এখানে স্নিগ্ধ সকাল
এখানে স্নিগ্ধ সকাল
লোকটার নাম শ্রী হরিদাস চন্দ্র হালদার। সবাই তাকে হারে হলদার বলেই ডাকে। তাতে সে কিছু মনে করে না। গরীবদের মনে করতে নেই, সবকিছু মেনে নিতে হয়। মৎস্য আহরণ বিক্রয়ই তার পেশা, জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উপায়। খুব ছোট বেলায় বাবাকে হারিয়েছে, সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় মা চলে গেলেন। ভিটেমাটি ছাড়া যে সামান্য জমি আছে, তাতে ২/৩ মাসের খোরাক হয়। তাতে বছর চলে না। বাধ্য হয়েই পৈতৃক মাছ বেচা পেশাতেই যুক্ত হতে হল তাকে।
হরিদাস দীর্ঘাঙ্গ, পেটা শরীর। বেশ পৌরুষদীপ্ত। কিন্তু হাড়ভাঙ্গা খাটুনিতে এক সময়ের ফর্সা রং জলে ভিজে, বৃষ্টিতে পুড়ে এখন তামাটে, আগের ঔজ্বল্য আর তেমন অবশিষ্ট নেই। তবুও এখনো তাকে দশ জনের মধ্যে আলাদা করে চেনা যায়। খানিকটা শিক্ষিত বলে আচার আচরণ কথাবার্তায় অন্যদের চেয়ে সে একটু আলাদা। কোঁচামারা ধুতির উপরে হাতাওয়ালা গেঞ্জিতে সংবছর হাটে বাজারে মাছ বিক্রি করে সে। অন্য জেলেদের মতো খালি গায়ে কখনো দেখা যায়নি তাকে। আর সবার মতো বিড়ি টানে না হরিদাস। কম দামের হলেও সিগারেট খায় সে। তার একটা তিন পকেটযুক্ত ফুল শার্ট আছে। ধোলাই করে সযত্নে টিনের বাক্সে রাখা। কখনো বাইরে গেলে বের করে। তাও বেশিরভাগ সময়ে কাঁধের উপরেই রাখে, নষ্ট হবার ভয়ে।
এ নিয়ে বউ টিপ্পনী কাটে,
“মিনসের জামা আর গতরে ওটে না।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে হরিদাস বলে,
“কি করবো ক? আমার এই একখানই জামা, ছিরা গেলি নয়া বানান্যার সাদ্যি নাই, তাই এহেবারে ঠেহায় না পরলি গায় দেইন্যা। তুই রগড় করিস বউ, কিন্তু আমি তো তোর অকম্মা সোয়ামী। তোরে একখান নয়া কাপুড় দিব্যার পারি না, বিলাউজ ছাড়া খালি গরতে ঘুরা ঘুরা কাম করিস। ঠিকমতো খাওনই জুটাব্যার পারিন্যা। আমার খুব কষ্ট হয় বউ।”
আরও পড়ুন গল্প হাইয়া আলাল ফালাহ
যশোদার মনটা বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। স্বামীর জন্য খুব কষ্ট হয় তার। হাতের কাজ ফেলে স্বামীর কাছে এসে ঘনিষ্ট হয়ে বসে। অভিমানি গলায় বলে,
‘অসব অকতা কয়ো না তুমি। আমি কি তুমার কাচে কিছু চাইচি? ভগবান খুব সুকে রাকচে আমার। তুমি ভাল থাকলি আমার আর কিছু দরকার নাই।”
