ঘুরে-এলাম-পর্তুগ্রাল-১ম-পর্ব
তাহমিনা খাতুন (ভ্রমণকাহিনি),  ভ্রমণকাহিনি,  সাহিত্য

ঘুরে এলাম পর্তুগাল (১ম পর্ব)

ঘুরে এলাম পর্তুগাল (১ম পর্ব)

তাহমিনা খাতুন

 

পর্তুগীজ-নাবিকদের-সমুদ্র-যাত্রা-শুরুর-স্থানের-মানচিত্র
পর্তুগীজ নাবিকদের সমুদ্র যাত্রা শুরুর স্থানের মানচিত্র

আমার মত অনেকেরই হয়তো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই পর্তুগীজ জল দস্যুদের কথা জানা থাকবে। ইতিহাসে আগ্রহীদের জানা আছে, আরাকানের মগ আর পর্তুগীজ জল দস্যু মিলে এক সময়ে বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলের জনজীবনে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। বাংলায় ‘হার্মাদ’ শব্দটির সঙ্গেও আমরা অনেকেই পরিচিত। পর্তুগীজ শব্দ ‘আর্মাডা’ থেকেই ’হার্মাদ’ শব্দটির উৎপত্তি। ‘আর্মাডা’ ছিল ১৩০টি জাহাজের সমন্বয়ে গঠিত স্পেনের এক বিশাল নৌ বাহিনী। ১৫৮৮ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের রানী ১ম এলিজাবেথকে ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্দেশ্যে বর্তমান পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে এই জাহাজ যাত্রা শুরু করেছিল- এটাও ইতিহাসের বিষয়। এই মগ আর পর্তুগীজ জলদস্যুদের অত্যাচারের কাহিনী বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় এক ভীতিকর পরিবেশ তৈরী করেছিল- এটিও বহুল শ্রুত বিষয়। আমাদের ইতিহাসের একটি অংশের সাথে যুক্ত ইউরোপের এই দেশটি দেখার আগ্রহ থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। আর এ কারণে পর্তুগাল ভ্রমণের একটি পরিকল্পনা করা গেল।

পর্তুগাল দক্ষিণ ইউরোপের একটি রাষ্ট্র। এটি প্রাকৃতিক বৈচিত্রে ভরা একটি দেশ! মহাসমুদ্র, পাহাড়, নদী, দ্বীপ, প্রাচীন গুহা, আগ্নেয়গিরি,বরফ সবই রয়েছে এদেশে! পর্তুগালের রয়েছে প্রাচীন ইতিহাস। ইউরোপের অনেক ঔপনিবেশিক শাসকদের মত পর্তুগালেরও ছিল বিশাল উপনিবেশ! মধ্যযুগের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ভৌগোলিক আবিষ্কারের যুগে শুরু হয় পর্তুগালের আবিষ্কৃত ভূখণ্ডে আধিপত্য বিস্তারের ইতিহাস! অধিকৃত ভূখণ্ডের ক্রমাগত বিস্তারের ফলে এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী হয় পর্তুগাল এবং ক্রমান্বয়ে পর্তুগাল বিশ্বের একটি প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়। কিন্তু ১৫৭৮ খ্রিস্টাব্দে মরক্কোর মুসলমান শাসকদের সাথে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কারণে দেশটির পতনের ইতিহাসেরও সূচনা হয়। পর্তুগালের সম্পদের ঘাটতি দেখা দেয়। সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনী দূর্বল হয়ে পড়ে এবং এর আন্তর্জাতিক মর্যাদা হ্রাস পায়। শেষ পর্যন্ত পর্তুগাল স্প্যানীশ আর্মাডার (নৌবাহিনী) অংশে পরিণত হয়।

আরও পড়ুন ভ্রমণকাহিনী নেপোলিয়ান বোনাপার্টের দেশে

সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি দেশটির পূর্বতন মর্যাদা কিছুটা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হলেও ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে এক ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে রাজধানী লিসবন ভয়ানক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে নেপোলিয়নিয় যুদ্ধ এবং ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগালের বৃহত্তম উপনিবেশ ব্রাজিল স্বাধীনতা ঘোষণা করলে দেশটির অর্থনীতি অত্যন্ত দুর্দশায় পতিত হয়। বিশ্ব রাজনীতিতে পর্তুগালের প্রভাব ক্ষুন্ন হয় এবং ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে এক অভ্যুথানের মাধ্যমে রাজতন্ত্রকে উচ্ছেদ করে প্রজাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু সে শাসন ব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে নাই। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে আবার এক অভ্যুথানের মাধ্যমে এক দীর্ঘস্থায়ী একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে সামরিক বাহিনীর বিদ্রোহের ফলে একনায়কতন্ত্রে অবসান ঘটে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে দেশটির আফিকান উপনিবেশগুলো স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে পর্তুগাল ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য। দীর্ঘদিনের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ দেশটি বর্তমানে ইউরোপের একটি উন্নত দেশ!

