কালো কঙ্কাল (২য় পর্ব)
কালো কঙ্কাল (২য় পর্ব)
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগেই বাড়ি ফেরে তালেব। জোবেদা খাতুন লতুর মাথায় তেল দিচ্ছিলেন। লতুর মাথায় চিরুনি চালাতে চালাতে তালেব মিয়াকে উদ্দেশ করে জোবেদা বললেন,
“খাবারের গামলা ও থালাবাসনগুলো ঘরের দাওয়ায় রাইখে আপনি হাতমুখ ধুয়ে নিন। লতুর চুল আছড়ানি শ্যাষ হলি আমি আপনাক গুড়-মুড়ি দিচ্ছি।”
মেয়ের পাশে বসলেই এক অজানা কারণে জোবেদা খাতুনের মনটা প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। যদিও লতুর গায়ের রংটা খোসা ছাড়ানো তেঁতুলের মতো কিন্তু মেয়ে তার দেখতে বেশ আকর্ষণীয়া। দীর্ঘাঙ্গী। সব সময় পরিচ্ছন্ন পরিপাটি চলাফেরা। লতুর শরীর থেকে সবসময় জবাকুসুম তেল আর শিউলিফুলের সুবাস মেশানো সুন্দর একটা গন্ধ পাওয়া যায়। জোবেদার ইচ্ছা করে লতুর চুলের মধ্যে নাক ডুবিয়ে বসে থাকতে। তাছাড়া লতুর সুপ্ত বৌদ্ধিক প্রতিভাও গ্রামের আর পাঁচটা মেয়ে থেকে ঢের আলাদা।
বাড়িতে ঢোকার মুখেই বড় এক পুঁইমাচার বাগান। পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে পুঁইপাতার পুরুষ্টু ফল। পুঁইমাচা পেরুলেই কলপাড়। সবুজ ছ্যাদলা পড়া কলপাড়ে হাতমুখ ধুতে ধুতে তালেব লক্ষ করল উঠানের এক পাশে স্বকল্পিত হাপর বানিয়ে দা, কাঁচি, বঁটি ইত্যাদি তৈরির কামার কামার খেলায় মশগুল হয়ে আছে তার দুই আত্মজ রঞ্জু আর মঞ্জু। রঞ্জুর বয়স ছয় বছর আর মঞ্জুর চার।
তালেব মিয়া খেঁকিয়ে উঠলেন,
“আমি সকাল-সন্ধ্যা গতরপাত করে তোদের লেহাপড়া শেখাচ্ছি কি কামার হওয়ার জন্যি? দাঁড়া আইজ তোদের কামার খেলা ছুটাচ্ছি।”
এই বলে তালেব মিয়া ওদের দিকে তেড়ে যেতেই দুজন দৌড়ে পালায় বাড়ির পেছনে ঝোপঝাড়ের দিকে।
আরও পড়ুন গল্প পেতনি
জোবেদা খাতুন তালেব মিয়াকে উদ্দেশ করে বলল,
“ওরা ছোট মানুষ। ওদের কি কোনো বোধবুদ্ধি আছে? বড় হলি ঠিক হয়া যাবি। দাওয়ায় আইসে আপনি একটু বসেন তো, জরুরি কথা আছে।”
একটি জলচৌকি তুলে নিয়ে দাওয়া এসে জুত করে বসে তালেব মিয়া৷ তারপর বউয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এইবার কয়া ফেলো ঘটনা কী?”
জোবেদা খাতুন বলল,
“পশ্চিমপাড়ার ঘটক বারেক মোল্লা একটা সম্বন্ধ আনছে আমাদের লতুর জন্যি। ছেলের নাম আকেল উদ্দিন। শুনলেম ছেলের অবস্থা নাকি খুব ভালো। বাপ-দাদার অনেক জমিজিরাত আছে। বাবা-মায়ের একই ছাওয়াল। তবে বাবা মারা গেছে মেলা আগে। এখন সংসারে শুধু মা আর একখান বুন। বুনখান ইসকুলে পড়ে। বাড়ি চম্পাহাটি। ছেলে নাকি মাস্টারি করে চম্পাহাটি কলেজে।”
বিস্ময়াবিভূত কণ্ঠে তালেব বলল,
“কও কি লতুর মা! এত ভালো ঘরের ছাওয়াল কামারের মিয়াক বিয়ে করবির চায় ক্যান? পাত্র কি দোজবর? বউ-টউ আছে নাকি আরো দু-একখান?”
