চোখের-আলোয়-দেখেছিলেম-৩য়-পর্ব
এ কে আজাদ দুলাল (গল্প),  গল্প,  সাহিত্য

চোখের আলোয় দেখেছিলেম (৩য় পর্ব)

চোখের আলোয় দেখেছিলেম (৩য় পর্ব)

এ কে আজাদ দুলাল

সকালের নাস্তা প্রতিদিন রাজন দিয়ে যায়। টেবিলের ওপর খাবারটা রেখে মৌমাছির মতো ভোঁ করে বের হয়ে যায়। মুখে তো কলুপ আঁটাই আছে। আজ তার ব্যতিক্রম হলো না। জামী একটু সময় নিতে চায়। আগে ব্যাংকের নিয়োগ বিজ্ঞাপনটা হাতে পেতে হবে। নাস্তা শেষ করে বের হয়ে যায় নিত্যদিনের প্রাইভেট পড়ানোর জন্য। আজ ফেরার পথে মিষ্টি ভাইয়ের অফিস হয়ে আসবে। ইদানীং রুমে তালা দিতে হয় না। চুরি হওয়ার মতো কোনো দামী জিনিসপত্র নেই।
প্রায় দেড়টার দিকে মিষ্টি ভাইয়ের অফিসে ঢোকে। মিষ্টি ভাই তার স্বভাব মতো হাসি দিয়ে বলল,
— তা কি খবর জনাব মোহাম্মদ জামী?
জামীর মাথার ভেতরে গতরাতের কাহিনী কেঁচোর মতো কিলবিলি করছে। মিষ্টি ভাইকে এ সব বলা যাবে না। তাই ঘটনা চেপে গিয়ে শান্ত সুরে বলল,
— ভালো আছি। কোন খবর আছে?
— আসলে কিছু খাও, তারপর…
— বাসার খাবার নষ্ট হবে।
মিষ্টি ভাই আর কোন কথা না বাড়িয়ে টেবিলের ড্রয়ার হতে চকচকে একখানা কাগজ বের করে জামীর হাতে দিয়ে বলল,
— ভালো করে পড়ে যথাসময় আবেদনপত্র পূরণ করে জমা দিবে। এখন অনলাইনে আবেদন করতে হয় তাতো জানো। প্রস্তুতি নিতে থাকো। সময় নষ্ট করবে না। ছোট খালার কথা স্মরণ করবে।
জামীর চোখের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ওঠে মিষ্টি ভাইয়া। জামী কৃতজ্ঞতা সাথে হাসি দিয়ে মিষ্টি ভাইয়ের হাত ধরে বলল,
— ভাইয়া এ বার আসি।
রাস্তায় হাঁটছে আর ভাবছে রাজনদের পরিবারের সাথে আরও কিভাবে ঘনিষ্ঠ হওয়া যায় তার একটা সুযোগ পাওয়া গেলো। সামনের দোকান হতে ফটোকপি করে নিতে হবে। তারপর সুযোগ বুঝে অন্দর মহলে পাচার করতে হবে। একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে দ্রুত হাঁটতে থাকে জামী।

আরো পড়ুন গল্প তৃতীয় স্বাক্ষী

বেলা প্রায় তিনটে বাজে। রুমে ঢুকেই চোখে পড়ে ভাতের গামলা। আগে শরীর ঠান্ডা, তারপর মাথা ঠান্ডা। ফ্রেশ হয়ে মনের সুখে সমস্ত খাবার খেয়ে মনের শান্তিতে বিছানার ওপর আয়েশে বসে চাকরির বিজ্ঞাপনের ওপর চোখ রাখে। সিনিয়র জুনিয়র সব ধরনের পদে লোক চাওয়া হয়েছে। নিজের ইচ্ছে মতো ব্যাংকে আবেদন করবে। কিন্তু যার কথা মাথায় রেখে মিষ্টি ভাইয়ের কাছে যাওয়া এবং সোনার হরিণ বিজ্ঞাপন না চাইতে হাতের মুঠোয় তার কাছে কিভাবে পৌঁছানো যায়? একটা পথ বের করতে হবে আর সেটা হলো রাজন। কিন্তু সে এতো চিন্তা করছে কেন? কি যেন নাম? দীপ্তি। কেমন চেহারা। বসন্তে পূর্ণিমা ভরা গভীর রাতে জ্যোৎস্নার মতো দীপ্তময় মুখখানী।

