কালো-কঙ্কাল-১ম-পর্ব
গল্প,  জমিদার,  সাইফুর রহমান,  সাহিত্য

কালো কঙ্কাল (১ম পর্ব)

কালো কঙ্কাল (১ম পর্ব)

সাইফুর রহমান

 

তালেব মিয়াকে দেখলে যে কোনো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষেরই চমকে ওঠার কথা। এত মানুষ নয়, যেন জীবন্ত এক কঙ্কাল। পার্থক্য বোধকরি এতটুকুই, যেখানে মানুষ সাদা কঙ্কাল দেখে অভ্যস্ত, সেখানে হয়তো তারা দেখে জাজ্বল্যমান কালো এক কঙ্কাল। মুখ বুজে কাজ করছে কামারশালায়। লিকলিকে, দির্ঘাঙ্গী ও কুচকুচে কালো হাত-পাগুলো এতটাই শীর্ণ যে, শরীরের হাড়গুলো যেন চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে আসার জন্য সদা উন্মুখ। হাড়চর্মসার মানুষটি যখন উবু হয়ে বসে হাপরটা টানতে থাকে, তখন খানিকটা দূর থেকে সত্যি বোঝা যায় না কোনটা হাপর আর কোনটা তার পেট। জীর্ণ ও কৃষ্ণাভ লুঙ্গিটা হাঁটু ডিঙ্গিয়ে চলে যায় একেবারে উরু পর্যন্ত। তোবড়ানো চোয়ালের মাঝখানে বকপক্ষীর চঞ্চুর মতো নাক। ভ্রূ-যুগল সূক্ষ্ম ও দূরপ্রসারিত। হাড় জিরজিরে পাঁজর। সবগুলো হাড়ই স্পষ্ট গোনা যায় নির্দ্বিধায়। মাথায় সাদা-পাকা চুলগুলো কদমফুলের মতো ছোট করে ছাঁটা। হাপর থেকে আগুনের উত্তাপের কারণেই হয়তো ঊর্ধ্বাঙ্গ সম্পূর্ণ নগ্ন।
ঘামে ভিজে তালেব মিয়া একেবারে জবুথুবু। কামারশালাটিতে তার সঙ্গে আরেকটি ছেলে কাজ করে। হাতুড়ি চালায়, লোহা পেটায়। বয়স পনেরো-ষোলো। নাম টুকানু। তালেব মিয়ার বাড়ি থেকে দু-তিন ঘর পরেই এক ঘুটে কুড়ানি থাকত এক সময়। তার কোনো পোশাকি নাম ছিল কিনা সঠিক করে জানা যায় না। তবে গ্রামে সে মাজু নামেই পরিচিতি ছিল। বছর পাঁচেক আগে মাজুর তিরোধান হয়েছে। সে নাকি রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছিল এই টুকানুকে। এ কারণে গ্রামের সবাই ওকে টুকানু বলে ডাকে। তালেব মিয়ার অবশ্য বিশ্বাস হয় না এ কথা। তার ধারণা টুকানু মাজুরই অবৈধ সন্তান। বাড়িখাল গ্রাম থেকে একসময় হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যায় মাজু। বছর তিনেক পরে ফিরে আসে দু বছরের একটি সন্তান সমেত। নিজের মানসম্মান ও লজ্জা ঢাকতেই বোধহয় মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিল মাজু। যা হোক, সে সবই তালেবের অনুমান মাত্র। নিশ্চিত করে তো আর বলা যায় না সবকিছু।

আরও পড়ুন গল্প গৃহবন্দি বিড়াল

তালেব টুকানুকে উদ্দেশ করে চেঁচিয়ে বললেন,
“বেলা হয়া যাচ্ছে মেলা, তবু লতু আসতিছে না ক্যান! খিদেয় নাড়িভুঁড়ি সব হজম হয়ে যাওয়ার জোগাড়।”
টুকানু বলল,
“আমিও তাই ভাবতিছি কাকা। দুপুরের খাবার নিয়ে লতু আপার তো এতক্ষণে চইলে আসা উচিত ছিল।”
টুকানু ডেরা থেকে বের হয়ে এদিক-ওদিক বিক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করে। নাহ লতুর চিহ্নমাত্র নেই কোথাও।

