কালো-কঙ্কাল-শেষ-পর্ব
গল্প,  সাইফুর রহমান,  সাহিত্য

কালো কঙ্কাল (শেষ পর্ব)

কালো কঙ্কাল (শেষ পর্ব)

সাইফুর রহমান

 

পরদিন রাতেই বিয়ে হয়ে গেল লতুর। নিতান্তই অনাড়ম্বর অনুষ্ঠান। বরপক্ষের লোকজন এসেছিল জনা বিশ-পঁচিশের মতো। পাত্রপক্ষের ইচ্ছা এখন শুধু কাবিন করে রাখা। অগ্রহায়ণের শেষে নতুন ফসল ওঠার পর ধুমধাম করে মেয়েকে তুলে নেবে। বাড়িতে ব্যান্ডপার্টি ও সানাই না বাজলেও আহার-বিহারের কোনো কমতি করেনি তালেব মিয়া। পোলাও রোস্ট থেকে শুরু করে মুগডাল দিয়ে রুই মাছের মাথা। মাছ, রেজালা, দই সবকিছুরই এন্তেজাম করেছিল। বরপক্ষের লোকজনের মধ্যে কেউ কেউ খাওয়া শেষে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে দেশলাইয়ের কাঠি ভেঙে দাঁত খিলাল করতে করতে বলছিলেন,
“তালেব মিয়ার আতিথেয়তার তারিফ না করে পারা যায় না। প্রতিটি ব্যঞ্জনই সুস্বাদু। আহা! অমন সরেস দই কতকাল পরে খেলাম!”
আগে থেকেই বরপক্ষ যেহেতু জানিয়ে দিয়েছে মেয়েকে তারা তুলে নিচ্ছে না, সেহেতু বর রাত্রিযাপন করবে মেয়ের বাড়িতে। সে অনুযায়ী লতুর ঘরখানাই সাজিয়ে-গুছিয়ে বাসর উপযোগী করে তোলা হলো। রঙিন কাগজ কেটে শেকল বানিয়ে সাজানো হলো খাটের চারপাশ। বিছানায় ছড়িয়ে দেওয়া হলো কাঠগোলাপ আর গাঁদাফুলের পাপড়ি।
রাত্রি দ্বিপ্রহরের কিছু পরে বর ঢুকল বাসরঘরে। নিজেকে ভেতরে ভেতরে একটু গুছিয়ে নেয় আকেল। খুব করে চেষ্টা করে স্বচ্ছন্দ হতে। জবাফুলের মতো টুকটুকে লাল শাড়ির উপর সোনালি কারুকাজ করা একটি শাড়ি পরে এক হাত ঘোমটা টেনে বিছানার উপর বসে আছে লতু। দেউরির কাছ থেকে আকেলের মনে হলো যেন সাদা জমিনের উপর সযত্নে সাজিয়ে রাখা হয়েছে একটি লাল পুতুল। আকেল সন্তর্পণে গিয়ে বসলো বিছানায়। তারপর দু হাত দিয়ে ধীরে ধীরে লতুর ঘোমটাখানা উন্মোচন করতেই প্রেত দেখার মতো চমকে উঠল লতু। যেন রাজ্যের সমস্ত বিস্ময় নিয়ে সে তাকালো আকেলের দিকে। এ কী! এ কী করে সম্ভব! সে স্বপ্ন দেখছে নাতো?
ওদিকে অনভিজ্ঞ খাদ্যাভ্যাসের কারণেই হোক কিংবা অন্য কোনো কারণেই হোক তালেব মিয়ার পেটে দেখা দিয়েছে গোলমাল। একটু পর পরেই টাট্টিখানায় দৌড়াতে হচ্ছে বদনা হাতে।

