কপিশ-নয়ন-৩য়-পর্ব
আবু জাফর খান (গল্প),  গল্প,  সাহিত্য

কপিশ নয়ন (৩য় পর্ব)

কপিশ নয়ন (৩য় পর্ব)

আবু জাফর খান

 

পাঁচ.

রুদ্র শাওনের মন ভীষণই খারাপ। সে দিনের পর দিন উপোস করে কাটিয়েছে, তবুও এত মন খারাপ হয়নি। বছর ঘুরে এল মজু মামার খোঁজ নেই। সে চরকির মতো ঘুরে ঘুরে তাঁকে খুঁজেছে। পায়নি। শাওনের মেজাজ সপ্তমে চড়তে থাকে। সে রোষে ফুঁসতে ফুঁসতে হাটে। ক্রুদ্ধ শাওনের সমস্ত কোপ আব্দুর রহিত ব্যাপারীর ওপর। সে আর একবারই স্বার্থপর লোকটির মুখোমুখি হবে। থলির বিড়াল বের করে জনসমক্ষে লোকটিকে উদোম করে দেবে। ব্যাটা লেবাসধারী কঞ্জুস। শাওনকে চেনো না তুমি।

মজহাব চৌধুরীকে বাড়িতে দেখেই আব্দুর রহিত ব্যাপারীর রক্ত ফুঁসে ওঠে। এই শালা আবার কোত্থেকে উদয় হলো! নিশ্চয়ই মাগি (স্ত্রী) লোকলশকর লাগিয়ে ভাইকে নিজের কাছে এনেছে। সবুর কর, ভাইকে আনা তোর পোঁদের মধ্যে ঢোকাব। শালার হাড়হাবাতে গোষ্ঠী! ছোটলোকের ঘরের মেয়ে বিয়ে করে সংসারটাই উচ্ছন্নে গেল। তোর ভাইয়ের গুহ্যদেশে বাঁশ ঢুকিয়ে যদি নিংড়ে নিংড়ে অন্ন বের না করি তো আমার নাম রহিত ব্যাপারীই নয়। ছিয়াত্তর বছর বয়সী রহিত ব্যাপারী লেখার অযোগ্য গাদা গাদা কুৎসিত শব্দ উদ্গিরণ করে স্ত্রীকে গালাগাল করেই ক্ষান্ত হয় না, রীতিমতো আশ্বিনে নির্দিষ্ট মাদি চতুষ্পদ পথজন্তুর মতো গজরাতে থাকে।

আরও পড়ুন গল্প পক্ষিরাজের ডানা

অতিশয় শিষ্টাচারনিষ্ট সভ্য সমাজের শান্ত মানুষ মজহাব চৌধুরীর ওপর চলতে থাকে মানসিক উৎপীড়ন আর তাঁর বোনের ওপর ক্রমাগত খিস্তি-খেউর এবং দৈহিক নিপীড়ন। রহিত ব্যাপারীর ক্রমবর্ধমান কদর্য আচরণে অতিষ্ঠ অতি সুচরিত নিরীহ মজহাব চৌধুরী তেতো বিরক্ত হয়ে বোনের স্বামীর নিতম্বদেশে কষে কয়েক ঘা বসিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। সেই থেকে তিনি নিখোঁজ।

রুদ্র শাওন বুকের ভেতর এক ধরনের ব্যথা অনুভব করে। মমতার ব্যথা। আহারে মজু মামা! তাঁর মতো অসম্ভব সুন্দর একজন মানুষের জীবনে প্রাপ্তি বলে কিছু নেই। তিনি না পাবার স্তূপে চাপা পড়া ব্যথা বিপুত এক ইতিহাস। অথচ শাওন মুহূর্তের জন্যও তাঁকে হাহুতাশ করতে দেখেনি। আশ্চর্য এক মানুষ! শাওন মানুষটির সঙ্গে যত মিশেছে, যত দেখেছে ততই মুগ্ধ হয়েছে। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় তত বিনত হয়েছে। সেই মানুষটিকে কিনা রহিত ব্যাপারী দিনের পর দিন যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত করেছে। আরে ব্যাপারী, তুমি মজহাব চৌধুরীর মর্যাদা কী বুঝবে! তুমি তো চার পেয়ে জন্তু বিশেষ। তোমাকেও দুই হাঁটু আর দুই হাতের তালুতে ভর করে ওদের মতোই তাড়া খেয়ে ছুটতে হবে। ওরা ইতর প্রাণী হলেও তবু ওরা ভালোবাসায় বশীভূত হয়। কারণ, ওদের মস্তিষ্ক তোমার মতো কদর্যে পূর্ণ নয়। তুমি ওদের চেয়েও নিম্নশ্রেণিভুক্ত প্রাণী। তোমার আশপাশে কেউ নেই। থাকবেও না কোনোদিন। শাওনের মেজাজ ধাঁ ধাঁ করে চড়ে যায়।