চম্পাহাটি বাজারের ওপর দিয়ে পাকা সড়কটি চলে গেছে পশ্চিমে। বাজারসংলগ্ন সেই পাকা সড়ক থেকে আরেকটি কাঁচা রাস্তা সাপের মতো একেবেঁকে চলে গেছে দক্ষিণে-বাড়িখাল গ্রামে। কাঁচা রাস্তার শুরুতেই দেখা মেলে তালেব মিয়ার কামারশালা।
আড়াইটা নাগাদ লতিফা এসে পৌঁছায় দুপুরের খাবার নিয়ে। এক হাতে লাল রঙের গামছা দিয়ে বাঁধা খাবারের বোঁচকা, অন্য হাতে দুটো বই। লতিফাকে দেখেই তবারক মিয়া কিছুটা উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন,
“তোর কি কোনো জ্ঞান কাণ্ড নেই রে লতু! এত দেরি হলি ক্যান? আমরা তো খিদেয় মরে যাচ্ছি।”
লতিফা লজ্জায় আরক্ত হয়ে বলল,
“একটু লাইব্রেরিতে গেছিলেম আব্বা। দুটো বই তুলে আনলাম।”
ভ্রূ দুটো কুঁচকে মেয়ের দিকে তাকিয়ে তালেব মিয়া বলল,
“তুই এই গল্পের বইটই পড়ার অভ্যেস যে কনথেন পালি বুঝলেম না। শরীলের রক্ত পানি করে তোক অনার্সে ভর্তি করলেম। কাজের পড়াড়া ভালো করে পড়বি, তা না শুধু গল্প-উপন্যাস পড়ায় মন। এই সব গল্পটল্প পইড়ে আমাদের মতো গরিব মানুষের কী কাম আমি বুঝবের পারিনে। রেজাল্ট খারাপ হলি আমি তোর লেহাপড়া বন্ধ কইরে দেব এই আমি কয়া রাইকলেম।”

আরও পড়ুন গল্প জোছনা মাখা আলো

লতিফা মুখে কিছু বলল না। চুপচাপ শুনল বাবার কথা। দ্রুত হাত চালিয়ে বোচকার গিঁট খুলতে খুলতে বলল,
“তোমরা তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুইয়ে নাও। আমি প্লেটে খাবার বেড়ে দিচ্ছি।”
“আজ কী পাঠায়ছে তোর মা?”
তবারক মিয়ার অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি লতিফার দিকে।
“আলু বেগুন দিয়ে মৌরালামাছ চড়চড়ি আর সজনে ডাল। ও হ্যাঁ, মিষ্টি কুমড়া ভর্তাও আছে।”
ভাত বেড়ে লতু থালা তুলে দেয় তালেব ও টুকানুর হাতে। ডালের বাটিটা নাকের কাছে এনে ঈষৎ শুঁকে তারপর কাত করে খানিকটা ডাল ঢেলে নেয় ভাতের উপর। এটা তালেব মিয়ার চিরকালের অভ্যাস। স্ত্রী জোবেদা খাতুনের উপর তার বিশ্বাস নেই। প্রায় দুপুরেই দেখা যায় বাসি ডাল পাঠিয়ে দেন জোবেদা খাতুন। বাসি খাবার আবার একদম মুখে রোচে না তালেবের। কঙ্কালসার আঙ্গুলগুলো দিয়ে দ্রুত ভাত ভেঙে খাওয়া শুরু করে তালেব।
লতু তাকিয়ে তাকিয়ে বাবার খাওয়া দেখে। সংসারের ঘানি টেনে টেনে খুব দ্রুতই বুড়িয়ে যাচ্ছে বাবা। বুকে কাশফুলের মতো সাদা লোমের ঝাঁক বাঁশের বেড়ার ফাঁক গলে একফালি রোদ এসে পড়েছে তালেব মিয়ার শরীরে। বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোঁটাগুলো চিক চিক করছে রৌদ্র-উদ্ভাসিত সেই মুখে।
লতু সেদিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ,
“আচ্ছা বাবা, তুমি অন্য কোনো কাম করলেও তো পারো। এত কঠিন কাম কি তোমার শরীরে সহ্য হয়? তোমার বয়স হয়ছে না। আমাদের পাশের বাড়ির সুবাস মণ্ডল পিয়াজ ও পাট বাঁধাই কইরে বড়লোক হয়া গেল।”

