একশত-ছিদ্রযুক্ত-জামা-১ম-পর্ব
আলাদীপুর,  গল্প,  মুক্তিযুদ্ধ,  মুক্তিযুদ্ধে সুজানগর,  সাইফুর রহমান,  সাহিত্য

একশত ছিদ্রযুক্ত জামা (১ম পর্ব)

একশত ছিদ্রযুক্ত জামা (১ম পর্ব)

সাইফুর রহমান

 

কাশিনাথপুর থেকে যে প্রধান পাকা সড়কটি পাবনা শহরে গিয়ে মিশেছে, তারই মাঝে একটি জায়গার নাম আলাদিপুর। আলাদিপুর থেকে একেবারে দক্ষিণ বরাবর আরেকটি কাঁচা রাস্তা নদীর মতো এঁকেবেঁকে নেমে গেছে লালডাঙ্গী হয়ে গাজনার বিলে। নদী ও মানুষের মন দুটোই আঁকাবাঁকা হবে, এটাই মনে হয় প্রকৃতির এক অমোঘ নিয়ম।

রেজেক আলী সদাইপাতি ভর্তি চটের থলেটি শক্ত করে ধরে কুমিরের পিঠের মতো কর্দমাক্ত রাস্তাটিতে ছোট ছেলে-মেয়েদের এক্কাদোক্কা খেলার মতো করে পা টিপে টিপে এগোতে থাকে লালডাঙ্গী বরাবর। আলাদিপুর থেকে লালডাঙ্গীর দূরত্ব মাইল দেড়েক। শুধু নামেই গ্রামের নাম লালডাঙ্গী। বর্ষা মৌসুমে যখন গাজনার বিল উপচে লালডাঙ্গীতেও হুড়মুড় করে জল ঢুকে পড়ে, তখন সেটা বিশ্বচরাচর থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ছোট্ট গ্রামটি তখন কেশলুপ্ত কোনো মানুষের টাকসদৃশ বলে মনে হয়।

চৈত্র মাসের খাণ্ডবদাহনে গ্রামের কাঁচা সড়কগুলো সাধারণত শুকনো থাকারই কথা, কিন্তু আচানক প্রবল ঝড়বাদল রাস্তাঘাটের এমন বেগতিক হাল করে গেছে। রেজেকের শরীরের গঠনটি পাতলা ও সরু। দেহে মাংসের চেয়ে হাড় ও চামড়ার প্রাধান্যই যেন বেশি। মাথাটি শরীরের চেয়ে অপেক্ষাকৃত বড়। অনেকটা লাটিমের মতো। দেখে মনে হয়, ঠিক যেন ধানখেতের কাকতাড়ুয়া। ছিপছিপে গড়নের হওয়া সত্ত্বেও শরীরের ভারসাম্য সে ধরে রাখতে পারছে না। পা দুটো পিচ্ছিল রাস্তায় হড়কে যাচ্ছে বারবার। আলাদিপুর হাটে বসেই রেজেক প্রথম শুনল কথাটা— দেশে নাকি কী সব গন্ডগোল শুরু হয়েছে। পাকিস্তানিরা নাকি সারা রাত ধরে মানুষ হত্যার তাণ্ডব চালিয়েছে। ঢাকার রাস্তাঘাটে মৃত মানুষের মচ্ছব। আলাদিপুর পোস্ট অফিসের সামনে বহু লোকের জমায়েত দেখে বেশ খানিকটা কৌতূহলী হয়ে ওঠে রেজেক। সেখানে গিয়ে দেখে, গ্রাম থেকে আসা হাটুরে দেহাতি লোকজন বুকের কাছে হাত দুটো ভেঙে নামাজে দাঁড়ানো কোনো পুণ্যার্থীর মতো একমনে রেডিও শুনছে।

