চোখের-আলোয়-দেখেছিলেম-২য়-পর্ব
এ কে আজাদ দুলাল (গল্প),  গল্প,  সাহিত্য

চোখের আলোয় দেখেছিলেম (২য় পর্ব)

চোখের আলোয় দেখেছিলেম (২য় পর্ব)

এ কে আজাদ দুলাল

 

শুক্রবার। আজ ছুটির দিন। প্রয়োজনীয় কাজ সেরে বসে চাকরির গাইড পড়ছে জামি। এমন সময় গৃহকর্তী তার ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে হাজির। প্রমোদ গুনলো জামী; কোনো অভিযোগ নিয়ে এলেন না-কি। সরাসরি প্রশ্ন,
— কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি?
জামী স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল,
— না, তেমন কিছু না।
— না বলতে তো হবে না। আমার ধারণা হচ্ছে। আপনার অসুবিধার কথা ভেবেই বলছি। এতে আপনার সুবিধা বেশি আমার একটু বাড়তি কাজ।
— বেশ, বলুন। আপনার প্রস্তাব কি ভেবে দেখা যেতে পারে।
— আমাদের সাথে পেইনগেস্ট হিসেবে খেতে পারেন। সকালের নাস্তা এবং দু’বেলা ভাত। আমরা যা খাবো আপনাকে তাই খেতে হবে। মাসে দু’হাজার টাকা দিতে হবে বাড়ি ভাড়ার সাথে।
এমন একটা প্রস্তাব পেয়ে জামী কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। ভেতরে আনন্দের ঢেউ খেলে যাচ্ছে।
— আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দিবো, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। তবে কোনো অসুবিধা না হলে আগামীকাল হতে চলতে পারে।
— ধন্যবাদের কি আছে? আপনার অসুবিধা হচ্ছে তা বুঝতে পেরেছি বলেই আমি নিজেই বলতে এসেছি।
মোহাম্মদ জামী বুদ্ধিমান এবং চালাক ছেলে। কোনো কথা না বাড়িয়ে বালিশের তলা হতে মানিব্যাগ বের করে গুনে দু’হাজার টাকা বের করে মহিলার হাতে ধরিয়ে দিলো। মহিলা টাকা পেয়ে খুশি হলো কি-না বুঝা গেলো না। জামী একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। বিষয়টি মিষ্টি ভাইয়া বলা যাবে না।
— আপনার জন্য নাস্তা পাঠিয়ে দিচ্ছি। এ হলো আমার ছোট ছেলে রাজন। এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিবে।
— আমাকে তুমি বলতে পারেন।
বাড়িওয়ালি মুচকি হেসে রুম হতে বের হয়ে যায়। জামী একটা দুশ্চিন্তা হতে রেহাই পেলো। সকাল-বিকাল টিউশনি বাকি সময় চাকরির জন্য প্রস্তুতি।

আরো পড়ুন গল্প ভাঙা গড়ার টান

মোহাম্মদ জামীর মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। এ বাসায় কতজন সদস্য বাস করে? এ পর্যন্ত মহিলা এবং তার ষোল-সতের বছরের কলেজ পড়ুয়া ছেলে ছাড়া কাউকে চোখে পড়েনি। তার রুমটা এমন জায়গায় অবস্থিত যে, গেট দিয়ে কে বের হচ্ছে আর কে ঢুকছে তা দেখার সুযোগ নেই। প্রতিদিন সকাল দশটার দিকে একজন বুয়াকে দেখা যায় কলতলায় কাপড় পরিস্কার করতে।

শ্রাবণ মাস। আজ সন্ধ্যার পর হতে আকাশটা মেঘে ঢেকে আছে। কিছু সময় আগেই রুমে ফিরেছে জামী। আকাশের অবস্থা ভালো নয়। বেশ কিছু দিন ধরে বৃষ্টির কোনো আলামত নেই। মনের কথা মনে থাকতে ঝুমঝুম শব্দে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। যেকোনো সময় বিদ্যুৎ চলে যেতে পারে। তাই মোমবাতি আর দেয়াশলাই হাতের কাছে রেখে বাইরে তাকায় জামী। ইতোমধ্যে মুসলধারায় বৃষ্টি পড়ছে। সামনের খালি জায়গায় বৃষ্টির পানি জমে গেছে। মাঝে মাঝে মেঘের গর্জন কম্পিত হচ্ছে সারা আকাশ জুড়ে। মন্দ লাগছে না তার। সময়টা কবি সাহিত্যকদের জন্য। কেনো যেন নিঃসঙ্গ মনে করছে নিজেকে। প্রায় ঘন্টাখানেক বৃষ্টি হওয়ার পর হঠাৎ করেই বৃষ্টি থেমে যায়।