ধ্যাৎ, এ সব কি ভাবছে! সে যেমনই হোক না কেন অন্ধকারে নিমজ্জিত একটা পরিবারকে সাহায্য করা। সমাজের কিছু লোকের চোখে অবহেলিত। মনে হয় সারাক্ষণ ভয়ে থাকে এই তিনটি প্রাণী। বাড়ির বড় ছেলে সেও ত্যাগ করেছে নিজের গর্ভধারণী মা এবং রক্তের সম্পর্কের দুটো ভাই-বোনকে। এটা কেমন মানসিকতা? এতো স্বার্থপর বিবেকহীন মানুষ সমাজে বসবাস করে? একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে জামী। ধীর ধীরে এদের সাথে মিশতে হবে। কারণ মেয়েটিকে না দেখলেও সে যে মেধাবী তার কথাবার্তায় বুঝতে পেরেছে। হয়ত ভেবেই বসবে অসহায় পরিবারের অবিবাহিত একজন যুবতীকে দেখে করুণায় গদগদ করছে। মানুষ বিপদে পড়লে মনে অনেক রকম চিন্তা ভাবনা মাথায় ভর করে বসে। রাজনের সাথে বন্ধুত্ব তারপর মহিলা এবং সর্বশেষ মেয়েটির আচরণ জানতে পারলেই মাঠে নামবে জামী। কিন্তু সময় নষ্ট করা যাবে না। আবেদনের শেষ তারিখের আগেই বিজ্ঞাপন মেয়েটির হাতে পৌঁছাতে হবে। আজ রাতেই কার্যক্রম শুরু করতে হবে। আল্লাহ সহায় থেকো। তার মনে কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই। একটা পরিবারকে শুধু সাহায্য সহযোগিতা করা মাত্র।

কিছুটা মনের প্রশান্তি নিয়ে বের হলো বৈকালিক টিউশনির উদ্দেশ্যে। ফিরতে রাত নয়টা বেজে যাবে। চাকরি বিজ্ঞাপনের ফটোকপি টেবিলে এমনভাবে রাখা হয়েছে যেন কেউ খাবার নিয়ে এলে চোখে পড়বেই। ইচ্ছে করে আজ একটু দেরিতে ফিরবে।

আরো পড়ুন গল্প সোনালী

প্রতিদিনের মতো আজও রাজন এবং তার মা খাবার নিয়ে জামীর রুমে ঢোকে। রাজন আজ রুমটা বেশ ভালোভাবে দেখে নিল। টেবিলে কিছু বই। তাও আবার সাধারণ জ্ঞানের। এর মধ্যে আছে ব্যাংক নিয়োগের ওপর একখানা মোটা বই। বইখানা হাতে নিতেই চোখে পড়ে বিজ্ঞাপনের ফটোকপি।
— মা, দেখ চাকরির বিজ্ঞাপন। তাও আবার ব্যাংকের। আপাকে দরখাস্ত করতে বলো না।

রাজনের মা একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিল। রাজনের কথার কোনো জবাব না দিয়ে ছেলেকে নিয়ে রুম হতে বের হয়ে যায়। রাত দশটায় রুমে ফেরে জামী। প্রথমে বিজ্ঞাপনের ওপর নজর পড়তেই বুঝে নেয় এটায় কারো হাত পড়েছে। এ বার অপেক্ষার পালা।