আরও পড়ুন গল্প স্বপ্নজল

শেষ রাতের দিকে হঠাৎ তালেব মিয়া জোবেদা খাতুনকে উদ্দেশে করে বলল,
“ও লতুর মা, টর্চ লাইটখান কনে। আমার পায়খানায় যাওয়া লাগবি।”
জোবেদা ঈষৎ তন্দ্রতুর কণ্ঠে বলল,
“ভালো করে চোখ খুইলে দেহেন। টেবিলের উপরই আছে।”
তিন সেলের টর্চখানা বগলে করে ঘটি হাতে তালেব ছোটে ঘরের পেছনে শৌচালয়ের দিকে। ঘরের পেছন দিকটা উচ্ছৃঙ্খল কোঁকড়ানো চুলের মতো ঝোপঝাড়ে আকীর্ণ। এসব ঝোপঝাড়ের মধ্যেই বিষাক্ত সাপ সাধারণত ঘাপটি মেরে থাকে কামড়ানোর জন্য। তালের পা চালায় সন্তর্পণে।
লতুকে উদ্দেশ করে আকেল বলল,
“কেমন আছো লতিফা। আমাকে দেখে নিশ্চয়ই আশ্চর্যান্বিত হচ্ছ, তাই না?”
লতু অবাক বিস্ময়ে বলল,
“না, মানে… আমি… আমরা তো জানি আপনার একটি হাত পঙ্গু। কিন্তু এখন তো দেখছি আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ-সবল একজন মানুষ।”
আকেল হো হো করে হেসে উঠল। হাসলে আকেলের মুখ ঝলমল করে ওঠে।
“শোনো, আসল ঘটনা তাহলে খুলে বলি। আমি একদিন কী যেন একটা কাজে তোমাদের ওদিকটায় গিয়েছি। ধরো কত হবে, এই মাস দুয়েক আগের কথা বলছি। তোমায় দেখলাম শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবি’ বইটি এক হাতে বুকে চেপে অন্য হাতে খাবারের বোঁচকা নিয়ে কামারশালায় ঢুকছো। আমি তো হতবাক। গ্রামের একটি মেয়ে বুকে শরৎচন্দ্রের বই চেপে ঘুরছে। আমার বেশ আনন্দ হলো। এরকম বেশ কয়েক দিন দেখলাম প্রতিবারই কোনো না কোনো বই তোমার হাতে। সে হোক রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ কিংবা মানিক বাবুর ‘চতুষ্কোণ’। চম্পাহাটি কলেজে আমি বাংলাসাহিত্য পড়াই। এ পর্যন্ত দু-চারজন ছাত্র-ছাত্রীই পেয়েছি যাদের দেখেছি গল্প কিংবা উপন্যাসের প্রতি অনুরাগ। তোমাকেই প্রথম পেলাম একজন সত্যিকারের বইপ্রেমী হিসেবে। আর মেয়ে হিসেবে যে তুমি বেশ আকর্ষণীয়া এ কথা তো নির্দ্বিধায় বলা যায়। মনে মনে স্থির করে ফেললাম বিয়ে যদি করতে হয় তাহলে তোমাকেই করব।

আরও পড়ুন গল্প পথভোলা এক পথিক

এদিকে মা হন্যে হয়ে আমার জন্য পাত্রী দেখছিলেন। তার নজর সবসময় বড় ঘরের দিকে। খুঁজতে খুঁজতে একসময় পেয়েও গেলেন একটি উপযুক্ত পাত্রী। কিন্তু আমার তাকে মনে ধরল না। আমার মন তো পড়ে আছে তোমার কাছে। বিশ্বাস করো রোজ আধঘণ্টা সাইকেল চালিয়ে দুপুরের দিকে তোমাদের ওদিকটায় যেতাম শুধু তোমাকে একবার দেখব বলে। দূর থেকে দেখেই আবার চলে যেতাম কলেজে। আমার মতামত উপেক্ষা করে মা বিয়ে ঠিক করে ফেললেন সেই ধনীর দুলালীর সঙ্গে। মনে মনে ভাবতে লাগলাম কী করে ভাঙা যায় এই বিয়ে। আমার দু-একজন বন্ধু ও স্বজনকে দিয়ে পাত্রীর গ্রামে রটিয়ে দিলাম যে আমার একটি হাত পঙ্গু। আমার শারীরিক ত্রুটির কথা শুনে মেয়েপক্ষ অনিবার্য কারণেই পিছিয়ে গেল।

