গোলাপি শহর জয়পুরে
গোলাপি শহর জয়পুরে
জয়পুর। ভারতের রাজস্থান রাজ্যের রাজধানী। ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে সড়ক পথে ৪/৫ ঘন্টার দূরত্বে জয়পুর। জয়পুর এক ঐতিহাসিক শহর। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে দিল্লি থেকে সড়ক পথে ঐতিহাসিক এই শহর দেখতে গেলাম।
ঐতিহাসিক এই শহরের ভবনগুলো অধিকাংশই গোলাপি রঙের! ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে বৃটিশ সম্রাজ্ঞী ভিক্টরিয়ার স্বামী প্রিন্স আলবার্টের জয়পুর ভ্রমণকালীনে জয়পুরের মহারাজা রাম সিংহ কর্তৃক শহরের ভবনগুলো গোলাপি রঙ করা হয়। কারণ গোলাপি রঙ আতিথেয়তার প্রতীক। অধিকাংশ ভবনের রঙ গোলাপি হওয়ায় এই শহরের নাম হয়েছে পিংক সিটি বা গোলাপি নগরী। জয়পুরকে রাজধানী হিসেবে তৈরি করার আগে আম্বর ফোর্ট বা আম্বর দূর্গ থেকেই রাজ কার্য পরিচালিত হতো। পরবর্তীতে সম্রাট আকবরের বিশ্বস্ত সেনাপতি মানসিংহের বংশধর সাওয়াই জয়সিংহ ১৭২৭ খ্রিষ্টাব্দে জয়পুর শহর নির্মাণ করে, আম্বর দূর্গ থেকে জয়পুরে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন।
জয়পুরের ১১ কিলোমিটার দূরে আরাবল্লি পাহাড়ের ‘চিলকা টিলা’ বা ঈগলের টিলার অংশের উপর আম্বর ফোর্ট বা দূর্গ নির্মাণ করা হয়েছিল। ৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে চন্দ্র বংশের রাজা এলান সিংহ চান্দা এই দূর্গের নির্মাণ কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু কালের পরিক্রমায় দূর্গটি ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তীতে বিভিন্ন রাজার হাত হয়ে ১৬০৪ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আকবরের দুর্ধর্ষ সেনাপতি রাজা মানসিংহের হাতে ‘আম্বর ফোর্ট’ আকর্ষণীয় এক ঐতিহাসিক স্থাপত্যের রুপ লাভ করে। তবে দূর্গটিকে পরিপূর্ণ রূপ দেন সাওয়াই জয় সিংহ। আম্বর দূর্গ থেকে জয়পুরে রাজধানী স্থানান্তরের পর, দূর্গটির অসমাপ্ত কাজগুলো সাওয়াই জয় সিংহ সমাপ্ত করেন।
আরও পড়ুন ভ্রমণকাহিনি শানশি লাইব্রেরি ও মোরগ ডাক
এই দূর্গের আয়তন ১.৫ বর্গমাইল। লাল বেলে পাথর ও মার্বেল পাথরে তৈরি এই দূর্গটিতে অনেকগুলো অংশ রয়েছে। এটি চার স্তর বিশিষ্ট। প্রতিটি স্তরের সাথেই রয়েছে একটি বড় উঠান বা চত্বর এবং দেওয়ান-ই-আম বা দরবার মহল, দেওয়ান-ই-খাস বা অন্দরমহল, শীষ মহল বা আয়না মহল এবং সুখ-নিওয়াজ বা সুখ নিবাস।
দিওয়ান-ই-খাস হলো অন্দরমহল যেখানে রাজ পরিবারের নারী সদস্যগণ বাস করতেন। রাজার দরবার ছিল দেওয়ান-ই-আম, যেখান থেকে রাজা রাজ কার্য পরিচালনা করতেন। হাজারের বেশি রঙিন কাঁচের তৈরি ছিল শীষ মহল বা আয়না মহল! দূর্গের দেয়ালের সর্বত্র সুক্ষ কারুকাজ অবাক করার মতো। মূল ফটকটিও রাজকীয় কারুকাজ সমৃদ্ধ।
জয়পুর প্রাসাদের সুখ নিওয়াজ বা সুখ নিবাস আর একটি দর্শনীয় স্থান। গ্রীষ্মকালে ঘর শীতল রাখার ব্যবস্থা ছিল সুখ নিওয়াজে। এই ঘরের উপরে জলাধারের মতো ঘেরা জায়গা ছিল এবং এখানে ঝর্ণার ব্যবস্থা ছিল। কুলুঙ্গি বা ছোটো ছোটো খোপের মধ্য দিয়ে পানি সরবরাহের মাধ্যমে ঘর ঠান্ডা রাখার ব্যবস্থা ছিল যা রীতিমতো বিস্ময়কর!
