একশত-ছিদ্রযুক্ত-জামা-২য়-পর্ব
আলাদীপুর,  গল্প,  তালিমনগর,  নাজিরগঞ্জ,  নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের ইতিহাস ও ঐতিহ্য,  মুক্তিযুদ্ধ,  সাইফুর রহমান,  সাতবাড়িয়া,  সাহিত্য

একশত ছিদ্রযুক্ত জামা (২য় পর্ব)

একশত ছিদ্রযুক্ত জামা (২য় পর্ব)

সাইফুর রহমান

 

প্রত্যুষে উঠে পেটের ধান্দাটাই আগে করতে হয় রেজেকের। তাকে যেতে হয় রসু মিয়ার বাড়ি। রসু মিয়ার কাছে তিন মাস আগের পেঁয়াজ বিক্রির কিছু পাওনা বাকি পড়ে আছে। বেশ কয়েক মাস ধরে টাকাটা আটকে রেখেছে রসু মিয়া। চাইলেই শুধু গাইগুই করে। সাথে নানা রকম টালবাহানা, ওজর-আপত্তি ও ভাঁওতাবাজি প্রতিজ্ঞা। টাকাটা তুলতে পারলে কয়েক দিনের সংসার খরচটা আপাতত সামাল দেওয়া যায়। এরপর তাকে যেতে হবে লালডাঙ্গী বটতলায়। যেখানে হুজুর আস্তানা গেড়েছে, সেখানটায়। হুজুরের নাম শাহ সুফি কুতুব উদ্দিন জালালাবাদী। রসু মিয়ার বাড়িতে যাওয়ার পথে কুতুব উদ্দিন জালালাবাদী সম্পর্কে লোকমুখে অনেক কথাই শুনতে পায় রেজেক। তার বদ্ধমূল ধারণা, এই দুর্দিনে একমাত্র জালালাবাদীই তার সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারবে।

নির্জন মধ্যাহ্ন। গ্রীষ্মের তেজোদীপ্ত রৌদ্রে চারদিক ঝাঁ ঝাঁ করছে। এরই মধ্যে রেজেক গিয়ে হাজির হয় হুজুরের আস্তানায়। ঝুরি নামানো দানব আকৃতির বটগাছ। তারই নিচে মাটির বড় ঢিবি করে বেদির মতো বসার একটি জায়গা করা হয়েছে। তার ওপর চরানো হয়েছে রক্তবর্ণের একটি লাল চাদর। শাহ সুফি কুতুব উদ্দিন বসে আছেন হাঁটু ভেঙে সন্ন্যাসীর ভঙ্গিমায়। গলায় অবশ্য রুদ্রাক্ষের মালা নেই। তার পরিবর্তে হাতে তসবিহ। গা-গতরে ইয়া তাগড়াই ভাব। শুধু গৌরবর্ণ বললে ভুল হয়। এ যেন একেবারে ফাটা বাঙির মতো চেহারা। ছুঁচলো নয়, বেশ লম্বা সফেদ দাঁড়ি বুক পর্যন্ত নেমে এসেছে। গোঁফগুলো সম্পূর্ণরূপে কামানো। শরীরে ঘি রঙা লম্বা আলখাল্লা পোশাক। তার ওপর হুজুর গায়ে চাপিয়েছেন হালকা সবুজ রঙের একটি মেরজাই।

আরও পড়ুন  পাবনায় প্রথম শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা বুলবুল