রাত অনুমানিক এগারোটা তো হবেই। এ বাসায় এক ডালি নিরবতা মাথায় দিয়ে নেমে এসেছে অন্ধকার। দোতলায় ভাড়াটিয়ার একটা রুমে আলো জ্বলছে আর গেটে পঞ্চাশ পাওয়ারের একটা ফিলিপস বাল্ব জ্বলছে। অন্ধকার রাতে গ্রামের কোনো জঙ্গল হতে ধুতুম পেঁচা ডাক শোনা যায় ঠিক তেমনি একটা নারীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো জামীর রুম পর্যন্ত। জামী তার পঞ্চম ইন্দ্র সজাগ করল।
— দীপ্তি, একটা চাকরির চেষ্টা করে দেখ না মা। বাড়ি ভাড়া আর সামান্য কিছু টাকা ব্যাংকে গচ্ছিত আছে। টাকার অভাবে রাজন প্রাইভেট পড়তে পারছে না। এভাবে আর কতদিন নিজেরা শাস্তি ভোগ করবি? সমাজের ওপর অভিমান করে নিজেকে কেন কষ্ট দিবি?
— মা, তোমার সব কথা বুঝলাম। কিন্তু চাকরি কে দিবে? কোন অফিসে জনবল নিবে কেমন করে জানবো? একটা মোবাইল ছিলো টাকার অভাবে সেটাও বন্ধ হয়ে আছে।
মনে হলো দীপ্তির কথা শুনে তার মা কিছুটা আশ্বস্ত হলো।
— আজ রাতে ছেলেটার রুমে খাবার দিতে গিয়ে দেখি তার টেবিলের ওপর রাখা ব্যাংকের একটা বিজ্ঞাপন। অনেক জনবল নিবে। মহিলার কথা শেষ না হতেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো মেয়েটি।
— কে কোথার জানা নেই, শোনা নেই। মিনতির সুরে, নত হয়ে বলবে, বাবা তোমার বিজ্ঞাপনখানা দাও আমার বেকার অবিবাহিত মেয়ে আবেদন করবে।
— তা বলতে যাবো কেন? ও তো দিনের বেশির ভাগ সময় বাইরে থাকে। এক ফাঁকে রাজন ফটো কপি করে আনবে।

আরো পড়ুন গল্প বৃষ্টিভেজা গোলাপের ঘ্রাণ

মেয়েটি কথা শুনে চুপ হয়ে গেলো। তার মানে দাঁড়ায় প্রস্তাবটা পছন্দ হয়েছে। কারও কোনো জিনিস অনুমতি ছাড়া নেয়া ঠিক নয়। এটা এ পরিবারে তিনটি প্রাণী তা জানে। মানুষ বিপদে পড়লে এইভাবে হয়ত কিছুটা নৈতিকতা হারায়। এখানে তাই ঘটলো। জামী এই সুযোগটা কাজে লাগাতে চায়। আবার আগের মতো বাড়ির নিচের তলা নিশ্চুপ হয়ে যায়।

নিচের তলার বাসিন্দা তিনটি প্রাণীর ভেতরে নতুন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। রাজনের ব্যস্ত সময় কাটছে। এখন শুধু রাজনকে হাত করা। নয়টার মধ্যে বাসায় ফেরে জামী। আজ টেবিলে খাবার না দেখে অবাক হয়ে গেলো। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না জামীর। খোশমেজাজে খাবার নিয়ে হাজির হলো রাজন। হঠাৎ গুমরা মুখে চাঁদের হাসি। জামী কিছুটা যে অবাক হয়নি তা নয়। তবে সেটা প্রকাশ করলো না।
— বসতে পারি?
— অবশ্যই।
জামীর পাশে খালি জায়গায় বসতে বলল।
রাজন কোনো রকম সংকোচ না করে জামীর গা ঘেঁষে বসল।
— কিছু বলতে চাও?
— না, তেমন কিছু না। এত দিন এখানে আছেন অথচ কোনো কথাই হয়নি। তাই ভাবলাম আলাপ করা যাক।
—  এবার বলো পরীক্ষা কবে?
— দেরি আছে। নিয়মিত কলেজে যাওয়া হয় না। জানেন তো বাণিজ্য বিভাগে পড়ি। অসুবিধা হয় না। তবে…
— বাংলা, ইংরেজি এই তো…
— আপনি কেমন করে বুঝলেন?
জামী মনে মনে একবার হেসে নিলো। যেমন করে তোমাদের অনেক খবর জানা হয়ে গেছে। বাকিটা শুরু হতে যাচ্ছে।
— শোন, তোমার যদি কোনো অসুবিধা না হয় তাহলে বাংলা, ইংরেজি আমার কাছে পড়তে পারো।
— কিন্তু…
— কিন্তু আবার কি? তোমাকে পড়াতে পারলে আমারই লাভ। তাহলে তোমার সুবিধা মতো চলে আসবে।
— আপনাকে কি বলে ডাকব?
— তোমার ইচ্ছে।