জয়পুরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণ আম্বর ফোর্ট বা আম্বর দূর্গ। জয়পুরের ‘মাওথা’ লেকের পাশ ঘেঁষে অনিন্দ সুন্দর এই দুর্গ নির্মিত হয়েছে। অনেক দূর থেকেই অনিন্দ্য সুন্দর তা চোখে পড়ে।
আরও পড়ুন ভ্রমণকাহিনি তাজমহলের শহর আগ্রায়
আম্বর দূর্গ মূলত ছিল রাজপুত, রাজাদের বাসস্থান। রাজা মানসিংহ মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। সম্রাট আকবরের দুর্ধর্ষ সেনাপতি ছিলেন তিনি। মানসিংহ ছিলেন সম্রাট আকবরের ‘নও রত্ন’ সভার একজন সদস্য। সম্রাট আকবর তাঁকে এতই পছন্দ করতেন যে মানসিংহকে ‘ফরযন্দ’ বা পুত্র খেতাবে ভূষিত করেন। মানসিংহ বাংলার বার ভুঁইয়া রাজাদের অন্যতম যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যকে পরাজিত করার পর সম্রাট আকবর তাঁকে ৫০০ ‘মনসবদার’ প্রদান করেন। সম্রাট আকবর পারস্যের অনুকরণে তাঁর সাম্রাজ্যে ‘মনসবদার’ প্রথা চালু করেন। ‘মনসবদার’ শব্দের অর্থ পদমর্যাদা।
‘মনসবদারী’ প্রথা এমন একটি ব্যবস্থা যা মোগল সাম্রাজ্যের সামরিক এবং বেসামরিক কর্মীদের বিভিন্ন স্তরের সামাজিক মর্যাদায় ভূষিত করত। একজন মনসবদার দশ থেকে দশ হাজার পর্যন্ত সৈন্য নিজের আয়ত্বে রাখতে পারতেন। সম্রাট আকবরের রাজত্বের শেষ দিকে এটা বারো হাজার পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। মনসবদারগণ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থেকে সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেন। মনসবদারী প্রথার কারণে মোগল সাম্রাজ্যের এত বিস্তৃতি ঘটেছিল।
যাহোক আম্বর দূর্গের অভ্যন্তরেই রাজা মানসিংহ বসবাস করতেন। মানসিংহের ছিল বারোজন স্ত্রী। বারোজন স্ত্রীর জন্য জেনানা মহলে প্রতিটি ঘর ছিল একই মাপের, এক ডিজাইনের, একই ধরনের কারুকাজ সংবলিত। এর কারণ ছিল রাজা কখন কোন রানির ঘরে অবস্থান করছেন-এটা যাতে কেউ বুঝতে না পারে।
দূর্গের অভ্যন্তরে রয়েছে অনেকগুলো মন্দির এবং সুন্দর সব বাগান। জয়পুরে অনেকগুলো আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে জয়পুরের মূল আকর্ষণ হচ্ছে ‘আম্বর দূর্গ! প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক আসেন এই অনিন্দ্য সুন্দর স্থাপত্যশৈলী দেখার জন্য।
আরও পড়ুন ভ্রমণকাহিনি টেরাকোটা আর্মি