আরও পড়ুন গল্প প্রতীক্ষিত বৃষ্টি

রুদ্র শাওন বাঘাবাড়ি ঘাটের পাশে বড়াল নদীর ধারে চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছে। মন বিক্ষিপ্ত এবং ক্লান্ত। মজু মামাকে আজও খুঁজে পায়নি। একটি অস্পষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে সকাল থেকে চায়ের দোকানে বসে আছে। চোখ অনবরত মজু মামাকে খুঁজছে।
আরে, মজু মামা না! হ্যাঁ, মামাই তো। শাওন তড়িঘড়ি উঠে দ্রুত পা চালায়। মজু মামা বড়াল নদীর পাড় ঘেঁষা একটি ছোট্ট ঘরে ঢোকেন। শাওনও পিছু পিছু ঢোকে ।
“মজু মামা, এই ঘরে থাকেন? চলে কী করে?”
“শাওন তুই! কী করে খোঁজ পেলি?”
“এক বছর আপনাকে খুঁজছি। অবশেষে…!”
“কেন খুঁজিস? ও বাড়িতে আর যাব না রে! ব্যাপারী বড় যন্ত্রণা করে! এক পেট, চলে যায়। কয়েকটা টিউশনি করি। এখানে ভালোই আছি। গঞ্জনা শুনতে হয় না অন্তত। তিরস্কার, কটূক্তি সইতে ভালো লাগে না রে।”
“যেতে হবে না মজু মামা। আমিই আসব মাঝে মধ্যে। মায়া। মায়ায় জড়ানো টান। তাই খুঁজি।”
“মায়ার টান বড় শক্ত টান। ছেঁড়া যায় না। কষ্ট পোহাতে হয়।”
“সে আমি জানি মজু মামা। তাইতো পথে পথে খুঁজি। বোন ভাগ্নেকে দেখতে ইচ্ছে করে না?”
“খুব করে। তোকে, বোনটিকে, ছোট ভাগ্নেকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে রে! তবু যাই না। লোকটিকে ঘৃণা করি।”
“আমায় একবার যেতে হবে। ব্যাপারীর সামনে একবার দাঁড়াব। কিছু বলার আছে। শেষ কিছু কথা।”
“মুখোশটা খুলে দিয়ে আসিস।”
“হ্যাঁ, সে জন্যই যেতে হবে। ব্যাটা অনেক খেলেছে। খেলাটা সাঙ্গ হোক।”

আরও পড়ুন গল্প নীলভোর

মজু মামা শাওনের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর পর্যন্ত আসেন। সূর্য ডুবে যাচ্ছে। বড়াল ব্রিজ পার হয়ে নদীর দক্ষিণ তীর ঘেঁষা পাকা রাস্তা ধরে দুজন আনমনে হাঁটছে। মজু মামা বলেন,
“শাওন, খুব শীঘ্রই একবার আসিস। শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। বয়স হয়েছে যে। তোকে দেখলে মনটা ভালো হয়ে যায়।”
রুদ্র শাওনের খুব ইচ্ছে করে সেই ভদ্রমহিলার শেষ বাক্য দুটি মজু মামাকে বলে। আবার ভাবে, এই মানুষটি এমনিতেই ভীষণ একা। কষ্ট আরও বাড়বে। খামোখা কষ্ট বাড়িয়ে কী লাভ! শাওনের কেন যেন মনে হয়, মজু মামার সাথে কি আর দেখা হবে? তাঁর শরীর ভেঙে গেছে। মুখ বিষণ্ণ। উদাস চাউনি। সারাক্ষণ কী যেন ভাবছেন। মানুষটিকে একা ফেলে যেতে ইচ্ছে করে না। শাওনের পকেটে যেকটি টাকা ছিল মজু মামার হাতে গুঁজে দিয়ে বলে,
“অতি শীঘ্রই আবার আসব।”
মজু মামা ঝাপসা চোখে শাওনের দিকে তাকায়। তাঁর চোখভর্তি জল। দু’চোখে ভিড় করে আছে লুকনো যত কথা। তিনি কিছুই বলেন না। শুধু বলেন,
“ভালো থাকিস শাওন।”
তারপর পেছন ফিরে এলোমেলো পায়ে হাটতে থাকেন। শাওন বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে,
“হে সৃষ্টির অধিপতি, কেন এই মানুষটির প্রতি এমন নিষ্ঠুর আচরণ তোমার? তোমার এই ক্রূরতা, এমন বৈরূপ্য মানায় না।” কিছুই বলা হয় না। কেবল দু’চোখ হতে অবিরত অশ্রু ঝরে।

আরও পড়ুন কপিশ নয়ন-
১ম পর্ব
২য় পর্ব
শেষ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

কপিশ নয়ন (৩য় পর্ব)

Facebook Comments Box

কবি ও কথাশিল্পী আবু জাফর খান নিবিড় অন্তর অনুভবে প্রত্যহ ঘটে চলা নানান ঘটনা, জীবনের গতি প্রকৃতি, বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি, ব্যক্তিক দহনের সামষ্টিক যন্ত্রণা তুলে আনেন নান্দনিক উপলব্ধির নিপুণ উপস্থাপনায়। তাঁর লেখায় ধ্বনিত হয় বিবেক কথনের অকৃত্রিম প্রতিভাষা। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: পাথর সিঁড়িতে সূর্যাস্ত বাসনা, অনির্বেয় আকাঙ্ক্ষায় পুড়ি, যে আগুনে মন পোড়ে, যূপকাঠে যুবক, একটি জিজ্ঞাসাচিহ্নের ভেতর, সোনালী ধানফুল, রাতভর শিমুল ফোটে, বীজঠোঁটে রক্তদ্রোণ ফুল, স্যন্দিত বরফের কান্না, প্রত্নপাথর মায়া; গল্পগ্রন্থ: মাধবী নিশীথিনী, পথে পথে রক্ত জবা, উপন্যাস: মেখলায় ম্যাগনোলিয়ার মুখ, জ্যোৎস্নায় ফুল ফোটার শব্দ, কুমারীর অনন্তবাসনা, জ্যোৎস্নাবাসর, মেঘের বসন্তদিন, রূপোলী হাওয়ার রাত, একাত্তরের ভোর, তৃতীয় ছায়া। তিনি ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩১শে জানুয়ারি পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত আহম্মদপুর ইউনিয়নের সৈয়দপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। 

error: Content is protected !!