চোখের আলোয় দেখেছিলেম (শেষ পর্ব)
চোখের আলোয় দেখেছিলেম (শেষ পর্ব)
এ কে আজাদ দুলাল
বাড়িওয়ালি খালাম্মা কোনো কথা না বলে শুধু চোখের পানি ফেলে, ছেলে রাজনকে নিয়ে রুম হতে বের হয়ে আসে। জামী কিছু সময় চুপচাপ থেকে খাবার খেতে বসে। তার মনে আজ খুব আনন্দ।
একটা পরিবারকে ধ্বংসের কিনারা হতে রক্ষা করতে পেরেছে। যাকে সাহায্য করছে আজ পর্যন্ত তার দেখা মেলেনি। সে কি ভাবছে। আসলে কি মেয়েটির প্রতি করুণা না-কি এই অসহায় পরিবারকে ধ্বংসের হাত রক্ষার মন-মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে এসেছে। হয়ত সময় একদিন বলে দিবে। তবে না দেখে তো কারও প্রেমে পড়া যায় না। এমন কি তার কোনো প্রশংসা শুনেনি। এখন পর্যন্ত তাকে নিয়ে মনের ভেতরে কোনো কাল্পনিক ছবি আঁকা হয়নি।
আজ সোমবার। এ বাসায় আলাদা আমেজ। সকাল আটটার মধ্যে ব্যতিক্রম নাস্তা এবং সাথে কফি। নাস্তা-কফি শেষ করে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসসহ বের হয়ে যায় জামী। মিশু ভাইয়াকে কথা দিয়েছে সোমবারে চাকুরিতে যোগদান করবে। ঢাকায় তার নিকট আত্মীয় বলতে কেউ নেই। কিন্তু মিষ্টি আর মিশু ভাইয়া তার পরম আত্মীয়। ছোটো চাচি আর মা-বাবার কথা মনে পড়ে যায় জামীর। সবাই ছোটো চাচিকে ছোট মা ডাকতে বলত কিন্তু ছোটো চাচির একদম অপছন্দ। তার কথা পৃথিবীতে মা একজনই। তার স্থান অন্য কেউ নিতে পারে না। সৎ মা যতই আপন হোক না কেন, কোনো একসময় মা থাকে না। কথায় বলে “নাড়ীর একটা টান আছে না।” মনে পড়ে ছোটো চাচার সাথে পাশের গ্রামে বটতলায় কালীপূজা দেখতে যেত। একটা ছোটো ঘরের ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা কালী; লাল রঙের জিহ্বা তার ওপরে সাদা ঝকঝকে দাঁত। মনের স্মৃতিতে গেঁথে রেখেছিল। আর মনে মনে এমন চেহারার মানুষকে খুঁজে বেড়াত সেই কিশোর বয়স হতে।
আরো পড়ুন গল্প প্রিয়তমার লাল চোখ
কি ভাগ্য জামীর! জামীর ছোটো চাচার বিয়ে; ধুমধাম করে বিয়ে দিয়ে বাড়িতে নতুন বৌ নিয়ে সবাই উপস্থিত। দূরে এবং ছোটো বলে জামীকে সাথে নেওয়া হয়নি। তাই ওর ভীষণ মন খারাপ। সুন্দর করে সাজানো লাল বেনারসিপরিহিতা নতুন বৌ খাটে বসে আছে। সকালে ঘুম ভেঙে দেখে তাদের বাড়িতে সবাই আনন্দে মেতে ওঠেছে। নতুন বৌ ঘোঁমটা দিয়ে খাটের ওপর বসে আছে। আস্তে আস্তে কাছে যায় জামী। ঘোঁমটার ভেতর হতে জামীকে দেখে জিহ্বা বের করে ভেংচি মারে নতুন বৌ। জামীর এই দৃশ্য দেখে তার স্মৃতিপটে আঁকা ছোটোবেলার সেই কালীর চেহারা ভেসে ওঠে। আর কালবিলম্ব না করে ছুটে গিয়ে নতুন বৌয়ের গলা ধরে বলে,”পাইছি তোমাকে। এতদিন কালি ঘরে দাঁড়িয়ে জিহ্বা বের করে থাকতে। আর কোনোদিন তোমাকে ছাড়ব না।”
জামীর সে কাণ্ড দেখে উপস্থিত সবাই তাজ্জব বুনে যায়। জামীর মুখে তার ছোটোবেলার ঘটনা শুনে মিশু-মিষ্টি ভীষণ মজায় পায়। সেই দিন হতে ছোটো চাচি আর জামী আত্মার বন্ধন হয়ে আছে। সেই ছোটো চাচির কথা মনে পড়তেই দু’চোখ বেয়ে পানি বের হয়ে আসে জামীর।
ব্যাংকে যাবতীয় কাগজপত্রসহ এবং যোগদানপত্র দাখিল করে ব্যাংক ত্যাগ করে জামী। আজ মনটা বেশ ফুরফুরে । সোজা চলে যায় মিষ্টি ভাইয়ের অফিসে। দেখা মেলে মিষ্টি ভাইয়ের সাথে।
— কী খবর? আজ তো যোগদান করে আসলে।
— তুমি জানলে কেমন করে? ও বুঝেছি মিশু ভাইয়া বলেছেন।
— শোন, এখন হতে তুমি একজন ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার। এটা ব্যাংকের চাকুরি, খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করে যাবে। বুঝতে পেরেছ? তোমার ছোটো চাচিকে আসতে বলে দেই।
— না না। এখনো নয়। সময় হলে তোমাদের দুজনকে বলব। ভাইয়া এখন যাই।
আরো পড়ুন গল্প নিরুপায় নীলাঞ্জনা
এই প্রথম রিক্সায় বাসায় ফেরে জামী। বাসার ছোটো গেট দিয়ে ঢুকতে চোখে পড়ে ড্রইং রুমের দিকে। যেখানে সূর্যের আলো কখনো মুখ দেখেনি আজ টিউব আলোয় ঝলমল করছে। এখনো সন্ধ্যারাণীর আগমন হয়নি। জামী মৃদু হেসে তার বর্হির আঙ্গিনায় অবস্থিত রুমে গিয়ে ঢোকে। আসলে মানুষের জীবনে সুদিন আসলে মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। কিছুসময় বিশ্রাম নিয়ে ফ্রেস হয়ে বিছানার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে যায়। আজ আর দেহে-মনে কোনো ক্লান্তি নেই।
— ভাইয়া, ভেতরে আসতে পারি?
