেই জামী না? ছোটো ফুফুর বিয়ের পর আমাদের বাড়ি গিয়েছিলে। সারাক্ষণ ফুফুর আঁচল ধরে থাকতে। সেই জামী এতো বড়ো হয়েছ? বসো।
জামী সালাম দিয়ে একটা চেয়ারে বসে। জামী তার পকেট হতে ছোটো চাচির লেখা পত্রখানা মিশুর হাতে দেয়। মিশু তার ছোটো ফুফুর চিঠিখানা হাতে করে বেশ ক’বার দেখে নিল। চিঠিখানা বের করে মনোযোগ সহকারে পড়ে শেষ করে অস্পট কণ্ঠে বলে উঠে, আমার পাগলী ছোটো ফুফু।
— পাগলী বটে। তবে পৃথিবীতে এমন মানুষের বড়োই অভাব।
— ঠিক বলেছ।
অনেক কিছু নিয়ে তাদের মধ্যে কথা হলো; সাথে চা-নাস্তা। বিদায় পর্বে জামী একটা আবদার জানিয়ে আসলো, ভবিষ্যতে একটা কাজ নিয়ে মিশুর কাছে আসবে। একমাত্র তিনি পারবেন এই কাজটা সুরাহা করতে। জামীর কথা শুনে মিশু হাসে । ঠিক ছোটো ফুফুর চরিত্র পেয়েছে অথচ কারো রক্তের সাথে বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই।
আরো পড়ুন গল্প রঙিন ঘুড়ি
মোবাইল নম্বর দিয়ে বলল,
— আসার আগে ফোন করে চলে আসবে।
জামী রুমে এসে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। মোটামুটি একটা রাস্তা তেরি করে রাখা হলো যদি কাজে লাগে। তার আগে যার জন্য এতকিছু করতে যাচ্ছে সে যদি সাহায্য না নেয় তাহলে। আবার লিখিত পরীক্ষায় যদি উত্তীর্ণ না হয়। থাক, এসব ভাববে না। ছোটো চাচি চিঠিতে লেখেছে, “বাইরে ঘোরাঘুরি না করে মন দিয়ে পড়াশোনা করবে।”
আর মিশু ভাই বললেন, “ছোটো ফুফুর পাগলামি এখনো যায়নি।” এখানে পাগলামির কি আছে। অসহায় মানুষকে সাহায্য করা কি পাগলামি। অপেক্ষায় থাকতে হবে; চাকুরি নামে সোনার হরিণ হাতের মুঠোয় না আসা পর্যন্ত।
এতদিন পর অপেক্ষার পালা শেষ হতে চলেছে। জামী জানে দীপ্তি নামের মেয়েটি মৌখিক পরীক্ষা পর্যন্ত পৌঁছেছে। আবার দীপ্তি জানে অদৃশ্যের সাহায্যকারী যুবকটি মৌখিক পরীক্ষা পর্যন্ত পা দিয়েছে। অথচ কেউ কারো মুখোমুখি হয়নি কিন্তু বসবাস বলতে গেলে একই ছাদের তলায়।
চিঠিপত্র আদান-প্রদানে মিষ্টি ভাইয়ের ঠিকানা ব্যবহার করে থাকে জামী। অবশ্য মিষ্টির অনুমতি নিয়েছে। শুধু তাই নয় স্থানীয় অভিভাবক মিষ্টি ভাই। আজ ছুটির দিন। বেশ আয়েশে দুপুরের খাবার খেয়ে জীবনানন্দ দাশের কবিতা সংগ্রহ কাব্যগ্রন্থ হাতে নিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে। এমন সময় মোবাইল ফোন বেজে উঠল। মিষ্টি ভাইয়ের নাম দেখে তড়িৎ বেগে বিছানায় বসে পড়ল। মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে হ্যালো বলতেই,
— কী খবর পরোপকারী মি. জামী?
জামী এবার চমকে যায়। পরোপকারী বলছে কেন। ছোটো চাচিকে তো পুরো ইতিহাস বলা হয়নি। এর-ই মধ্যে ছোটো চাচি ফাঁস করে দিলেন! যাক বাবা ভালোই হলো।
— মানে?
— ও কিছু না। ছোটো খালার আত্মার পুত্র তো। না, না নামটা আমি দেইনি। মিশু ভাই দিয়েছে। তোমাকে ভীষণ পছন্দ করেছেন।
জামী নিজেকে ধন্য মনে করে। ভাবে মিশু ভাই তোমার তো পরীক্ষা সামনে।
— জামী, আগামী রবিবার ঠিক দেড়টায় আমার অফিস কক্ষে তোমাকে চাই।
রবিবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে জামীকে।
আরো পড়ুন গল্প বাক্সবন্দি প্রেম
মিষ্টির অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হয় জামী। ঠিক দেড়টায় উপস্থিত হয় জামী। মিষ্টি ভাইয়া ভালো করেই জানে মোহাম্মদ জামী নামের যুবকটি যথাসময় হাজির হবে। দরজায় তিনটি টোকা, তারপর জামী মুণ্ডু ঢুকিয়ে বলল,
— আসতে পারি?
মিষ্টি এবার রসিকতা করে বলল,
— মুন্ডু যখন ঢুকিয়েছ, এবার বডিটা ঢুকিয়ে দাও।
জামী রুমে ঢুকেই পাশে একটা চেয়ারে বসল।
মিষ্টি একটু মৃদু হেসে বলল,
— তা দিনকাল কেমন চলছে?
— চলছে মরা কৈ মাছের মতো।
— বাহ! সুন্দর উপমা তো। বলো কি খাবে?