জামী একটা বিষয় এখনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি; এই কক্ষের অবস্থান এতোটা নির্জন পরিবেশে কেন। কোনো কারণ তো আছেই। রাজন নামের ছেলেটি রাতের খাবার টেবিলে রেখে নিঃশব্দে বের হয়ে যায়। মুখে কুলুপ মারা। আর যাহোক ছেলেটা দেখতে দারুণ। আলাপ করতেই হবে। খাবারটা দেখে খুশি হলো জামী। ডিম ভাজি সাথে এক টুকরা বেগুনভাজি। খাওয়া দাওয়া শেষ হতে দশটা বেজে যায়। আকাশে তখন আলোছায়া মেঘের খেলা চলছে আর সাথে লুকোচুরি খেলছে একাদশীর চাঁদ। আসলেই আজকের রাতটা উদাসীন মনের ভাবুকের। মনের ভেতরে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় জামী। গভীর রাত না হলেও এই বাড়িটির নীচ তলায় নেমে এসেছে গভীর নির্জনতা। কোনো আলো নেই, নেই কোনো সাড়াশব্দ।
এ যেন গ্রামে রাস্তার ধারে অবস্থিত কবরস্থান। হঠাৎ অন্ধকার কবরস্থান হতে দুজন মহিলার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। বয়সের ব্যবধান কণ্ঠস্বর দুটো। একজনের কণ্ঠস্বর তার পরিচিত মনে হচ্ছে। অন্য কণ্ঠস্বর অল্প বয়সী তরুণীর হতে পারে।

আরো পড়ুন গল্প সুরেন বাবু

পনের দিনের বেশি হতে চলেছে। মহিলা ছাড়া অন্য কাউকে চোখে পড়েনি। পড়বেই বা কেমন করে; রুম হতে কোনো কিছু দেখার সুযোগ নেই। তবে ইতোপূর্বে সে এমন কণ্ঠস্বর শুনেনি। বেশ উৎসাহিত হয়ে বিছানা হতে উঠে জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়। যদিও কাজটা অশোভন তবুও মনের ভেতরে এ ক’দিনের সন্দেহ দূর করতে এমন কাজ করতে হচ্ছে। হঠাৎ কেনোই বা বাড়িওয়ালি নিজ গরজে তিন বেলা খাওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। যদিও তার খরচ বহন করতে হবে জামীকে। কান সজাগ করতেই মেয়েটির কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। বেশ মুলায়েম কণ্ঠস্বর কিন্তু অভিযোগ এবং বেদনাহত তার কণ্ঠে। কথাগুলো শুনতেই জামী বেশ ভাবান্তর হয়ে পড়ে। তবে নিজেকে সামলে নিয়ে সজাগ হয়।
— মা, আমাদের দোষ কোথায়? প্রায় পাঁচটি বছর হতে চলেছে আমাদের জীবনের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে।
জামীর আবার চিন্তায় পড়লো। তাহলে কি পাঁচ বছর আগে এই মেয়েটির জীবনে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছিলো? কিন্তু এ বাসায় কোনো বড় পুরুষ মানুষকে চোখে পড়েনি। বাসা ভাড়া থেকে এ পর্যন্ত যা হয়েছে মহিলা এবং তার ছেলের মাধ্যমে।
এর শেষ দেখতে হবে। তাকে ফেলুদার ভূমিকায় গোয়েন্দাগীরি করতে হবে। আবার সেই কণ্ঠস্বর।
— তোমাদের ব্রিলিয়েন্ট সুযোগ্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হতে এমবি করা সুপুত্র সেই যে ধনীকন্যা বৌয়ের হাত ধরে চলে গেলেন আর ফিরে তাকালেন না। বেসরকারি ব্যাংকের সিনিয়র কর্মকর্তা মারুফ। থাক নামের শেষ অংশ আর বলতে চাই না। হয়ত এতোদিন এভিঢেভিট করে নামের শেষে শ্বশুরের নাম যোগ করে নিয়েছেন। কিন্তু আমরা তো তা পারিনি। হাজার হোক জন্মদাতা পিতা। যত দোষ করে থাকুন এই সত্য তো অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু আজ পর্যন্ত বাবার কি দোষ তার অফিস হতে জানতে পারলাম না। দুর্নীতির অভিযোগে তার চাকরি গেলো। এমন কি জেল ভোগ করতে হয়েছিল। জেল হতে বের হয়ে এলেন বাবা। কিন্তু সেই বাবা নেই; অন্য এক অপরিচিত মানুষ। সবার দিকে কেমন করুণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতেন।

