ওরা তেরোজন (শেষ পর্ব)
ওরা তেরোজন (শেষ পর্ব)
কে এম আশরাফুল ইসলাম
সংখ্যায় ওরা বারোজন। বিলগাজনায় নকশাল গঠনের পূর্বেই তারা বিভিন্ন অপরাধমূলক দুর্ধর্ষ ক্রিয়াকলাপে জড়িত। বিলগাজনায় নব গঠিত নকশালের উদ্দেশ্য, ‘খাও দাও ফুর্তি করো, নারী নিয়ে মজা করো!’ ওদের আরও একটি মোক্ষম উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল। আর তা হলো রিক্তদলকে নির্মূল করে নিজেরাই রাম রাজত্বে বিনা বাধায় অপরাধ জগতের সব কাজ করবে। দুই গ্রুপই একে অপরের অস্তিত্বের রক্তে লেখা ১০ নম্বর হুমকি। বারোজনের সাথে যোগ দেয় করম আলী । উদ্দেশ্য ভাই হত্যার বদলা নেওয়া। ফলে দুই গ্রুপই একে অপরের বিধ্বংসী নিশানায় পরিণত হয়। মাঝে মাঝেই গভীর রাতে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলে নিশিপুর, শ্যামাপুর, দীক্ষানগর ও সারিয়াকান্দি সমন্বিত গ্রামগুলোতে। নিরীহ এলাকাবাসী শান্তিতে ঘুমাতে পারে না। কখন যেন কার জীবন প্রদীপ নির্বাপিত হয়ে যায়।
রিক্তদলের হাই কমান্ড নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে যাবতীয় নির্দেশ প্রদান করে।
── কোনো মামলাই থানায় বা কোর্টে করা যাবে না।
পৃথিবীর মায়াজাল ছিন্ন করে চিরতরে হারিয়ে যেতে হবে। মামলাকারী তাদের রেড-সিগন্যালে পড়ে যায়। এলাকার প্রাক্তন মাতব্বর এবং শিক্ষিত প্রজন্ম তাদের কাছে নাচের পুতুল বৈ কিছু নয়। শিক্ষিত প্রজন্মকে জীবনের ভয়ে রাস্তায় রিক্তদলের কারো সাথে দেখা হলে অবনত মস্তকে সালাম দিতে হয়। নচেৎ অযাচিত অবস্থার মধ্যে মানবেতর জীবন কাটাতে হয়। নিজেদের ভেতর অর্থ হাতিয়ে নেবার জন্য তারা বিভিন্ন সময় অর্থ আদায়ের পন্থা অভিন্ন।
ওদের টার্গেট সমাজের ধনি, বড় বণিক শ্রেণি এবং চাকুরীজীবী। মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে তাদের কাছে নির্ধারিত অঙ্ক বেঁধে দেয় এবং নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে একাকি রেখে যেতে আদেশ জারি করে। ওরা উক্ত সময়ে নিরাপদ দুরত্বে থেকে বিষয়টা নিরীক্ষণ করে। তারপর সতর্ক চৌকিতে ওরা টাকা নিয়ে চলে যায়। কখনো কখনো কিডন্যাপিং করে মুক্তিপণ আদায় করে। কারো বাড়িতে কেউ বিল্ডিং করলেও তাকে মোটা অঙ্কের টাকা গুণতে হয়। অনুষ্ঠানে তাদের জন্য অতিরিক্ত বাজেট রাখতে হয়। হাট-বাজারের দোকানপাট যেন ওদের পৈত্রিক সম্পত্তি। শ্যেন দৃষ্টিতে ওদের সুনিশ্চিত টার্গেট।
আরও পড়ুন গল্প সময়ের পাঁচফোড়ন
