গল্প,  শফিক নহোর (গল্প),  সাহিত্য

কথোপকথন

কথোপকথন

শফিক নহোর 

 

আমি তখন নতুন মোবাইল ফোন কিনেছি, কারও মোবাইল নম্বর আমার কাছে নেই । কেউ আমার কাছে ফোন দেয় না, আমিও কাউকে ফোন দিতে পারি না । তার বিশেষ কারণ হল, কারও নম্বর জানি না।সেদিন হুট করে পথের মধ্যে আমার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা ।

-কেমন আছিস বন্ধু?’

– কোথায় থাকিস,কি করিস ।

বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা হল দুজনের, স্কুল-কলেজের অনেক স্মৃতি । অনেক দিন পরে দেখা কত রকম কথা মনের ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছে । সুমনের কাছ থেকে আমি যখন বিদায় নিচ্ছি; তখন বলে উঠল,

– তোর মোবাইল ফোন আছে?’

-মোবাইল নম্বরটা দে?’

মনের ভেতর এক ধরনের শক্তি আসলো যাক, বাবা অন্তত পক্ষে একজন বন্ধুর মোবাইল নম্বর তো পেলাম । ওর সঙ্গে কথা বলা যাবে, নিজের মোবাইল আছে রিংটোন বাজে না পকেট থেকে বের করে যে মানুষকে দেখাব । আহ্লাদ করে মানুষের সামনে ফোনটা বের করি, কেউ ফোনে কল করে না । কখনো-কখনো নিজেই রিংটোন বাজিয়ে কানের কাছে ধরে, মিছেমিছি কথা বলি । সুমন আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে ওর তিন চার বার ফোন এসেছে; আমি বললাম রহস্যটা কি? সুমন আমাকে খুলে বলল, একটা ডিজিট পরিবর্তন করে দিলে অন্য মানুষের কাছে কল চলে যাবে । আর সেটা হচ্ছে রং নম্বর । এই রং নম্বরের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না আমি । সত্যেই ডিজিটাল হচ্ছি দিনদিন । এ রকম করতে করতেই একদিন অযাচিত একটি নম্বর থেকে মিস কল আসলো । আমি অতি উৎসাহে কল ব্যাক করলাম।

আরও পড়ুন গল্প রাজামারা

একটি মেয়েলি কণ্ঠ শোনার পর, আমার মনে হল, আমি কোন স্বর্গীয় সুখের দরজায় দাঁড়িয়ে সুখ অনুভব করছি, এই মুহূর্তের অনুভূতিটা আমি বলে বোঝাতে পারব না । নিজেকে কতটা ভাগ্যবান মনে হচ্ছিলো । আমি যার সঙ্গে কথা বলছি ফোনের অপর প্রান্তে একজন সুমিষ্টি কণ্ঠের রমণী।

ফোনটা ধরেই উনি আমাকে সালাম দিলেন, আমিও সালামের সমুচিত জবাব দিলাম ।

– কাকে চাই?’

-আমি কাউকেই চাই না ?’

-তাহলে ফোন দিয়েছেন কেন?’ কে বলছেন, কোথা থেকে বলছেন আপনি?’

আমার বুকের ভেতর আই-কুম বাইকুম করতে লাগল, আমি ভয়ে ফোনের লাইনটা কেটে দিলাম । আর কোন কিছুই জানতে চাইনি ।ঠিক দু’মাস পরে ফোন টিপাটিপি করতে করতেই মেয়েটির ফোনে কল চলে গেছে । অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসলো সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর, 

-‘আপনি আবার ফোন দিয়েছেন কেন?’

-আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন, তা কি করে চিনলেন?

-একটা রামছাগলকে চিনবো না, আমি তো আপনার নম্বর ব্যাড-ম্যান নামে সেভ করে রেখেছি ।

– আপনি আমাকে যেমনটা খারাপ ভাবছেন, আমি কিন্তু ঠিক এতটা খারাপ খারাপ না ।

-আপনি কি মক্কার খেজুর, আপনি খারাপ মানুষ না হলে কি? মেয়েদের নম্বরে কেউ কল দেয় ।

-ওরে বাবা, শুধু কি খারাপ মানুষই মেয়েদের ফোনে কল দেয় । ভালো মানুষ বুঝি মেয়েদের নম্বরে কল দেয় না।

আরও পড়ুন গল্প পাথরে ফুল

-আচ্ছা আপনি কি কিছু বলবেন, না আমি ফোনটা রেখে দেব? 

