একটি বহুল কাঙ্ক্ষিত আইনী সংশোধনী
একটি বহুল কাঙ্ক্ষিত আইনী সংশোধনী
গত ৩ নভেম্বর ২০২২ জাতীয় সংসদে ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধারা অবলুপ্ত করে সংশোধনী আনা হয়েছে। সংশোধনীটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। সাক্ষ্য আইনের এই ধারাটি ধর্ষণের মত ভয়ংকর অপরাধের বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অনেক নারীকেই নিরুৎসাহিত করতো। বৃটিশ ঔপনিবেশিক আমলে করা বিদ্যমান আইনটি ছিল নারীর প্রতি চরম অবমাননাকর। কারণ এই আইনের ১৫৫(৪) ধারায় বলা আছে, “কোন ব্যক্তি যখন ধর্ষণ কিংবা শ্লীলতা হানির চেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত হন, তখন দেখানো যেতে পারে যে, অভিযোগকারী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্রা।”
বিদ্যমান আইনটি ছিল চরম মানবাধিকার বিরোধী, নারীর প্রতি অবমাননাকর এবং বৈষম্যমূলক। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫১ বছরেরও বেশী সময় ধরে ঔপনিবেশিক শাসনামলে করা নারীর প্রতি অবমাননাকর এবং বৈষম্যমূলক এমন একটি আইন স্বাধীন বাংলাদেশে বিদ্যমান রাখা ছিল আত্মমর্যাদা হানিকর। সাক্ষ্য আইনের বিতর্কিত এই ধারাটি অবলোপনের দাবীতে দীর্ঘ দিন ধরেই সোচ্চার ছিলেন নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন মানবাধিকার সংগঠনগুলো এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী জনাব আনিসুল হক যুগান্তকারী এই বিলটি জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেন এবং এটি কণ্ঠ ভোটে পাশ হয়।
বৃটিশ উপনিবেশিক আমলে করা সাক্ষ্য আইনের এই ধারাটি যা ধর্ষণের শিকার একজন নারীর নায্য বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বড় একটা প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল।
আরও পড়ুন ভাষা নিয়ে ভাবনা
‘ধর্ষণ’ সমগ্র পৃথিবীতেই নারীর প্রতি সংঘটিত অন্যতম ভয়ংকর অপরাধ। যে কোন বয়সের নারী এবং শিশু এই জঘন্যতম অপরাধের শিকার হয়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রায় প্রতিদিনের সংবাদ মাধ্যমে ধর্ষণ, গনধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্ষণের চেষ্টা ইত্যাদি শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ধর্ষণের পর ভুক্তভোগীকে হত্যা করা হলে অভাগী ধর্ষিতাকে ধর্ষক একটা উপকার করে, তা হলো বিচার চাইতে গিয়ে তাকে বার বার ধর্ষিত হতে হয় না। পক্ষান্তরে প্রাণে বেঁচে যাওয়া ধর্ষিতা আইনের আশ্রয় নিতে গেলে আইনের বেড়া জালে জড়িয়ে অপরাধ প্রমাণের জন্য তাকে কয়েক বার ধর্ষিত হতে হয়।
ভুক্তভোগীর বিড়ম্বনার শুরু হয় আইনের আশ্রয় নিতে যাওয়ার সময় থেকেই। ভুক্তভোগী অবোধ শিশু না হলে কিশোরী, তরুণী বা যে কোন বয়সের নারী হলে প্রথমেই কটাক্ষ শুরু হয় তার চরিত্র নিয়ে। ভুক্তভোগী নারী নিশ্চয়ই দুশ্চরিত্রা। ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায়, যেন দুশ্চরিত্রা হলেই তাকে ধর্ষণের লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার ইয়াসমিন কিংবা পুলিশী হেফাজতে থাকা ধর্ষণের শিকার সীমা রানীর ক্ষেত্রে- তাদেরকে দুশ্চারিত্রিক তকমা এঁটে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
ধর্ষণের শিকার নারী ধর্ষিতা হয়েছে কিনা-তা প্রমাণের জন্য ডাক্তারী পরীক্ষা একান্ত আবশ্যক৷ ধর্ষণের শিকার নারী-শিশুর ডাক্তারী পরীক্ষা নারী চিকিৎসক দ্বারাই সম্পন্ন হওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও সব স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বা চিকিৎসা কেন্দ্রে নারী চিকিৎসক না থাকায় কিংবা নারী চিকিৎসক ছুটিতে থাকায় কর্তব্যরত পুরুষ ডাক্তার দ্বারাই ভুক্তভোগীর ডাক্তারী পরীক্ষা সম্পন্ন হয়! এ কথা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি।