জনজীবন আর জনপদ ওদের কাছে বন্দি। বনরাজ সিংহের মতো হুঙ্কার ছেড়ে মেদিনী দাপিয়ে চলে। ওরা যে পরিবারের সন্তান, তারাও যেন এক একটা এটমবোম্ব। ওদের ধাঁচেই তাদেরও চাল-চলন, কথা-বার্তা। একদা রবুস একজনের কাছে ‘চার লক্ষ টাকা’ দাবি করে। লোকটি রবুসের পিতা নারদকে কথাটা জানালে জবাবে বলেন,
── আমার রবুস কারো কাছে বেশি দাবি করে না! চাহিদা মাফিক টাকাগুলো নির্দিষ্ট সময়ে দিয়ে দিস।
রবুসের পিতা লোকটিকে আরও জানিয়ে দেয়,
── লোকজন বিচার-আচারে এখন দুলাল খানকে ডাকে না। আমার রবুসকেই ডাকে।
নিরক্ষর এই প্রজন্ম বন্দুকের নলের মুখে তাদের এলাকায় দাপটের সাথে চলে। মানি লোকের মান ওরা রাখে না। অস্ত্রকেই সকল কিছুর মানদণ্ড বলে মনে করে।
বিপন্ন মানুষ আর বিপদের অকৃত্রিম বন্ধু, অমায়িক মালিকের বিরুদ্ধে নিরক্ষর নির্বোধ অপরিণামদর্শী রাখালের মুখে স্পর্ধার এমন খাপছাড়া দুঃসাহসিক বুলি ব্যাঙের আধুলির মেকি আস্ফালন বৈ কি।
বিলগাজনা নকশালের জন্য নিরাপদ জোন। রাস্তা নাই বললেই চলে। পায়ে হাঁটা গ্রাম্য রাস্তা। বর্ষা মৌসুমে মনে হয় বিশাল এক সাগর ঢেউ তুলে খেলা করছে। পানিতে ডুবে যায় বলে এখানকার বাড়িগুলো সমভূমিতে মাটি ফেলে পঁচিশ-ত্রিশ ফুট উঁচুতে নির্মাণ করা হয়। শুষ্ক মৌসুমে মনে হয় বাড়িগুলো কৃত্রিম পাহাড়ের উপরে। বেশ ফাঁকাফাঁকা বাড়িগুলো। বর্ষাকালে নৌকাই একমাত্র যাতায়াতের অবলম্বন। ওরা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সব চেয়ে বিচ্ছিন্ন এক বাড়িতে আশ্রয় নেয়। বাড়িওয়ালা একান্ত অনিচ্ছা সত্বেও তাদের আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে চলে। বর্ষা মৌসুমটা ওদের জন্য সোনালি ঋতু বলে মনে করে। মেশিন চালিত নৌকায় পরিকিল্পনা মাফিক ভাগে ভাগে ফুরফুরে মেজাজে চলে। কা সাগরকান্দি বাজাররের ঔষধের দোকানসহ চাহিদা মাফিক ওদেরকে মাসোহারা দিতে বাধ্য। প্রথম শ্রেণির মাছ, মাংস, তরিতরকারি ওদের কাছে তালিকা অনুযায়ী পৌঁছে যায়। যেন স্বৈরাচারী রাজা-বাদশাহ তাদের খায়েশ পূরণ করছে। ওদের পূর্ব পুরুষ মনে হয় দোকানে দোকানে উত্তরসূরি এই নরপশুদের জন্য অ্যাডভাঞ্চ টাকা দিয়ে গেছে! ওদের ইচ্ছাই শিরোধার্য।
আরও পড়ুন গল্প মামৃত্যু
দিনের বেলায় শরীরে চাদর পেঁচিয়ে অস্ত্রসহ গ্রামে গ্রামে টহল দিয়ে দেখে কার বাড়িতে সুন্দরী মেয়ে আছে। ওরা বলে আসে,
── মেয়েটিকে রাত বারোটার সময় আমাদের আস্তানায় দিয়ে আসিস!