পর্তুগীজ জলদস্যুদের দেশ পর্তুগালে আসা গেল। সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে পর্তুগালের রাজধানী লিসবন ৩ ঘণ্টার ফ্লাইট। জেনেভা এবং লিসবন দুই এয়ারপোর্ট থেকেই মূল শহরের দূরত্ব খুবই কম। এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের নিতে এসেছিল পর্তুগালে বাংলাদেশ দূতাবাসের কূটনীতিক রাজী এবং আমাদের থাকার ব্যবস্থাও হয়েছিল রাজী আর হৃদির বাসায়। রাজীর গাড়ি আমাদের নিয়ে ছুটে চলল রাতের আলো ঝলমলে লিসবনের রাস্তায়! ওদের বাসাটিও খুবই মনোরম একটি জায়গায়! বারান্দায় দাঁড়ালে আটলান্টিক মহাসাগরের উত্তাল ঢেউয়ের শোভা মন ভুলিয়ে দেয়!

আরও পড়ুন গল্প  দীপ্তিদের দেবতা
লিসবনের-বাতিঘর
লিসবনের বাতিঘর

ইউরোপের অন্যতম বড় শহর লিসবন। অপরুপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর! লিসবনের শোভায় চোখ ফেরানো যায় না। আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে পুরো শহরটিই পাহাড়ি এলাকা। আবহাওয়া খুবই চমৎকার! রীতিমত নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া! ইউরোপে শীতকালে এমন চমৎকার আবহাওয়া কল্পনাতেও ছিল না! পরিষ্কার মেঘ মুক্ত নীলাকাশ! রৌদ্রজ্জল দিন! শীতের দেশের শীতকাল বলতে দেখা যায় ফুল-ফল বিহীন, সবুজ পাতাহীন শুকনো ডাল-পালা বিশিষ্ট মরা গাছ অথচ লিসবনে এমন দৃশ্য চোখেই পড়ল না! প্রতিটি গাছ ঘন সবুজ পাতায় ছাওয়া! প্রতিটি রাস্তা, বাড়ির বারান্দা হরেক রঙের ফুলে ছেয়ে আছে! চারদিক পাখির কলকাকলীতে মুখরিত! ফেব্রুয়ারি মাসে জেনেভায় যখন ওভারকোট ছাড়া ঘরের বাইরে যাওয়া চিন্তাই করা যায় না, পর্তুগালে হাল্কা শীতের কাপড়ই যথেষ্ট! জানা গেল, এখানকার সুন্দর আবহাওয়ার কারণে ইউরোপের অনেক দেশের অধিবাসীই অবসর জীবন কাটানোর জন্য এদেশে বাড়ি কিনে রাখেন। বাড়ি-ঘরগুলো পাহাড়ের ঢালে এমন সুবিন্যস্ত ভাবে ধাপে ধাপে তৈরী করা হয়েছে, দেখে মনে হয় গ্যালারির অনুকরণে বাড়িগুলো তৈরি করা হয়েছে!