সৌম্য-শান্তমূর্তি হুজুর মুদিত নেত্রে আপন মনে তসবিহ জপছেন। তার চারপাশ ঘিরে রয়েছে নানা ধরনের ভক্ত, মুরিদ ও আশেকানবৃন্দ। রেজেক বেদির পাশে বসে কুতুব উদ্দিন হুজুরের পা দুটো চেপে ধরে বলল,
── হুজুর, আমাক আপনি বাঁচান। অনেক দুঃখ-কষ্টে জীবন যাপন কইরতেছি। মুখে দুমুঠ ভাত জুগাবির পারিনে। মনে অনেক জ্বালা-কষ্ট।
হুজুর তখনো চোখ বন্ধ করে নির্লিপ্ত রইলেন। পাশ থেকে একজন মুরিদ বলল,
── এই হারামজাদা, হুজুরের নজরানা কনে? তুই জানিসনে নজরানা ছাড়া হুজুরের সাথে দেহা করা অন্যায়। এক টাকার চার ভাঁজ করা আধময়লা একটা নোট লুঙ্গির খুঁটের ভেতর মোড়া ছিল। সেটি বের করে রেজেক তুলে দিল মুরিদের হাতে।
── এই এক টাহাই আমার কাছে ছিল, বাবা। আপনি দয়া করে এডা গ্রহণ করেন। আমার জীবনে অনেক সমেস্যা। ব্যবসা-বাণিজ্য অয় না। খাবির-পইরবের পারিনে। মাজে-মইধ্যে মনে অয় নিজের জান নিজে নেই। বাবা আপনি কয়া দেন আমি এহন কী হরবো?
── এই, তুই এত বাবা বাবা করছিস কেন রে? তোর মা তো আমাকে ভাতার হিসাবে গ্রহণ না-ও করতে পারে। কথাগুলো বেশ তীক্ষ্ণ কিন্তু গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললেন হুজুর জালালাবাদী।
── কথাটা বুইঝলেম না, হুজুর আমার মা-বাবা কেউ তো আর বাইচে নেই।
অত্যন্ত নিরাসক্ত ও তাচ্ছিল্যভরা কণ্ঠে হুজুর বললেন,
── আমার সামনে থেকে হট যাও। তুমকো দিয়ে কুচ কাম নেহি হোগা। তোমার জীবন এভাবেই চলবে। সমস্যার সমাধান হবি না।
── একি কথা বলতিছেন হুজুর? দয়া কইরে আমার জইন্যে কিছু একটা করেন। এই বলে রেজেক আলী হুজুরের ধবধবে ফরসা মসৃণ পা দুটো জোরে চেপে ধরে।
── এই, পা ছোড়। পা ছোড়। তুম জলদি ইহাছে নিকালো মিয়া। কিন্তু কে শোনে কার কথা। রেজেক সহজে ছাড়বার পাত্র নয়। আরো জোরে চেপে ধরে হুজুরের পা।
হুজুর দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলেন,
─ শোন মিয়া, উপায় একটা আছে। তুই যদি ছেঁড়া-ফাঁড়া ছিদ্রওয়ালা জামা পরে চলাফেরা করিস, তাহলে হয়তো একদিন তোর এসব শনির দশা দূর হয়ে যাবে। আখেরাতে শান্তি পাবি আর রোজগারেও বরকত হবে, জীবনে উন্নতি আসবে।

আরও পড়ুন বীর প্রতীক আজিজুর রহমান

── অবশ্যই পরব। আপনি শুধু আমাক কয়া দেন পিরেনে কয়ডা ছিদ্র হওয়া লাগবি?
── পিরেন, এটা আবার কী? হুজুরের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি রেজেকের দিকে।
পাশ থেকে জনৈক মুরিদ বলে ওঠে,
── হুজুর, পিরেন মানে হচ্ছে জামা। হুজুর মাথা নাড়ে। এরপর চুপ করে থাকে। কিছু সময়ের জন্য তার মুখে আর অন্য কোনো কথা জোগায় না। তা শ খানেক ছিদ্র তো হওয়াই উচিত।
কী যেন একটু চিন্তা করে হুজুর বলে,
── শ খানেক না হলেও বিশ-পঁচিশটা ছিদ্র হলেও তোর কাজ হয়ে যাবে।

জীবনের যাবতীয় ক্লেশ ও দুঃখ-দুর্দশা মোচনের স্বপ্ন নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে রেজেক আলী। বাপ- দাদার আমলের মরচে ধরা ট্রাঙ্কটা বের করে আনে তক্তপোশের নিচ থেকে। ট্রাঙ্কটি খুলতেই ভুরভুর করে ন্যাপথলিনের একটি সুন্দর গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে।
── আপনি আচানক ট্রাঙ্ক খুলতিছেন ক্যান? মোমেনা কৌতূহলভরা কণ্ঠে রেজেককে জিজ্ঞেস করে।
── কাম আছে। পুরনো পিরেন খুঁইজতেছি। ছেঁড়া-ফাঁড়া হলি ভালো অয়। কমছেকম একশটা ফুটো হলি তো আর কথাই নাই।
── ছেঁড়া-ফাঁড়া জামা দিয়ে আপনি কী হইরবেন? কামের মুরদ নেই, খালি অকাম। আমি কচ্ছি, আপনি এহনি ট্রাঙ্ক জাগামতো তুইলে রাহেন।
── মাগি, তুই চুপ কর। এইডা আমার বাপ-দাদার ট্রাঙ্ক। আমার মনে যা চায়, আমি তা-ই হরবো, তোর কী? এডা কি তুই তোর বাপের বাড়িত্তিন যৌতুক আনিছিলি নাকি?