জোবেদা বেগম অস্ফুট কণ্ঠে বলল,
“বউ-টউ নাই তবে ছাওয়ালের একখান সমেস্যা আছে। পাত্রের বাম হাত নাকি অকেজো।”
তালেব চোখ দুটি কপালে তুলে বলল,
“আমার মেয়ের জন্যি বারেক মোল্লা নুলা পাত্র ধইরে আনছে?”
আরও পড়ুন গল্প সোনালি সকাল
জোবেদা বলল,
“ঘটক তো আমাক জানায় নাই যে ছাওয়াল নুলা।”
তালেব মিয়া ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“তালি তুমি জানলে কী কইরে পাত্রের যে এই অবস্থা?”জোবেদা বলল,
“ঘটক যখন কাইল আমাক কলো, বিয়ে যদি দিবের চান তবে দু-দিনের মধ্যেই দেওয়া লাগবি। না হয় তো ছাওয়াল অন্য জায়গায় বিয়ে কইরে ফেলবি। আমি আর কী করব, পাশের বাড়ির মন্তাজকে পাঠালাম চম্পাহাটি। ছাওয়ালের বউ-টউ আছে কিনা সে খবর নেওয়ার জন্যি। কিন্তু মন্তাজ যে কথা বলল তাতে তো আমার মাথায় আকাশ ভাইঙে পড়ল।”
জোবেদা খাতুন ঈষৎ আবেগ মেশানো কণ্ঠে তালেবকে বলল,
“মাথা গরম কইরেন না। আমারে পরিবারের দিকে ভালো কইরে চায়া দেহেন। আমারে মতো মানষির জন্যি এই ছাওয়াল তো আকাশের চাঁদ। না হয় ছাওয়ালের একটা হাত পঙ্গু। পাত্রের জমিজিরাত আছে মেলা। ছাওয়াল শিক্ষিত মাস্টারি করে কলেজে। এর চেয়ে ভালো পাত্র আপনি কনে পাবেন?”
লতিফা মাথা নীচু করে বাবা-মায়ের কথোপকথন শুনছিল একমনে। ভীষণ রাগ হচ্ছিল তার। একটি বারের জন্যও কেউ জানতে চাইছে না, এই বিয়েতে তার মতামত আছে কিনা আদৌ। কালো মার্বেলের মতো তার চোখ দুটোতে সস্নেহ অনুযোগ। বিয়েশাদির বিষয়টাতে বরাবরই তার ভয়। কেমন ছেলের সঙ্গে বিয়ে হবে, কেমন আচরণ করবে, বনিবনা হবে কিনা এছাড়া কত কিছু যে মাথায় আসে। এসব কথা ভাবতে ভাবতে স্নায়ুবিক অস্বস্তির শীতল একটি স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে নীচের দিকে নেমে যায় তিরতির করে। জল গড়িয়ে পড়ে চোখ দিয়ে। ঈষৎ খয়েরি রঙের ঠোঁট দুটো কাঁপে থরথর করে।
আরও পড়ুন গল্প স্বপ্ন গোধূলি
জোবেদা খাতুন ও তালের মিয়া কথা বলতে বলতে কখন যে গাঢ় অন্ধকারের চাদরে মুড়ে দিয়েছে এই বিশ্বচরাচর, কেউই খেয়াল করেনি। আকাশভর্তি তারা যেন সেই গভীর অন্ধকারের মধ্যে রংমশালের আলোর মতো ধকধক করে জ্বলছে।
লতিফার প্রতি তালেব মিয়ার স্নেহ-ভালোবাসার পরিমাণ একটু বেশিই বলা যায়। এর কারণ বোধ করি মেয়েটা দেখতে অনেকটা তার মতো। বিশেষ করে লতুর মুখের ডৌলটি হুবহু তার মতো দেখতে। সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না তার প্রাণপ্রিয় এই আত্মজার বিয়ে হবে একজন পঙ্গু মানুষের সঙ্গে। তালেব মিয়া গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমি আর কী কব লতুর মা? তোমরা যা ভালো মনে করো।”
আরও পড়ুন মাধবী নিশীথিনী-
১ম পর্ব
শেষ পর্ব
ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
কালো কঙ্কাল (২য় পর্ব)