আরও পড়ুন জোছনা মাখা আলো

এই দৃশ্য দেখে রেজেক বিস্মিত হয়। অথচ তারও কিন্তু বিস্মিত হওয়ার কথা নয়। রেডিও শোনার দৃশ্য তার কাছে নতুন কোনো দ্রষ্টব্য বিষয় নয়। গ্রামের মানুষজন এভাবেই রেডিও শুনে অভ্যস্ত। লালডাঙ্গী গ্রামের ইয়াদ আলী প্রেসিডেন্টের বাড়িতেও ব্রিটিশ কোম্পানির গ্রুন্ডিক না কী যেন এ ধরনের নামের একটি রেডিও আছে। মাঝেমধ্যে কলকাতায় মোহামেডান ও মোহন বাগানের যখন খেলা হয়, তখন তুমুল হইহই ও আনন্দ-হুল্লোড়ে সবাই খেলা শোনে। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ মোহামেডানের সমর্থক হলেও পরেশ, নরেশ, সুকুমারসহ আরো পনেরো-বিশ ঘর মোহন বাগানের সমর্থক। মোহামেডানের বিজয়ে গ্রামের সিংহভাগ লোক আনন্দ-ফুর্তিতে মেতে উঠলেও মোহন বাগানের জয়লাভে পরেশ, নরেশ, সুকুমাররা কিন্তু তেমন আনন্দ-ফুর্তিতে গা ভাসাতে পারে না। উড়াতে পারে না বিজয় বৈজয়ন্তীর কেতন। সে এক অদ্ভুত ব্যাপার!

রেজেক আজ কারো চোখেমুখে আনন্দ-ফুর্তির লেশমাত্র দেখতে পেল না। তার বদলে আতঙ্ক, ভয় ও এক অজানা আর্তি ফুটে উঠেছে সবার চোখেমুখে। রেজেক অবলীলায় মিশে যায় আমজনতার মধ্যে। ভিড় ভেঙে আস্তে আস্তে পোস্ট অফিসটার একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বিশাল এক শিরীষগাছ তিনগুণ ছায়া বিস্তার করে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক সেখানটায়। রেডিওটা ঢাকার কী খবর দিচ্ছে, তা শোনার জন্য ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে ওঠে রেজেক। পোস্ট মাস্টার জাব্দেল খাঁ প্রলম্বিত পদক্ষেপে চিঠিগুলো বেছে বেছে ছোট ছোট পায়রার খোপে রাখতে রাখতে উপস্থিত লোকজনকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
─ তোমরা দাঁড়ায়া দাঁড়ায়া খবর শুনতিছো? টপ কইরে বাড়ি চইলে যাও। ঢাকায় গন্ডগোল শুরু হয়া গেছে। সেই গন্ডগোলের আগুন এহন গ্রামে চইলে আইসলো বুইলে।
সত্যি কি ঢাকা শহরের আগুন ধেয়ে আসছে গ্রামের দিকে? হতে পারে। জাব্দেল খা ভালো মানুষ। উনি মিথ্যা বলতে যাবেন কোন দুঃখে। কথাগুলো মনে মনে আওড়ায় রেজেক। রেজেক ঠাওর করতে পারে না ঢাকার আগুন গ্রামে আসবে কীভাবে?
লালডাঙ্গী পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামে। আকাশে শুক্লপক্ষের পঞ্চমী চাঁদ। চাঁদের স্নিগ্ধ নরম আলো তার গা চুয়ে চুয়ে ভূমিতে নেমে যাচ্ছিল যেন। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি।

আরও পড়ুন একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলি

বাড়ির চৌহদ্দিতে ঢুকে রেজেক হাঁক ছাড়ে,
── মোমেনা, মোমেনা, কনে গেলি রে?
── কে? বলে হঠাৎ শোলার তৈরি দেউড়ির ফাঁক দিয়ে উকি দেয় মোমেনা।
── আমি রেজেক।
─ এত সময় কনে ছিলেন?
── হাটে গেছিলেম। আর কনে যাব।
উঠোনে পা দিয়েই রেজেক দেখে, মোমেনা রাতের আহার রান্নায় ব্যস্ত। রেজেক ছোট একটি জলচৌকি নিয়ে চুলোর পাশে এসে বসে। উনুনটা ধাঁধিয়ে উঠতেই তার মধ্যে একখণ্ড কাঠের টুকরো ঢোকাতে ঢোকাতে মোমেনাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
── কী রে বউ, কী রাঁধবি আইজ? রোজ রোজ কচুপাতা ঘেঁটো আর ভাল্লাগে না। অন্য কিছু তো রাঁধবির পারিস, নাকি?
মোমেনা মুখ ঝামটি মেরে বলে,
── আহা রে আমার রাজপুত্তুর! একপয়সা আয় করবের মুরুদ নেই। তারে এহন পোলাও-কোর্মা রাইধে খাওয়াও, তাইনে? ভাতের বিদিন ঢেঁড়স সেদ্ধ দিচ্ছি, ভাত রাঁধা হয়া গেলি ডাইল রান্না হরবো। মন চালি খাও, না চালি উপোস থাহ। আমার হরার কিছু নেই।