-প্লিজ !

-আচ্ছা আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?’

-প্রশ্ন তো একের পর এক করেই যাচ্ছেন, আবার অনুমতি নেয়ার কি আছে। গাধা কোথাকার।

-দেখুন আপনি আমাকে যতটা গাধা মনে করছেন, আমি কিন্তু এতটা গাধা না, আমি কিন্তু ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে মার্কেটিং এর ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট !

-হ্যাঁ জানি, আপনি ঢাকা ইউনিভার্সিটি, আমেরিকা ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা করছেন । এ রকম শিক্ষিত মানুষ প্রতিদিনই দুই চারজন আমাকে ফোন করে, চাপা মারার কিছু নেই; আপনার কিছু বলার থাকলে বলতে পারেন?

মেয়েটি রাগ করে সেদিন ফোন লাইন কেটে দিয়েছিল, আমি সারা রাত ঘুমাতে পারিনি । একটি মেয়ে এত সুন্দর করে, এত মিষ্টি করে কথা বলতে পারে । ওর কণ্ঠটা খুব শুনতে ইচ্ছে করছে, ওর জন্য মায়া হচ্ছে আমার। ওকে দেখিনি কখনো অথচ, মায়া হচ্ছে। চিনি না , জানি না কোনো সম্পর্কে নেই । তার জন্য এত মায়া হচ্ছে কেন ?’ ওর কণ্ঠ শুনতে ইচ্ছে করছে ভীষণ । এত ইচ্ছে থাকা ভালো নয় হয়তো । তবুও আমার ইচ্ছে করছে । 

নিজেকে সংবরণ করতে পারছিলাম না । খুব ইচ্ছে করছিল ওর সঙ্গে একবার কথা বলি । আমার মনে হচ্ছিলো, ফোন দিলেই ও প্রচণ্ড রেগে যাবে, লাইন কেটে দিবে । আমাকে বকাঝকা করবে, আমি ফোন দিয়ে কোন কথা বললাম না । 

– ও হ্যালো হ্যালো ! করে যাচ্ছে আমি এদিক থেকে লাইন কেটে দিচ্ছি । আবার কল দিচ্ছি , আবার কেটে দিচ্ছি , আবার রিসিভ করছে । কয়েকবার কণ্ঠ শোনার পরে আমি ফোনটা অফ করে রাখলাম সেদিন রাতে। অনুভূতি এমন মনে হচ্ছে ও আমার পাশে এসে কথা বলছে।

আরও পড়ুন গল্প সুকৃতি এবং বৈরীকাল

রাতে কখন ঘুমিয়ে গেছি নিজেই বুঝতে পারিনি । সকালে উঠে যখন নিজের ফোনটা খুললাম। তার কিছুক্ষণ পর একটি মোবাইলের স্ক্রিনে খুদে-বার্তা ভেসে উঠল,

– আপনি আমাকে ফোন দিয়েছিলেন, রাতে অনেকবার ! কোন কিছু বলতে চেয়েছিলে নিশ্চয়ই?’

আমি ফোন দিলাম ।

-শুভ সকাল , কেমন আছেন?’

– জি! ভালো আছি । 

আলাপচারিতায় ভদ্রতার খাতিরে যতটুকু কথা বলা যায় ঠিক ততটুকুই বলেছিলাম ।

-আপনার নামটা কি জানতে পারি ?’

-একজন নাম না জানা মানুষের কাছে ফোন দিতে আপনার লজ্জা করে না । আপনার কী সংকোচ-বোধ বলতে কোন কিছু নেই? নাকি একেবারে লজ্জা শরম ধুয়ে খেয়ে ফেলছেন?