পর্তুগালের আবহাওয়া আর প্রকৃতির সাথে পাল্লা দিয়ে মুগ্ধ করে এখানকার খাবার। মাছ এবং সামুদ্রিক খাবার খাওয়ার দিক থেকে পর্তুগালের অবস্থান ইউরোপে প্রথম এবং পৃথিবীর মধ্যে চতুর্থ! এদেশে সব চেয়ে বেশী খাওয়া হয় বাকালহাউ নামে কড জাতীয় সামুদ্রিক মাছ। জানা গেল, গ্রীল থেকে শুরু করে মোট ৩৬৫টি পদ্ধতিতে এই মাছ রান্না করা হয়। আটলান্টিক থেকে সদ্য সংগ্রহ করা বাকালহাউ মাছের গ্রীল আটলান্টিকের তীরের কোন হোটেল বসে রৌদ্র করোজ্জল দিনে আটলান্টিকের ঢেউ দেখতে দেখতে গলাধঃকরণ করা দারুণ উপভোগ্য! পর্তুগালের আরেকটি বিখ্যাত খাবারের নাম হল পেটিস দে নাতা! ডিমের সঙ্গে আরো কিছু উপকরনণে বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি এই মিষ্টি জাতীয় খাবারটি বিশ্বের বিখ্যাত ছয়টি খাবারের একটি! লিসবনে পৌঁছার পরে রাজী আমাদের প্রথমেই নিয়ে গেল বিশ্ব বিখ্যাত এই খাবারের স্বাদটি পরখ করাতে। আমরাও খুবই উপভোগ করলাম সদ্য প্রস্তুত কৃত মজাদার সে খাবার!

আরও পড়ুন গল্প রঙিন ঘুড়ি

এক সময়ের জলদস্যুর কলঙ্কের তিলক আঁটা পর্তুগাল কালের আবর্তনে এক সম্পূর্ণ ভিন্ন দেশ! বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশ যখন অভিবাসীদের ব্যাপারে অত্যন্ত স্পর্শকাতর, অনুদার এবং সন্দিহান, সেখানে পর্তুগাল অভিবাসী গ্রহণের ব্যাপারে অত্যন্ত উদার! তার প্রমা্ণ পেলাম আমাদের গাড়ি চালকের কথায়। গাড়ি চালব মি. নুনো অত্যন্ত সদালাপী, উচ্চ শিক্ষিত, প্রকৃতি প্রেমী, সজ্জন একজন মানুষ! আমাদের নিয়ে লিসবনের বিভিন্ন বিখ্যাত স্থান দেখানোর ফাঁকে সুযোগ পেলেই গল্পের ঝাঁপি খুলে বসা ছিল নুনোর সহজাত অভ্যাস! সে তার জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের আচরণ সম্মন্ধে তার ধারণা ইত্যাদি নিয়ে আলাপ জমাতে লাগলো। প্রকৃতির প্রতি তাঁর নিখাদ ভালোবাসা!

টাইম স্কয়ার
টাইম স্কয়ার

সময় পেলেই মি. নুনো আটলান্টিকের তীরে বসে থাকেন! স্বার্থপর মানুষের দ্বায়িত্ব জ্ঞানহীন কর্মকাণ্ডের ফলে প্রকৃতি ধ্বংস হওয়া নিয়ে তাঁর উদ্বেগের কথা বললেন। নুনো জানালেন, উনি প্রায় দশ বছর লন্ডনে ছিলেন। কিন্তু সেখানকার আবহাওয়া, মানুষের অবন্ধু সুলভ আচণ ভাল লাগেনি বলে নিজের দেশ পর্তুগালে ফিরে গেছেন। নুনো ক্ষোভের সঙ্গে জা্নালেন, প্রায় প্রতি বছরই পর্তুগালে দাবানলে বহু বনাঞ্চল ধ্বংস হয়। এসব দাবানলের কারণ মানুষের সীমাহীন লোভ। বনভূমি ধ্বংস করে ব্যক্তিগত স্বার্থোদ্ধার এসব দাবানলের উদ্দেশ্য! এ প্রসঙ্গে আরও জানা গেল ২০২১ খ্রিস্টাব্দে এমন ভয়ানক দাবানলে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়। এমন কি গাড়িতে থাকা অনেক মানুষ গাড়ি থেকে বের হতে না পেরে জীবন্ত অঙ্কারে পরিণত হয়!

আরও পড়ুন ঘুরে এলাম পর্তুগাল-
শেষ  পর্ব

 

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

ঘুরে এলাম পর্তুগাল (১ম পর্ব)

Facebook Comments Box

তাহমিনা খাতুন একজন বহুমুখী প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব। তিনি ছড়া, কবিতা, গল্প, ভ্রমণকাহিনি এবং নারীর অধিকার নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত কলাম লিখে থাকেন। পেশায় তিনি একজন আইনজীবী। তার পেশাগত জীবনে তিনি নারীদের আইনি সহায়তা প্রদান এবং তাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করতেন। তাহমিনা খাতুন ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ১লা মার্চ পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত আহম্মদপুর ইউনিয়নের দ্বারিয়াপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব ও কৈশোর কাটে এই গ্রামেই।

error: Content is protected !!