আমি তখন মাকে বললাম- ‘দেখো মা, আমার রোখ চেপে গেছে। ওরা যখন এ বিয়ে ভেঙে দিয়েছে তখন আমি দু-একদিনের মধ্যেই বিয়ে করে ওদের দেখিয়ে দেব পাত্র হিসেবে আমি ফেলনা নই। তারপর আমিই কায়দা করে ঘটক পাঠালাম তোমাদের বাড়িতে। জানতাম তোমার বাবা কর্মকার। তোমাদের আর্থিক অবস্থাও তেমন ভালো নয়। কিন্তু আমার তো ওসব প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন আমার মনের মতো একজন স্ত্রী। আমি নিজেও একটু আধটু লেখালেখি করি। সবসময় ভেবেছি আমার বৌ যে হবে, সে আমাকে বুঝবে। বিশেষ করে আমার লেখালেখিতে প্রেরণা জোগাবে। সব মিলিয়ে তোমাকেই আমার যথার্থ জীবনসঙ্গী মনে হয়েছে।”

আরও পড়ুন গল্প নীলভোর

আকেলের মুখে সব শুনে লতিফা একেবারে নির্বাক। কে জানত এত সুখ লেখা ছিল তার কপালে! এ তো কল্পনারও অতীত! তারপর দুজনের নানা আলাপচারিতা ও খুনসুটিতে রাত প্রায় শেষের দিকে। তখনও চারদিকে তমসার পরিব্যাপ্তি। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো নিঃসঙ্গ রাত্রির অন্ধকার ফিকে হয়ে আসবে। ফুটে উঠবে ভোরের টাটকা সতেজ আলো। লতিফা আকেলকে উদ্দেশ করে বলল,
“এখন মনে হয় আমাদের শুয়ে পড়া উচিত। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভোরের আলো ফুটে উঠবে।”

ঘরের পেছন দিককার জানালাগুলো খোলা। সেগুলো বন্ধ করতে গিয়ে লতু স্পষ্ট দেখতে পেল আবছা অন্ধকারের মধ্যেই মিশে আছে আরেকটি অন্ধকার। ওর কাছে মনে হলো জানালার ওপাশে বিশেষ কিছু একটা শুনবার জন্য উৎকীর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কালো এক কঙ্কাল। লতু স্পষ্ট দেখতে পেল আবছায়া সেই অন্ধকারে সাদা দাঁতগুলো শুধু দ্যুতি ছড়াচ্ছে। আর দ্যুতি ছড়াচ্ছে তার কালো মুখের উজ্জ্বল হাসি।

আরও পড়ুন মাধবী নিশীথিনী-
১ম পর্ব
২য় পর্ব

 

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

কালো কঙ্কাল (শেষ পর্ব)

Facebook Comments Box

সাইফুর রহমান মূলত একজন গল্পকার। মানবজীবনের বৈপরীত্য ও মনস্তাত্ত্বিক বহুমুখিতা তাঁর লেখার প্রধান উপজীব্য। প্রকাশিত নিবন্ধনগ্রন্থ: জানা বিষয় অজানা কথা, যুক্তি তর্ক ও গল্প, ভিঞ্চির কালো জুতো, করোনায় শেক্সপিয়র রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য; গল্পগ্রন্থ: শরৎচন্দ্রের শরৎ উপাখ্যান ও অন্যান্য গল্প, পক্ষিরাজের ডানা, মরিচপোড়া। তিনি ১৯৭৭ সালের ১২ ডিসেম্বর, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত দুলাই ইউনিয়নের চরদুলাই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!