আরো পড়ুন  গল্প কবর

চাকুরির আবেদনের পর হতে ভূতুরে বাড়িতে এখন আলোর মুখ দেখা যাচ্ছে। বেশ রাত পর্যন্ত জামীর রুমের সোজাসুজি একটা রুমে আলো জ্বলতে দেখা যায়। যদিও দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ এই জানালা। তবুও জানালার ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে আলো ছিটকে পড়ছে বাইরে। দীপ্তির মনের ভেতরে নতুন আশার আলো জ্বলে উঠেছে। হঠাৎ করেই ভাড়াটিয়া জামীর কথা নিঃশব্দে মনের গগনে ভেসে ওঠলো। তাকে ক’বার দেখেছে। ভদ্রলোককে খারাপ ভাববার কোনো কারণ নেই। খারাপ কোনো অভিসন্ধি এখন পর্যন্ত চোখে পরেনি। আগের অভিজ্ঞতা হতে তাই মনে হলো দীপ্তির। ক’বার খাবার নিয়ে তার ছোট ভাই রাজনের সাথে রুমে গিয়েছে। বেশ গোছানো এবং পরিপাটি করে রেখেছে রুমটি। ভদ্রলোক তো ব্যাংকে চাকরির জন্য আবেদন করেছে। টেবিলের ওপর রাখা বইগুলোর নাম মনের ভেতরে নোট করে নিয়েছে এবং ইতোমধ্যে কিনেছে। মনে মনে একটু হেসে নিলো।

অন্তত তিন দিন তার সামনে দিয়ে বের হয়েছে। কিন্তু সে ছিলো বোরখা পরিহিতা। মনের ভেতরে হাজারটা প্রশ্ন, চাকরি হবে তো। সব কিছু ঠিকঠাক। কিন্তু পুলিশ তদন্ত রির্পোটে যদি উল্লেখ থাকে প্রার্থীর বাবা একজন দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি ছিলো। দুর্নীতির দায়ে জেলহাজত বাস করেছিল। শুধু তাই আত্মহত্যা করেছিলো। না, আর ভাবতে পারছে না দীপ্তি। স্কুলের চাকরিটা হলো না। একজন মহিলা অভিভাবক অভিযোগ করার প্রেক্ষিতে স্কুল কর্তৃপক্ষ স্কুলে যেতে নিষেধ করেছিল। শুধু মাস্টার্স পরীক্ষা পর্যন্ত বাইরে যেতো দীপ্তি। তারপর হতে নিজ ইচ্ছে গৃহবন্দি। আবার নতুন আলো দেখতে পারছে দীপ্তি। এবার সে হারবে না।

জনজীবন জলোচ্ছ্বাসে যখন নিমজ্জিত হতে থাকে বাঁচার জন্য হাতের কাছে যা পায় তাই আঁকড়ে ধরে। তার জীবনে এমন একটা সময় এসেছে হয়ত কেউ অজান্তে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কৃতজ্ঞতায় মাথা নত হয়ে যায় দীপ্তির। সেই দিনের অপেক্ষায় সামনে গিয়ে চোখ তুলে কৃতজ্ঞতা স্বীকার কববে নির্দিধায়। পরিত্যক্ত মোবাইল আবার সচল হয়েছে। মোবাইলে চেয়ে দেখে রাত দুটো বাজে। আজ প্রায় দু’বছর রাত নয়টার পর এ বাসায় আলো জ্বলে না।

আরও পড়ুন চোখের আলোয় দেখেছিলেম-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
শেষ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও  ইউটিউব চ্যানেলে

চোখের আলোয় দেখেছিলেম (৩য় পর্ব)

Facebook Comments Box

এ কে আজাদ দুলাল মূলত একজন গল্পকার। এছড়াও তিনি কবিতা ও উপন্যাস লিখছেন। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: বিবর্ণ সন্ধ্যা, তুমি রবে নীরবে; উপন্যাস: জোছনায় ভেজা বর্ষা। তিনি ১৯৫১ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালী ইউনিয়নের নুরুদ্দীনপুর গ্রাম তাঁর পৈতৃক নিবাস ।

error: Content is protected !!