আরও পড়ুন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ গোলাম সারোয়ার খান সাধন

অবশেষে পুরনো ট্রাঙ্কের ভেতর থেকে একটি জীর্ণ শার্ট খুঁজে পায় রেজেক। জামাটার বেশ কয়েক জায়গায় ছেঁড়া। ছেঁড়া বলেই হয়তো মোমেনা ওটা ট্রাঙ্কবন্দী করে রেখেছিল বহুকাল। জামার দু-তিন জায়গায় ছেঁড়া হলে তো চলবে না। কমছে কম একশটা ছিদ্র করতে হবে। নিজ গৃহে কাঁচি নেই বলে প্রতিবেশী খইমুদ্দির বাড়ি হতে মোমেনাকে দিয়ে কাঁচি আনিয়ে নেয় রেজেক। পুরনো সেই ছেঁড়া জামাটাকে আরো বেশ কয়েকটা জায়গায় ফুটো করতে করতে গুনগুন করে গানের একটি সুর ভাঁজতে থাকে রেজেক। মনে হয় যেন রাজ্যের সমস্ত সুখ আজ ভর করেছে তার মনে। বিশ-পঁচিশটার মতো ফুটো তৈরি করার পর রেজেক নিজের মনেই বলে ওঠে, আপাতত এই কড়া হলিই চলবি। হুজুর কয়ছে বিশ-পঁচিশটায় কাম হবি।

অসংখ্য ছিদ্রযুক্ত জামাটা গায়ে দিয়ে আস্ত গ্রাম চক্কর দেয় রেজেক। ঐ একটি শার্টই হয়ে ওঠে তার প্রতিদিনের পরিধেয়। গ্রামের লোকজন হাসি-তামাশা করে তাকে নিয়ে। টিপ্পনি কেটে বলে,
── কী রে রেজেক, তোর এই নতুন বসনের মাজেজা কী?
গ্রামের অবস্থাপন্ন গৃহস্থ সলিম শেখ রেজেক আলীকে উদ্দেশ করে বলে,
── হুজুর তোক কী ভুজংভাজং মন্ত্র দিল আর ওমনি তুই বশ হয়্যা গেলি? বেটা আহাম্মক কোনকের। হুনছিস গ্রামে মিলিটারি আসতিছে। কাশিনাথপুরে নাকি পাকবাহিনী ক্যাম্প গাড়েছে। দু-এক দিনের বিদিন আলাদিপুর চইলে আসলো বুইলে। তারপর লালডাঙ্গীও কি বাদ থাকপিনি। সবাই পলা যাচ্ছে গাজনার বিল পার হয়া। আর তুই ছিড়া জামা গায়ে দিয়ে রং ঠাপাচ্ছিস? মিলিটারিরা নাকি জুয়ান মর্দদের সবার আগে খতম করতিছে। টপ কইরে পলা। বউ নিয়ে বিল পার হয়া নাজিরগঞ্জ না হয় তো সাতবাড়িয়া চইলে যা। তা না হলি বাঁইচপের পারবিনানে।
── বিলের ওই পারে আমার কোনো কুটুম নাই গো চাচা। আমি যাব কনে? কথাগুলো আতঙ্কগ্রস্ত কণ্ঠে সলিম শেখকে উদ্দেশ করে বলে রেজেক।