আরও পড়ুন গল্প মরিচপোড়া

লতু এসব কথা কেন বলে তালেবের সেটা বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয় না। তালেবের এত গতর খাটিয়েও সংসারে কোনো উন্নতি নেই। নিজে একা খেটে সংসারে আর কতটুকুই বা উন্নতি করা যায়। দু-চারজন কর্মচারী খাটানো গেলে তবেই না কিছু অতিরিক্ত অর্থ প্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকে। সমাজ সংসারে মানুষের নিত্যদিনের অভ্যাস ও আধুনিক প্রযুক্তির আগ্রাসনে এই শিল্পটিও হয়তো একদিন উঠে যাবে। তালেব মনে মনে ভাবে, আগে কতকিছু তৈরি হতো এই কামারশালায়-কোদাল, শাবল, কাস্তে, গাঁইতি, হাতুড়ি, লাঙ্গলের ফলা, বাটাল, দা, বঁটি, কাঁচি, ছুরি, কোচ, বর্শা থেকে শুরু করে বাসন-কোসন পর্যন্ত। এখন হাতেগোনা দু-চারটি জিনিস ছাড়া আর কিছুই তৈরি হয় না কামারশালায়। সামনে যে যুগ আসছে একদিন হয়তো এগুলোরও প্রয়োজন ফুরাবে। তালেব ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“রাখ তো তোর ওই সুবাস মণ্ডলের কথা। ব্যাটা একটা পাক্কা ধান্ধাবাজ। গ্রামের সবাই জানে সুবাস দু নম্বরি কইরে টাকা রোজগার করে।
তারপর লতিফার দিকে সস্নেহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তালেব বলল,
“মারে, ইডা আমারে পাঁচ পুরুষির পেশা। চালেই কি চট করে পেশা ছাড়া যায়। আর ওসব ব্যবসা-ট্যাবসা আমাক দ্বারা কোন দিন হয়ও নাই আর হবিও না। শোন, আমাক দেইখে যদি এই পেশার অমর্যাদা করিস তাহলি সেটা মহা অন্যায়। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে যে ঐতিহাসিক দলমাদন কামানটা আছে না, ওটা তোর পূর্বপুরুষের হাতে গড়া। সে কথা কোন দিন ভুলে যাইস নে মা। এহনো প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ সেটা দেকপির যায়। আমার দাদা ইয়াকুব মিয়া ছিল জমিদার আজিম চৌধুরীর প্রধান অস্ত্রাধ্যক্ষ। তার বানানো তলোয়ারগুলো এত নিখুঁত ও ধারালো হতো যে, সে তলোয়ার হাতে নিয়ে কেউ শূন্যে ঘোরালি বাতাস পর্যন্ত আর্তনাদ করে উঠত ব্যথায়। বুঝলি কিছু?”

আরও পড়ুন গল্প পাথরে শৈবাল খেলে

তালেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমারে পূর্বপুরুষের কেউ আর এখন এ ব্যবসায় নাই। সবাই এহন ঢাকার দিকে ছুটতিছে। গার্মেন্সে কাজ করে, মুজরি খাটে, রিকশা টানে।”
কথা মিথ্যে বলেনি তালেব। পেটের তাগিদে অনেক কর্মকারই এখন ঢুকে পড়েছে নানামুখী কাজকর্মে। কামান, তলোয়ারের কথা না হয় উহ্যই রইল। দা, বঁটি, কুড়াল বানানো বাদ দিয়ে এখন তারা ঢুকে পড়ছে পেরাক, গজাল, তারকাঁটা, নৌকার কাঠ জোড়া দেয়ার শলা, পাতাম এসব তুচ্ছ জিনিসপত্র তৈরির কাজে। কেউ কেউ টিনের পাত কেটে তৈরি করে কুপি, বালতি, কৌটা, ট্রাংক, বাক্স, গুড় জ্বাল দেওয়ার তাফাল, রুটি ভাজার তাওয়া। প্রকৃত কর্মকাররা আড়ালে-আবডালে টিপ্পনী কেটে সেসব কামারকে ডাকে ‘টিনেকামার’ বলে। কিন্তু এগুলো কামার সম্প্রদায়ের মধ্যে নিত্যদিনের ঝগড়ার বিষয় ছাড়া তো অন্য কিছু নয়, সেটা তালেব খুব ভালো করেই জানে।

আরও পড়ুন মাধবী নিশীথিনী-
২য় পর্ব
শেষ পর্ব

 

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

কালো কঙ্কাল (১ম পর্ব)

Facebook Comments Box

সাইফুর রহমান মূলত একজন গল্পকার। মানবজীবনের বৈপরীত্য ও মনস্তাত্ত্বিক বহুমুখিতা তাঁর লেখার প্রধান উপজীব্য। প্রকাশিত নিবন্ধনগ্রন্থ: জানা বিষয় অজানা কথা, যুক্তি তর্ক ও গল্প, ভিঞ্চির কালো জুতো, করোনায় শেক্সপিয়র রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য; গল্পগ্রন্থ: শরৎচন্দ্রের শরৎ উপাখ্যান ও অন্যান্য গল্প, পক্ষিরাজের ডানা, মরিচপোড়া। তিনি ১৯৭৭ সালের ১২ ডিসেম্বর, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত দুলাই ইউনিয়নের চরদুলাই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!