বারোজনের জন্য বারোজন সুন্দরী মেয়ে ওরা নির্বাচন করে যায়! কথা অনুযায়ী কাজ না হলে জোরপূর্বক উক্ত সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে ওরা সারানিশি ইচ্ছেমতো কামাচারের পর জীবনের লীলা সাঙ্গ করে লাশ ফেলে রাখে যেখানে সেখানে! উক্ত এলাকার যেকোনো নব বধুর সাথে ওরা প্রথম নিশি যাপন করে। নচেৎ জীবন দিতে হয়।
এভাবে মগের মুল্লুক কায়েম করে ওরা বেপরোয়া ভোগ বিলাসে মত্ত। ভুক্তভোগীরা আল্লাহর দরবারে কেঁদে কেঁদে এর অবসান কামনা করে। আপাতত মুমূর্ষু অবস্থায় বেঁচে থাকার জন্য পিতা তার মেয়েকে, শ্বশুর বা স্বামী তার পুত্রবধু বা বধুকে ইজ্জত বিকিয়ে দেওয়ার জন্য আর কত দিন এমন অসহায় হয়ে মনঃকষ্ট নিয়ে জীবন যাপন করবে? জাহেলিযুগের প্রাগৈতিহাসিক কাজ ওরা অবলীলায় করে যায়।
একটা সময় গ্রামের মানুষ নিজেদের সমস্যা বুঝতে পারে। এভাবে সব কিছু সহ্য করে নিতে থাকলে নিজেদের কিছুই থাকবে না। পুলিশকে বিষয়টি জানানো হয়। তারা উপর মহলে জানিয়ে র্যাবের সহযোগিতায় কিছুদিন পরে সবাইকে আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হয়।
ওরা জীবনের অচিন্তনীয়-অবিশ্বাস্য শেষ মুহূর্ত যেন দেখতে পাচ্ছে। শ্বাসরুদ্ধকর অপারেশন। ওরা দিশেহারা। এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে থাকে ওরা। অপারেশনে এলিট ফোর্স দুর্ভেদ্য প্রাচীর হয়ে সুকৌশলে এগুতে থাকে। একে একে ঝরতে থাকে অপরাধী চক্র। বিলে থৈথৈ পানি। ইঞ্জিন চালিত নৌকায় অপারেশন চলমান।
আরও পড়ুন গল্প উপলব্দি
শেষ হয় বারোজনের জীবনের সকল সাধ। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় জুয়েল। জুয়েল বিবস্ত্র অবস্থায় নৌকা থেকে লাফিয়ে পড়ে ঘন কচুরিপানার মধ্যে। নাক ডুবা পানি। কোনো মতো নাকটা পানির উপরে দিয়ে সে কচুরিপানার মধ্যে অনড় অবস্থায় দীর্ঘ প্রায় আট-দশ ঘণ্টা মৃত্যুর ফাঁদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্রষ্টার নাম জপতে থাকে। এভাবেই সে বেঁচে যায়। পুলিশ অনেক খোঁজাখুঁজির পর না পেয়ে অপারেশন ইতি টেনে লাশগুলো ডাঙায় তোলে। ভুক্তভোগী এলাকাবাসীর বাঁধভাঙ্গা উল্লাস। তারা মরা লাশের ওপর আক্রোশে বেসামাল আচরণ করতে থাকে। কেউ লাথি মারে। কেউ জুতা পেটা করে। কেউবা ঘৃণায় থুথু নিক্ষেপ করে মনের ক্ষোভ আংশিক প্রকাশ করে।
একজন নারী এসে বলল,
── “কিরে! ইজ্জত নিয়ে খেলবি না?’কোথায় গেলো তোদের দাপট।
শেষ হয় অন্ধকার জীবনের নীল খেলার শেষ ঠিকানা। শুধু কোনো কোনো রাতে মাস্টার সাহেব এর স্ত্রী চিৎকার করে ওঠে।
ঘুরে আসুন আমাদের ফেসবুক পেইজে
ওরা তেরোজন (শেষ পর্ব)