সেদিন সত্যিই আমার খুব খারাপ লেগেছিল, আমি বিমূঢ় অবস্থায় পরে গিয়েছিলাম । একটা মেয়েকে ফোনে এভাবে একের পর, এক বিরক্ত করা ঠিক হয়নি । আমি নিজে সেটা বুঝতে পারলাম। সত্যি বলতে কি  ওর মিষ্টি কণ্ঠের কাছে আমি হেরে গিয়েছিলাম । আমার লাজ লজ্জা কোন কিছুই ছিল না , একেবারে বেহায়া মানুষের মতো ।

সেদিনের পর থেকে ওকে আর ফোনে আমি দেয়নি । মাঝে-মধ্যে মনে পড়লে , আমি ওকে খুদে-বার্তা পাঠাতাম । ও খুব সুন্দর করে মেসেজ পাঠাতো , আমি মুগ্ধ হয়ে পড়তাম । এভাবেই এক বছর পার হয়ে গেল । আমাদের দেখা হলো না। বার্তা আদান-প্রদান হয় কখনো- কখনো। ভেবে ছিলাম; মেয়েটি আমাকে পছন্দ করে না । 

আরও পড়ুন গল্প উপলব্ধি

হঠাৎ একদিন আমাকে ম্যাসেজ দিয়েছে, দেখা করার প্রস্তাব দিয়ে । 

আমি দ্বিধাদ্বন্দ্বে পরে গেলাম । কি করা যায় । তবে, নয় ছয় ভেবে মেয়েটির অফার সাদরে গ্রহণ করি । ম্যাসেজ এর নিচে ছোট করে নাম লেখা ছিল, জুঁই! সেদিন থেকে জানলাম মেয়েটির নাম ছিল জুঁই ।

‘সেদিন রাতে আর ঘুমাতে পারিনি । কোন জামা পরে যাব, প্রথমে কে কথা বলবে, মাথায় কী ক্যাপ দিয়ে যাবো , যদি ভাবে আমার মাথায় চুল নেই । ‘ফুল শার্ট পরে যাবো নাকি ?’ না অন্য কোন ব্যান্ডের পোলো শার্ট পরে যাব । মুখে কি হালকা হালকা দাঁড়ি থাকবে , নাকি ক্লিন শেভ করবো। জুতা পড়ব না কি চামড়ার স্যান্ডেল? আবার মনে হচ্ছে , হিমু সেজে যাবো । আমার যদিও একটা হলুদ পাঞ্জাবি আছে !’ 

বিষয়টি বন্ধু বাতেনকে শেয়ার করি , 

-খবরদার এমন মেয়েদের সঙ্গে দেখা করিস না ! অনেক সময় এরা ছিনতাইকারীদের সহযোগী হয়ে কাজ করে । ছেলেদের বিপদে ফেলে বড় অঙ্কের টাকা উশুল করে ! 

আমার গলা শুকিয়ে আসছে, বমি বমি লাগছে । আমার বিশ্বাস হলো না । মেয়েটি এমন করতে পারে । জুঁই শিক্ষিত, ভদ্র, মার্জিত, মননশীল মিষ্টভাষী সে এমন করবে?’ আমার মন কোন ভাবেই সায় দিল না ।

বাতেনকে উপেক্ষা করে জুঁইর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম । এবং সেদিন রাতে …….. ! ক্ষীণ অবস্থায় আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে । আমার সঙ্গে থাকা মোবাইলফোন , মানিব্যাগ, হাতের ঘড়ি কোন কিছুই নেই , মামা বিদেশ থেকে স্বর্ণের বেসলেট দিয়েছিল, সেটাও নেই।

ডাক্তার আমাকে প্রশ্ন করছেন, আপনার পরিচিত কেউ থাকলে তাদের আসতে বলুন । আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ, সূচক জবাব দিলাম । কোন নম্বর আমার মনে পড়ছে না । কাকতালীয় ভাবে বাতেন আমার কানের কাছে ফিসফিস করে জানিয়ে দিল , এখন থেকে আমাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে রেফার করা হচ্ছে !

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

কথোপকথন

Facebook Comments Box

প্রকৌশলী আলতাব হোসেন, সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশ এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত অলাভজনক ও অরাজনৈতিক সংগঠন ‘আমাদের সুজানগর’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সাধারণ সম্পাদক। তিনি ‘আমাদের সুজানগর’ ওয়েব ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও প্রকাশক। এছাড়া ‘অন্তরের কথা’ লাইভ অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক। সুজানগর উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, কৃতি ব্যক্তিবর্গ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে ভালোবাসেন। বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি স্বনামধন্য ওয়াশিং প্লান্টের রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেকশনে কর্মরত আছেন। তিনি ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুন পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালি ইউনিয়নের সাগতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!