মোমেনা মিথ্যা বলেনি। আসলেই তো রেজেকের নির্দিষ্ট কোনো কর্ম নেই। নেই কোনো আয়-রোজগার। যখন যা পায়, তা-ই করে সে। কখনো পাটের ব্যবসা, কখনো পেঁয়াজ-রসুন ও হলুদ-মরিচের মজুদদারি কিংবা বর্ষা মৌসুমে পাটনির কাজ, গাজনা বিলের এই পারের মানুষ অন্য পারে নামিয়ে দেওয়া। এসব টুকটাক আয়-রোজগারে দুবেলা কোনোমতে খেয়ে-পরে একরকম চলে যায়। নেশা-ভাঙ কিংবা আওরতে তার আসক্তি নেই বলে খুব একটা অসুবিধা হয় না। শুধু একটু হাতটানের স্বভাব। হাতটানের অভ্যাসটি আসলে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, বিশেষ করে বর্ষাকালে। যখন আয়-রোজগারের আর কোনো পথই অবশিষ্ট থাকে না।
মোমেনাকে রেজেক ঘরে তুলেছিল বেশ অল্প বয়সেই। ওই যে যখন মোমেনার প্রথম রজঃস্বলা হলো, ঠিক তার দু-তিন মাস পরেই। অবশ্য রেজেকেরও তখন বেশ কাঁচা বয়স। কত আর হবে? বেশি হলে পনেরো-ষোলো। সবেমাত্র তার পুরু দুটো ঠোঁটের ওপর বীজতলার চারাগাছের মতো হালকা গোঁফ গজিয়েছে। বারো-তেরো বছরের মোমেনা তখন দেখতে ছিল একেবারে বৃষকাষ্ঠ। বিয়ের জল গায়ে পড়তেই মোমেনা অল্প দিনে কেমন দোহারা হয়ে উঠল।

আরও পড়ুন নাজিরগঞ্জে পাক বাহিনীর ফেরি ধ্বংস

হৃষ্টপুষ্ট যৌবনবতী মোমেনার দিকে যে গ্রামের অনেকেরই চোখ পড়ে থাকে, সেটি বুঝতে তার দেরি হয় না। রেজেক হতদরিদ্র বলে লোকজনের এই কুদৃষ্টিগুলো আমলে না নিয়ে বুকে পাথর চাপা দিয়ে রাখে। তাদের বিয়ে হয়েছে এক যুগের বেশি সময় ধরে। মোমেনার রূপ-যৌবন এখন আর আগের মতো নেই। শরীরে বেশ খানিকটা ভাটা পড়েছে। সরু কোমরটি বেশ পুরু হয়েছে মেদ জমে। তাতে করে শরীরের মধ্যে ঈষৎ পৃথুলা একটি ভাব চলে এসেছে। গায়ের রংটা মোমেনার কালো হলেও, দেখতে সে ছিল বেশ লাবণ্যময়ী। কিন্তু অভাবীর সংসারের ঘানি টেনে টেনে তার সেই লাবণ্য ভাবটি এখন সম্পূর্ণভাবেই খুইয়েছে সে। তাদের ঔরসে আজ পর্যন্ত কোনো সন্তান জন্মায়নি। এসব কথা ভাবতে ভাবতে পেটের ক্ষুধাটা চিনচিন করে উঠল রেজেকের।
──কী রে বউ, রাধা কি অয়ছে? হলি টপ কইরে খাইবির দে। খিদের চোদনে মারা যাচ্ছি।
মোমেনা তাড়াহুড়া করে হাঁড়ি থেকে সানকিতে ভাত, ঢেঁড়স ভর্তা ও ডাল তুলে দেয় রেজেকের পাতে। ভর্তা ও ডাল-সহযোগে বড় বড় নলা মাখিয়ে মুখে পুরে ক্ষুধার্ত রেজেক। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ সে খেয়াল করে, মোমেনা খাচ্ছে না কিছুই। খাচ্ছে শুধু সে একা।
── কী রে বউ, তোর থালি কনে? আমি কি একা খাব? তুই বইসে বইসে আমার খাওয়া দেকপি নাকি?
── আমার পেট ব্যাতাচ্ছে। আইজ আর আমি কিছু খাব লয়। আপনি হাটতিন যে বাতাসা আনিছেন, সেইতাই খাবনে দু-একখান।