আরও পড়ুন ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা
অনেক বছর আগে ঢাকার বাইরে কোন একটা জেলার কারাগারের নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা ধর্ষণের শিকার একজন ভিকটিমকে মহিলা আইনজীবী সমিতির আশ্রয় কেন্দ্রে আনতে গিয়েছিলাম। জানা গেল, ভিকটিমের উপর ঘটে যাওয়া অপরাধের বিষয়ে মামলা হলেও দীর্ঘদিন পার হওয়ার পরেও তার ডাক্তারী পরীক্ষা সম্পন্ন হয়নি। বিষয়টি মামলার সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তার চরম দায়িত্বহীনতার প্রমাণ। কারণ ধর্ষণের মতো অপরাধ প্রমাণের জন্য চিকিৎসকের সনদপত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘ সময় পার হওয়ার পরে ভিকটিমের শরীরে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যাওয়া সম্ভব নয়। তবু যেহেতু সংশ্লিষ্ট জেলার নারী শিশু ট্রাইব্যুনালে মামলাটির বিচার প্রক্রিয়া চলবে এবং ইতিমধ্যেই যথেষ্ট দেরি হয়েছে সে কারণে সংশ্লিষ্ট জেলার সরকারি হাসপাতাল থেকেই ভিকটিমের চিকিৎসার সনদপত্র সংগ্রহ করতে তাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া হল।
দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর জানা গেল হাসপাতালে কোন নারী চিকিৎসক না থাকায় একজন পুরুষ ডাক্তারই ভিকটিমের ডাক্তারী পরীক্ষা সম্পন্ন করেছেন! অসহায় আমার কিছুই করার ছিল না।
এরপর ভুক্তভোগী নারীর মামলার বিচার প্রক্রিয়া উন্মুক্ত আদালত কক্ষে যখন শুরু হয়, তখন আসামি পক্ষের আইনজীবী বা আইনজীবীগণ ভুক্তভোগীকে যে আক্রমণাত্বক ভাষায় চরিত্র হনন করতে শুরু করেন, তখন বিচার প্রার্থীর দশা হয় ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’। এ ক্ষেত্রে সরকারি কৌঁসুলিদের আচরণও অনেক সময়ই হতাশাব্যঞ্জক। যেখানে কোন ভিকটিমের ন্যায় বিচার নিশ্চিতের লক্ষ্যেই সরকারি কৌঁসুলিদের নিয়োগ দেওয়া হয়, সেখানে অনেক সময়ই তাঁরা সঠিক ভূমিকা রাখতে উদাসিন থাকেন।
আরও প্রবন্ধ সমকালীন ভাবনা
এ প্রসঙ্গে একটি ব্যক্তিগত তিক্ত অভিজ্ঞতা বিনিময় করছি। ঢাকার এক নারী শিশু ট্রাইব্যুনালে একটি উপজাতি কিশোরী ভিকটিমের ধর্ষণ মমলার জেরার শুনানি চলছিল। উক্ত ভিকটিম তার নিজের উপজাতি ভাষা ছাড়া সাধারণ বাংলা ভালো বলতেও পারে না, বোঝেও না। ঐ মামলায় আমার দায়িত্ব ছিল সরকারি কৌঁসুলিকে সহায়তা করা। কারণ কোন ফৌজদারী অপরাধের (Criminal offence) মামলার শুনানির ক্ষেত্রে মূল দায়িত্ব পালন করেন সরকারি কৌঁসুলি। সরকারি কৌঁসুলির অনুমতি ছাড়া এ ধরনের মামলায় অন্য কোন আইনজীবীর সরাসরি অংশ নেওয়ার কোন সুযোগ নাই। আসামী পক্ষে কয়েকজন আইনজীবী। তাঁরা তাঁদের চিরাচরিত নিয়মে কিশোরীর চরিত্র হনন শুরু করলেন। সরকারি কৌঁসুলি পাশেই একটি সোফায় আধ শোয়া হয়ে ঘুমিয়ে গেলেন! নিরুপায় আমি অন্য কোন উপায় না পেয়ে বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য হলাম। বিচারক সরকারি কৌঁসুলিকে তাঁর দায়িত্বহীনতার জন্য রীতিমত ভর্ৎসনা করলে তাঁর সম্বিত ফিরল!
এ ধরনের সংবেদনশীল মামলার বিচার প্রক্রিয়া গোপন শুনানি করার বিধান প্রচলিত আইনেই রয়েছে, যার প্রয়োগ বাংলাদেশে কখনো হয়েছে বলে জানা নেই। ফলে আদালতে উপস্থিত অন্যান্য অসংখ্য বিচার প্রার্থীর সামনে ধর্ষণের শিকার নারীর বিচার চলাকালীন সময়ে প্রতিপক্ষের আইনজীবীগণের রসালো জেরায় আদালত কামরায় উপস্থিত লোকজনের রীতিমত চিত্তবিনোদনের খোরাকের যোগান দেওয়া হয়!
যাইহোক, দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হলেও ঔপনিবেশিক আমলের নারীর মর্যাদা হানিকর এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ আইনী ধারার বিলুপ্তিকরণ-বাংলাদেশের আইনের ইতিহাসে মহিমান্বিত হয়ে থাকবে।
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
একটি বহুল কাঙ্ক্ষিত আইনী সংশোধনী