স্বামীর কাঁধে মাথা এলিয়ে দেয় যশোদা। মাথাটা নিজের বুকে টেনে নেয় হরিদাস। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। আসলে ভালোবাসার কোন প্রকারভেদ নেই। ধনীর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে যে নিবিড় ভালোবাসা খেলা করে, নির্ধণের জীর্ণ কুটীরেও সেই একই ভালোবাসা অমলিন শাশ্বত রূপে হেসে ওঠে। ভালোবাসার কোন জাতপাত নেই ।
হরিদাস ভালবেসেই বিয়ে করেছিলো যশোদাকে। যশোদাও ভালোবাসার টানেই পরিবারের সকলের বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে রাতের আঁধারে হরিদাসের ডিঙ্গি নায়ে নদী পারি দিয়েছিলো।
পদ্মা পাবনা জেলা আর রাজবাড়িকে দু’ভাগ করেছে। হরিপদের বাড়ি পাবনার নাজিরগঞ্জে, যশোদাদের রাজবাড়ি জেলার বেলগাছিতে। নদীর এপাড় ওপাড়। হরিদাসের এক জ্ঞাতিভাই বিয়ে করেছে বেলগাছিতে। সেই সুবাদেই যাওয়া আসা। সেখান থেকেই পরিচয় এবং প্রণয়। কিন্তু বেঁকে বসলেন যশোদার বাবা। উড়নচণ্ডি পিতৃমাতৃহীন হরিদাসের সাথে বিয়ে দেবেন না মেয়েকে। লোকজন লাগিয়েও মন গলানো গেলো না বাবার। মাও মেয়ের পক্ষ হয়ে অনেক বোঝালেন। কাজ হল না। অনড় বাবা ঘোষণা দিলেন, গলায় কলসী বেঁধে মেয়েকে পদ্মায় ডুবিয়ে দেবেন, কিন্তু হরিদাসকে জামাতা করবেন না।
আরও পড়ুন গল্প লালু
যশোদা পদ্মায় ডুবানোর আগেই একরাতে ঘর ছেড়ে হরিদাসের হাত ধরে চলে এলো নাজিরগঞ্জে। কামারহাট কালি মন্দিরে পুরোহিত কানু ঠাকুর মন্ত্র পাঠ করে সাত পাক ঘুরিয়ে বিয়ে দিয়ে দিলেন তাদের। এ নিয়ে বিচার সালিশ হল, কিন্তু ফলাফল শূন্য। যশোদার অনমনীয়তায় বাবার চেষ্টা ভেস্তে গেলো । রাগে মেয়েকে ত্যাজ্য করে চলে গেলেন তিনি। মায়ের পায়ের ধুলো যশোদার কপালে জুটলেও, বাবারটা পেলো না সে।
যশোদার জন্যে হরিদাসের মনটা খুব পোড়ে। শুধু তার জন্যই যশোদা কুলমান ত্যাগ করেছিলো বলেই তার প্রতি ভালোবাসা, মায়া একটু বেশিই হরিদাসের। সে জানে, তাবৎ পৃথিবীতে যশোদার ভালোবাসা, মান-অভিমান, দুঃখ-কষ্ট সব কিছুর জায়গা শুধু একখানে, তার কাছে। তাই প্রাণান্ত পরিশ্রম করে সে। সাধ্যমতো সব সুখ যশোদার করতলে গুঁজে দিতে চায়। যশোদা এটা বোঝে। তাই শত কষ্ট হলেও হাসি মুখে সয়ে যায়। প্রাণপণ চেষ্টা করে স্বামীকে খুশি রাখতে। এ এক অন্তর্গত ভালোবাসার মোহনীয় প্রতিযোগিতা। এই স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসার টানই পৃথিবীকে এখনো ঐশ্বর্যময় করে রেখেছে। বাবা মা ভাই বোনের জন্য যশোদার অন্তরটা পুড়ে যায়। কিন্তু হরিদাসকে কিছুই বুঝতে দেয় না সে। পাছে স্বামী মনে কষ্ট পায়, সেই ভয়ে। বাবার অগোচরে মায়ের সাথে লোক মারফত যোগাযোগ হয়, কিন্তু দেখা সাক্ষাৎ হয়। না।