আরও পড়ুন ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কমরেড প্রসাদ রায়

সলিম শেখের কথাই শেষ পর্যন্ত সত্য বলে প্রমাণিত হয়। দু-এক দিনের মধ্যেই লালডাঙ্গী গ্রাম জনশূন্যে পরিণত হতে থাকে। পরিবার-পরিজন নিয়ে সবাই ঊর্ধ্বশ্বাসে গাজনার বিল পার হয়ে চলে যাচ্ছে দক্ষিণের দুর্গম দুর্ভেদ্য গ্রামগুলোতে। রেজেক অবাক হয়ে দেখে তার দীর্ঘদিনের প্রতিবেশী খইমুদ্দিও সবকিছু বাধাছাদা করে পরিবার নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে বিলের ওপার তালিমনগর গ্রামে। ওখানে তার কোনো এক আত্মীয় বাস করে সেখানটায়। খুইমুদ্দিকে আজ সবই রেখে যেতে হচ্ছে পেছনে। বাড়ি, খড়ের পালা, পুকুরভর্তি মাছ, গোয়ালভর্তি গরু, বাগান, বিছানা-বালিশ, খাট-পালঙ্ক, আলমারি, কাদামাটিতে শুকিয়ে যাওয়া পদচিহ্ন- মোটামুটি সবই। সাথে শুধু দু-চারটে তোরঙ্গ-স্যুটকেস; এই যা সম্বল। অথচ এই খইমুদ্দি রেজেকের সঙ্গে বাড়ির চৌহদ্দির আধগজ জমি নিয়ে গন্ডগোলের সময় মনে হয়েছিল, সে বুঝি রেজেককে খুনই করে ফেলবে।

আরেকবার তার এক বকনা গাই, রেজেক সেটাকে ডাকত ভুলু বলে, তার সেই ভুলু খইমুদ্দির খড়ের পালায় মুখ দিয়ে অল্প একটু খড় খেয়েছিল মাত্র; কী মারটাই না মেরেছিল খইমুদ্দি সেই বোবা জন্তুটাকে। অথচ আজ সমস্ত কিছু রেজেকের ভরসায় ছেড়ে যাচ্ছে সে। খুইমুদ্দি আজ কেমন নিশ্চিন্ত ও নিরুদ্বেগ। মৃত্যুর মুখে জীবনের সবকিছুই যেন একেবারে অর্থহীন।
খইমুদ্দির ছেলে এছের আলী পাশের বাড়ির কোমেলাকে ভালোবাসা নিবেদন করে বলেছিল, সে নাকি কোমেলাকে তার জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসে এবং সেটা প্রমাণ করতে বেশ কিছুদিন এছের ছোট্ট একটি বিষের শিশিও সঙ্গে নিয়ে ঘোরাফেরা করত। প্রায়ই কোমেলাকে হুমকি দিয়ে বলত, শোন কোমেলা, তুই যদি আমাক ভালো না বাসিস, তাহলে আমি কিন্তু এই যে বিষ দেখতেছিস, এই এক বোতল বিষ সবটুকুন খাইয়া মরব। অথচ এছের অবলীলায় আজ কোমেলাকে পেছনে ফেলে রওনা হয়েছে নাজিরগঞ্জের উদ্দেশ্যে। কোমেলারও আজ এ উপলব্ধি হয়েছে যে নিজের চেয়ে কেউ কাউকে বেশি ভালোবাসতে পারে না। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর চেয়ে ধ্রুব সত্য বোধ করি আর কিছু নেই।

আরও পড়ুন একশত ছিদ্রযুক্ত জামা-
১ম পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
শেষ পর্ব

 

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

একশত ছিদ্রযুক্ত জামা (২য় পর্ব)

Facebook Comments Box

সাইফুর রহমান মূলত একজন গল্পকার। মানবজীবনের বৈপরীত্য ও মনস্তাত্ত্বিক বহুমুখিতা তাঁর লেখার প্রধান উপজীব্য। প্রকাশিত নিবন্ধনগ্রন্থ: জানা বিষয় অজানা কথা, যুক্তি তর্ক ও গল্প, ভিঞ্চির কালো জুতো, করোনায় শেক্সপিয়র রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য; গল্পগ্রন্থ: শরৎচন্দ্রের শরৎ উপাখ্যান ও অন্যান্য গল্প, পক্ষিরাজের ডানা, মরিচপোড়া। তিনি ১৯৭৭ সালের ১২ ডিসেম্বর, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত দুলাই ইউনিয়নের চরদুলাই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!