— বাসায় গিয়ে খাব।
মিষ্টি কথা না বাড়িয়ে ড্রয়ারের ভেতর হতে একটা প্যাকেট বের করে জামীর সামনে রেখে বলল,
— এটা ওপেন করো।
জামী কোনো প্রশ্ন না করে প্যাকেট খুলে দেখে বেশ ক’টি উন্নতমানের মিষ্টি। মিষ্টিতে জামীর ভীষণ লোভ। চোখ দুটো বড়ো হয়ে গেল।
— ভাইয়া, তোমার সরি আপনার জন্মবার্ষিকী না বিবাহবার্ষিকী?
— প্রথমত কোনোটাই না, দ্বিতীয়ত আমাকে তুমি বলতে পার।
মিষ্টি প্যাকেট হতে একটা মিষ্টি তুলে জামীর মুখের সামনে ধরে বলল, চট করে খেয়ে ফেল তো।
আরো পড়ুন গল্প স্বর্ণলতা
জামী চোখ বুজে মুখের ভেতরে মিষ্টিটা নিয়ে নিল আর এই ফাঁকে মিষ্টি ভাইয়া বাম হাত দিয়ে একটা খাম জামীর চোখের সামনে ধরে বলল,
— এবার চোখ খোলো।
জামী চোখ খুলে দেখে তার সামনে খাম ধরে আছে মিষ্টি ভাইয়া। হাতে নিয়ে বলল,
— এটা কী?
— খুলে দেখ।
দেরি না করে খুলে দেখে ব্যাংকের নিয়োগপত্র। শুধু তাই নয় ঢাকায় পোস্টিং। বিশ্বাস করতে পারছে না জামী। ফোঁটা-ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরে দুটো গাল বেয়ে।
— কি রে কী হয়েছে?
তাড়াতাড়ি চোখ মুছে বলল,
— ছোটো চাচি শুনলে কি যে খুশি হবেন। কল্পনা করতে পারবে না।
— ছোটো চাচিকে খুব ভালোবাসিস?
— তা তোমাকে বুঝাতে পারব না।
— বুঝাতে হবে না। এখানে সবকিছু লেখা আছে। খুব তাড়াতাড়ি কাজগুলো শেষ করে জয়েন করবে। তোমাকে অভিনন্দন, একেবারে সিনিয়র কর্মকর্তা।
মিষ্টি ভাইয়ের অফিস হতে বের হয়ে মনের খুশিতে হাঁটছে আর ভাবছে দীপ্তি কি নিয়োগপত্র পেয়েছে? হয়তো পেয়েছে। বাসায় ফিরে খেয়ে নেয়। তারপর নিয়োগপত্র খুলে দেখে সাথে অনেকগুলো কাগজপত্র। অঙ্গীকারপত্র, পুলিশ ভেরিফিকেশন, স্বাস্থ্যসংক্রান্ত মেডিকেল রিপোর্ট। হঠাৎ চিন্তায় পড়ে যায় জামী। এই কাগজপত্র তার পক্ষে জোগার করতে বেশি বেগ পেতে হবে না কিন্তু দীপ্তির পক্ষে কি আদৌ সম্ভব। মিশু ভাইয়াকে বলতে হবে। কিন্তু দীপ্তি কি নিয়োগপত্র পেয়েছে। না পেতেই এত চিন্তা তার মাথায় ঢুকছে কেন।
আরো পড়ুন গল্প বিপরীত
মিষ্টির ছোটো খালা আর মিশুর ছোটো ফুফু। এদের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক আবার জামীর ছোটো চাচির একমাত্র কন্যা বেনুর সাথে জামীর রক্তের সম্পর্ক আছে। তারা আপন চাচাতো বোন। মিশু, মিষ্টি আর বেনু এরা পরস্পরে রক্তে আবদ্ধ। তবে কি দাঁড়ায় জামীর সঙ্গে কি রক্তের সম্পর্কে হয় না। পৃথিবীর সবার সাথে কোনো না কোনোভাবে রক্তের সম্পর্ক আছে। এখানে মানুষ মানতে চায় না জাতি-ধর্ম আর অভিজাত্য ভেদে। মিশু আর মিষ্টি এ নিয়ে অনেক আলোচনা করেছে। জামী তাদের দুজনের ভীষণ পছন্দ। তাদের ছোটো ফুফু-খালার নিষেধ জামী চাকুরি পাবে এবং নিজের পায়ে দাঁড়াবে তখন সবার বাসায় যাবে। বেকার ছেলেদের কারো বাসায় যেতে নেই। কথাগুলোর পিছনে যুক্তি আছে।
জামীর ছোটো চাচি আরো বলেছে, বেকার ছেলেরা কারো কাছে গেলে তারা মনে করে নিশ্চিত সাহায্যের জন্য এসেছে। বাসায় ঢোকার পর হতে বাঁকা চোখে দেখতে থাকে। তবে সবার আচরণ যে একই রকম তা ঠিক নয়। ব্যতিক্রম তো আছে। কথাগুলো ফেলে দিতে পারেনি মিশু আর মিষ্টি। বাড়ির ছোটো মেয়েটিকে সবাই খুব আদর করত এবং এখনো আগের মতোই করে। তার মনে কেউ কখনো কষ্ট দেয়নি। দু’জন ভেবে রেখেছে সময় মতো জামীকে পরীক্ষা করবে তার ছোটো চাচিকে কতটুকু ভালোবাসে।
আরও পড়ুন চোখের আলোয় দেখেছিলেম-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৫ম পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
চোখের আলোয় দেখেছিলেম (৪র্থ পর্ব)