দুই বছর পরে, যশোদা যখন সন্তান সম্ভাবা, তখন সুখবরে একরোখা বাবার মন নরম হল। ওদের কোন কিছু না জানিয়েই মিষ্টি নিয়ে হাজির হরিদাসের বাড়িতে। কিন্তু লোকের মাধ্যমে গোপনে মেয়েকে সংবাদ জানিয়ে দিয়েছিলো মা। সাধ্যমতো শ্বশুড় শ্বাশুড়িকে আপ্যায়নের আয়োজন করেছিলো হরিদাস। দীর্ঘ দুই বছর পরে পিতা-পুত্রির মিলন। যশোদা বাবার পায়ের ধুলো মাথায় নিতেই বুকে টেনে নিলেন বাবা। চোখের জলে ভিজছে তারা। মা আঁচলে চোখ মুছে খুশিতে হাসছেন। একপাশে দাঁড়িয়ে আছে হরিদাস। খুশির জল তাকেও স্পর্শ করেছে। একসময় বাবা এসে তার হাত চেপে ধরে বললেন,
“আমারে মাপ কইরা দিয়ো বাবা। মাইনসের কতায় আমার ঘাট হইচে। তোমাগোও কষ্ট দিচি, আমিও কষ্ট পাইচি। কিচু মনে রাইখোনা বাবা । আজকে সাঁজেই তোমাগো লইয়া নদী পার দিমু আমি।”
আরও পড়ুন গল্প রাজামারা
বাদ সাধলো হরিদাস,
“না বাবা। এই পরথম আপনেরা আমার বাড়িত আইচেন, আজ আর যাব্যার দেবো না। রাতখান থাহ্যা কাল বিয়ানে গরম ভাত খায়া নায় উটপো। ঘর একখান তো খালিই পরে থাহে। থাহার কুনু অসুবিদ্যা নাই।”
যশোদাও বাবার হাত ধরে অনুরোধ করলো। শেষে বাধ্য হয়েই সে রাত জামাই বাড়িতে কাটাতে হল তাদের। যশোদা বাবার পছন্দ মতো রান্না করেছে। ভাজা পিঠা আর পায়েশ বাবার প্রিয়, সেটাও করেছে সে। খেতে বসে আয়োজন দেখে বাবা অবাক! খুশিতে তিনি বললেন,
“পাপী বাবার সপ পচন্দই মনে রাকচিস মা।”
ধুতির খোঁটায় চোখের জল মুছলেন তিনি।
বিয়ের দু’ বছর পরে এই প্রথম শ্বশুড় তার বাড়িতে এসেছে। পুরুষের চেয়ে নারীরা যে কতো হিসেবী সংযমী সেটা এবার বুঝতে পারলো হরিদাস। সে যখন আপ্যায়ন খরচের চিন্তায় দিশেহারা, তখন তাকে অবাক করে যশোদা তার হাতে বেশ কিছু টাকা তুলে দিলো। বিস্মিত চোখে হরিদাস বললো,
“এতো টাহা কনে পাল্যা তুমি?”
“এতদিন ধরে ইটু ইটু করে জমাইচি। পুষা হাঁস-মুরগীর ডিম, মুষ্টির চাল, পালানের শাকসব্জি ব্যাচা টাহা। এতোদিন পর বাবা মা আসপেন, তাগোর সামনি তো আর জামাইরে ছোট করব্যার পারিন্যা । আমি জানি, কিনাকাটার টাহা তুমার কাচে নাই। লজ্জায় আমার কাচেও কব্যানা। মানসির কাচে ধার দিনা করা লাগবি। তার দরকার নাই। এই টাহা থ্যান বাজার সদাই করা আনো।”
সেবার খরচের দুশ্চিন্তায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় স্বামী হরিকে উদ্ধার করেছিলো গৃহলক্ষি অন্নপূর্ণা যশোদা। দু’বছর পরে প্রথম শ্বশুড়ালয়ে যাবার খরচও যশোদাই যুগিয়েছিলো।
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
এখানে স্নিগ্ধ সকাল