— এস।
— মা, আপনাকে ডেকেছেন।
— ঠিক আছে। তুমি যাও, আসছি।
কী কারণে ডাকবে। হয়তো বড়ো করে ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে; তার সাথে কিছু মিষ্টি। সেটা আমাদের সমাজের প্রচলন প্রথা। টাওজারের ওপর মেরুন রঙের টি-শার্ট পরে রাজনদের ড্রইং রুমে ঢোকে। আগের সেই অগোছালো ড্রইংরুম নেই। বেশ সাজানো গোছানো, আগের চেয়ে পরিপাটি। এবার দিয়ে তিন বার আসা হলো এবং জামী প্রথম দিনে যে সোফায় বসেছিল আজও ঠিক সেই সোফায় বসে। মিনিট দুয়ের মধ্যে বাড়িওয়ালি খালাম্মা এসে ঠিক জামীর ডান পাশে রাখা ডবল সিটের সোফায় বসল। রাজন তার মায়ের পাশে বসে। আজকের বাড়িওয়ালি খালাম্মা বেশভূষায় বেশ মার্জিত। এককালে ভদ্র পরিবারের গৃহিণী ছিলেন; তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। কোনো ভূমিকা অবতরণ না করে সোজাসাপটা নিজের আবেগজড়িত কণ্ঠে বলে,
— বাবা, তোমার ঋণ আমার পরিবার কোনোদিনই পরিশোধ করতে পারবে না। তোমাকে আল্লাহ তায়ালা ত্রাণকর্তা হিসেবে আমাদের বাসায় পাঠিয়েছেন। তোমার যতদিন ইচ্ছে এখানে থাকতে পারো।
জামীর মনে একটা প্রশ্ন, এরপর মহিলা কী বলবেন। যার জন্য এত কিছু করা হলো তার কি কোনো সৌজন্যবোধ নেই; একটা ধন্যবাদ দেওয়ার।
— তুমি একটু বসো।
আরো পড়ুন গল্প নতুন সূর্যের অপেক্ষায়
দীপ্তি আজ নির্বাক। এত আনন্দের মধ্যে তার মনের ভেতরে কেমন যেন একটা শূন্যতা বিরাজ করছে। এতদিন নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিল। জামী নামের এই অপরিচিত যুবকটি তাকে আলো দেখিয়েছে। আজ সে ব্যাংকের জুনিয়র অফিসার। কীভাবে, কি বলে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। তাকে কী ভালোবাসা যায়। বিশ্বাস আর ভালোবাসা কী একই পথে চলে। এর উত্তর তার জানা নেই। তবুও তো কৃতজ্ঞতাবোধ বলে একটা জিনিস আছে। বাবার দেওয়া সেই পুরোনো ক্যাসেট প্লেয়ারটায় রবীন্দ্রসঙ্গীত সেট করে আস্তে ভলিউম দিয়ে সাধারণ পোশাকে এসে দরজার পাশে দাঁড়ায় দীপ্তি। চোখে-মুখে কোনো দুর্ভাবনার লেশ মাত্র নেই। শরতে সদ্য ফুটন্ত পদ্মফুল তবুও কেন যেন চোখে-মুখে বিষন্নতার ছাপ। পূর্ণিমার শেষ রাতের চাঁদের আলোয় আলোকিত চেহারা। চোখ তুলে তাকায় জামীর দিকে – আমি তোমার অপেক্ষায় ওহে সন্ধ্যার বেলার মালতি।
কার যেন পায়ের শব্দে পুলকিত হয় জামীর মন। চোখ তুলে দেখে তার সামনের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে দীপ্তিময়ী আয়ত আঁখি এক রূপবতী তরুণী। এতদিন ঝিনুকে বন্দি ছিল মুক্তা। এমন চেহারা ইতোপূর্বে তার চোখে পড়েনি। চোখে চোখ পরতেই দু’জনের চেহারায় রাঙিয়ে যায় ভালোবাসার রঙ। এ দেখা যে মনের দেখা। কতক্ষণ দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে ছিল বুঝতে পারেনি। তখনই ক্যাসেট প্লেয়ারে ভেসে এল –
চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে।
অন্তরে আজ দেখব, যখন আলোক নাহি রে
ধরায় যখন দাও না ধরা হৃদয় তখন তোমায় ভরা,
এখন তোমার আপন আলোয় তোমায় চাহি রে।
আরও পড়ুন চোখের আলোয় দেখেছিলেম-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
৫ম পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
চোখের আলোয় দেখেছিলেম (শেষ পর্ব)