আরও পড়ুন সুজানগর পাকহানাদার মুক্ত

রেজেকের সন্দেহ হয় অন্যকিছু। সে কিছু সময় অপলক তাকিয়ে থাকে মোমেনার দিকে। তারপর সে তার ডান হাতটি ঈষৎ বর্ধিত করে ঢুকিয়ে দেয় মেটে হাঁড়িটির ভেতর। তার সন্দেহটা সত্যে পরিণত হয়। হাঁড়িতে একটি ভাতও অবশিষ্ট নেই। মোমেনা সবটুকু ভাতই তুলে দিয়েছে রেজেকের পাতে। অপেক্ষাকৃত বড় বড় চোখ দুটো তার অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। রেজেক নিজেকে বারবার ধিক্কার জানাতে থাকে, দুজনের দুমুঠো ভাতের জোগানও সে কেন দিতে পারে না। রাতে তক্তপোশে শুয়ে শুয়ে শতচিন্তা মাথায় ঘুরপাক খায় তার। একবিন্দু ঘুম নেই চোখে। মোমেনাও তার পাশে শুয়ে। সম্ভবত মোমেনাও জেগে আছে। শূন্য উদর নিয়ে মানুষ কি ঘুমাতে পারে? শোলার বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঝিরঝিরে দক্ষিণা হাওয়া এসে ঘরময় একটি শীতল ভাব এনে দিয়েছে। চারদিকে সুনসান নিস্তব্ধতা। দূরে কয়েকটি শেয়াল ডেকে ওঠে একযোগে। নিকটবর্তী কোনো জায়গা হতে হঠাৎ রেজেকের কানে ভেসে আসে জিকির-আসকার ও মারফতি গানের হল্লাবাজি। রেজেক কিছু সময়ের জন্য চুপ মেরে যায়। সতর্ক হরিণের মতো কিছু একটা শোনার চেষ্টা করে। তারপর মোমেনাকে জিজ্ঞেস করে,
── এসব মারফতি গানটান, জিকির-আসকার কনে হচ্ছে রে, মোমেনা?
─ কনে আর অবি। আমারে লালডাঙ্গী বটতলায় এক হুজুরের মজমা বয়ছে। মেলা (অনেক) লোকজনও জুটিছে। হুজুর নাকি সকলের সব সমস্যা সমাধান করি দিবির পারে।
── কী কইস রে মোমেনা? সত্যি নাহি? তাহলি তো পরভাতে আমারও যাওয়া লাগবি। দেহি হুজুর আমার আয়-রোজগারের সমেস্যাডা সমাধান কইরবের পারে কি না।

আরও পড়ুন একশত ছিদ্রযুক্ত জামা-
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব
শেষ পর্ব

 

ঘুরে আসুন আমাদের সুজানগর এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

একশত ছিদ্রযুক্ত জামা (১ম পর্ব)

Facebook Comments Box

সাইফুর রহমান মূলত একজন গল্পকার। মানবজীবনের বৈপরীত্য ও মনস্তাত্ত্বিক বহুমুখিতা তাঁর লেখার প্রধান উপজীব্য। প্রকাশিত নিবন্ধনগ্রন্থ: জানা বিষয় অজানা কথা, যুক্তি তর্ক ও গল্প, ভিঞ্চির কালো জুতো, করোনায় শেক্সপিয়র রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য; গল্পগ্রন্থ: শরৎচন্দ্রের শরৎ উপাখ্যান ও অন্যান্য গল্প, পক্ষিরাজের ডানা, মরিচপোড়া। তিনি ১৯৭৭ সালের ১২ ডিসেম্বর, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত দুলাই ইউনিয়নের চরদুলাই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

error: Content is protected !!