জয়পুরের আর একটি বিস্ময়কর দর্শনীয় স্থান হল যন্তরমন্তর। ১৭২৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৭৩৪ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে মহারাজা দ্বিতীয় জয় সিংহ এটা নির্মাণ করেন। এটি একটি মানমন্দির। এখানে বিশটি স্থায়ী যন্ত্র স্থাপন করে জ্যোতির্মন্ডলের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা এবং তথ্যসংগ্রহ করার ব্যবস্থা ছিল রীতিমত বিস্ময়কর। আম্বর দূর্গ, যন্তরমন্তর সহ জয়পুরের পাঁচটি বিস্ময়কর স্থাপনা ইউনিসেফের বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষিত।
গোলাপি শহর জয়পুর দেখে ফেরার পথে আরও একটি অনিন্দ্য সুন্দর স্থান দেখে আসার সুযোগ পাওয়া গেল। সেটা হলো রামবাগ প্রাসাদ। ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে রাজা তৃতীয় রাম সিংহ ৪৭ একর জমির ওপর এই প্রাসাদ নির্মাণ করেন। জয়পুর শহর থেকে পাঁচ মাইল দূরত্বে এটা নির্মাণ করা হয়। মূলত এটা একটি বাগান। রাজা শিকার করার উদ্দেশ্যে বের হলে এই প্রাসাদেই অবস্থান করতেন। প্যালেসের ভিতরে এবং বাইরে রয়েছে সুন্দর সুন্দর লেক, অসংখ্য গাছপালায় ঘেরা বুনো প্রকৃতি, ময়ুর ঘুরে বেড়াচ্ছে যত্রতত্র। বর্তমানে এই প্রাসাদকে একটি পাঁচ তারকা হোটেলে রুপান্তরিত করা হলেও প্রাসাদের মূল আকর্ষণগুলো অবিকৃত রাখা হয়েছে। এটি শুধু ভারত বর্ষের নয়, গোটা বিশ্বের মধ্যে অন্যতম একটি আকর্ষণীয় হোটেল।
আরও পড়ুন ভ্রমণকাহিনি রোমান সামাজ্যে কয়েকদিন
ভারতের রাজস্থান রাজ্যটি নারী বিদ্বেষের কারণে বিতর্কিত। রাজস্থানে কোনো কন্যা শিশুর জন্ম নেওয়ার অধিকার ছিল না। ভ্রুণ অবস্থায়ই কন্যা শিশুকে হত্যা করা হয়। ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে এই রাজস্থানেই রূপ কনোয়ার নামের এক অষ্টাদশী তরুণীকে জীবন্ত অবস্থায় সহমরণে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। জানা যায়, প্রায় একশত বছরের মধ্যে রাজস্থানে জীবিত থাকা একমাত্র কন্যা শিশুটি যখন পরিণত বয়সে একটি কন্যা শিশুর জন্ম দেয়, সেই কন্যা শিশুটিকেও হত্যা করা হয়েছিল!
জয়পুরের শপিংমলগুলোতে বৈচিত্র্যময় এবং জাঁকজমকপূর্ণ রাজকীয় কারুকাজ খচিত পোশাক, গহনা, বিছানার চাদর, হস্তশিল্প, স্যুভেনির ইত্যাদি কিনতে পাওয়া যায়। কিছু স্যুভেনির ও অন্যান্য জিনিসপত্র কিনলাম। সারাদিন ধরে গোলাপি শহরে ঘুরে বেরিয়ে ঐতিহাসিক সব স্থাপনা দেখা শেষ করে , সন্ধ্যায় আবার ফিরে গেলাম দিল্লিতে।
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে
গোলাপি শহর জয়পুরে