আরো পড়ুন গল্প অতিথি আসন

মা, তোমার মনে আছে? তুমি বলেছিলে – বাড়ি বিক্রি করে মামলা করবো কোর্টে। বাবা চিৎকার করে বলেছিলেন – না, না, না এটা তোমার নামে বাড়ি, এটাই একমাত্র আশ্রয়স্থল। ডাক্তার বলেছিলেন এ সব মানুষকে চোখে চোখে রাখার জন্য। কারণ, এদের ভেতরে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু আমরা তা পারিনি।
— চুপ কর। এ সব শুনতে আমার ভালো লাগে না। তোদের দু’জনকে নিয়ে বাকি জীবন বেঁচে থাকতে চাই।
— মা, এটাকে বেঁচে থাকা বলে না। জীবন হতে দূরে সরে থাকা। আমাদের কি সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা! একজনের দোষে সারা পরিবারের লোকদের সাজা ভোগ করতে হচ্ছে। বলতে পারো কোন অপরাধে তোমার পনের বছর স্কুলের চাকরি ছেড়ে আসতে হলো? কোন অপরাধে রাজনকে স্কুল ছাড়তে হলো। এখান হতে দূরে একটা সাধারণ স্কুলে পড়তে হয়েছে। চক্ষুলজ্জায় কারো কাছে প্রাইভেট পড়তে পারে না। এমএ পরীক্ষা তো শেষ হলো। কে চাকরি দিবে? তোমার যেমন চাকরি করা হয়নি তেমনি আমার চাকরি করা হবে না। কেউ চাকরি আমাকে দিবে না। আঙ্গুল তুলে বলবে, “ওর বাবা দুর্নীতির দায়ে সাজা হয়েছিল, পরে আত্মহত্যা করেছিল।” কিন্তু আসল ঘটনা কেউ জানলো না। তোমাদের প্রথম সন্তান নিজের মান-মর্যাদা রক্ষার জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। তবুও আমি কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ তুলবো না।
— দীপ্তি মা, এ বার চুপ কর। রাত অনেক হয়েছে। এবার ঘুমাতে যা। সকালে অনেক কাজ আছে।

আরো পড়ুন গল্প অচেনা

আসলেই তো অনেক রাত হয়েছে। জীবনে এমন ঘটনা তো কখনো শুনেনি মোহাম্মদ জামী নামের এই যুবকটি। এ যে উপন্যাসের কাহিনী। কিন্তু এর শেষ কোথায়। যে করেই হোক রহস্যভেদ করে ঘটনার ভেতরে প্রবেশ করতে হবে। এদের বাবার কি এমন অপরাধ ছিলো যে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করতে হয়েছিল? ঘটনাগুলো মনের ভেতরে সাজিয়ে রাখে জামী। আর ভাবছে ব্যাংকের চাকরি বিজ্ঞাপন পেলে মেয়েটিকে কিভাবে জানানো যায়। সেটা পরে ভাবা যাবে। এই পরিবারের সাথে কিভাবে ঘনিষ্ঠ হওয়া যায় সেই পথ বের করতে হবে। এক ডালি চিন্তা মাথার ভেতরে নিয়ে ঘুমাতে যায় জামী।

আরও পড়ুন চোখের আলোয় দেখেছিলেম-
১ম পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
শেষ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও  ইউটিউব চ্যানেলে

চোখের আলোয় দেখেছিলেম (২য় পর্ব)

Facebook Comments Box

এ কে আজাদ দুলাল মূলত একজন গল্পকার। এছড়াও তিনি কবিতা ও উপন্যাস লিখছেন। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: বিবর্ণ সন্ধ্যা, তুমি রবে নীরবে; উপন্যাস: জোছনায় ভেজা বর্ষা। তিনি ১৯৫১ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালী ইউনিয়নের নুরুদ্দীনপুর গ্রাম তাঁর পৈতৃক নিবাস ।

error: Content is protected !!