একজন-কিশোরীর-প্রেম-২য়-পর্ব
এ কে আজাদ দুলাল (গল্প),  গল্প,  সাহিত্য

একজন কিশোরীর প্রেম (২য় পর্ব)

একজন কিশোরীর প্রেম (২য় পর্ব)

এ কে আজাদ দুলাল

 

──সাগরদা কেমন আছো?
সাগর ক্রমান্বয়ে কেমন যেন অতল চিন্তার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। বিমল-বাসন্তীর পাতা এ কোন ধরনের ফাঁদে ফেললো তাকে। এটা নিছক মজা বা কৌতুক নয় তো? শীতের সকাল সাগরের শরীর ঘামছে। ফুলহাতা সোয়েটার পরেছে। অস্বস্তি বোধ করছে। এটা কি রসিকতা, না অন্য কিছু?
──বাসন্তীদি, তোমাদের বন্ধু ঘামছেন। ফ্যান চালু করে দাও। সাগরদা বলতো ছোট বেলায় তোমার কোন ফুল প্রিয় ছিলো?
সাগর আরও আশ্চর্য হয়ে গেলো সরাসরি তুমিতে এবং ছোট বেলায় তার কোন ফুল প্রিয় ছিলো। হ্যাঁ, ছিলো তো বটেই। এই তো গাঁদা ফুল। এখনই হয়ত বলবে প্রতিদিন স্কুলে ফুলগুলো তোমাকে কে দিতো? ঠিকই মনের কথা মনের ভেতরে থাকতেই-

আরও পড়ুন গল্প হাইয়া আলাল ফালাহ

──বলো তো, কে সেই ফুলগুলো মুঠভরে তোমার মুঠোয় ভরে দিতো?
এবার সাগর আর চুপ করে বসে থাকতে পারছে না।
──হ্যাঁ, দিতো বটে। কিন্তু?
──কিন্তু সেই চিনু রানী ঘোষ, এখন তোমার পাশে সশরীরে বসে আছে।
সাগর এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
──এটা কেমন করে হয়? সেই পঞ্চান্ন বছর আগের কথা।
──এলাম সাগরদাকে এক নজর দেখতে। মান্যবর স্বামী বললেন “যাও দেখে এসো অবুঝ মনের প্রথম প্রেমিক বালকটিকে।” আসলেই তুমি বালকই আছো। মা বলতো বোকা বোকা মিষ্টি চেহারা সাগরের।
এখনো সাগরের ঘোর কাটেনি। এটা কি করে সম্ভবপর, চিনু এখানে। কি করে আসবে? আর বিমলের বাড়িতে। বাসন্তী বৌদিকে দিদি বলছে। এ কেমন ফাঁদে পরলো? সাগর হিসেব মেলাতে পারছে না।
──কিন্তু?
──কিন্তু কি সাগরদা? আমি চিনু রানী ঘোষ বিশ্বাস হচ্ছে না? আমি তো সেই কিশোরী চিনু নই এখন। দুটো ছেলে-মেয়ের মা এবং বিবাহিত একজনের স্ত্রী। ছেলো-মেয়ে দুটো বিবাহিত এবং বাচ্চাদের বাবা-মা। জীবন তো পরিবর্তনশীল প্রবাহিত নদীর মতো। যেমন পরিবর্তন হয়েছে আমার পাশে বসা বোকা সাগরের। ছোটো বেলায় লজ্জায় আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারতো না। মা, সব খেয়াল রাখতো। মায়ের মন তো।
──না। সে কথা বলছি না। এতদিন পর তোমাকে এভাবে দেখা পাবো…
──ও, এই চিন্তাই করছো? আমার মনে বড় সাধ ছিলো-

‘’কত কাল দেখিনি তোমায়,
একবার তোমায় দেখি।”

আরও পড়ুন গল্প সুরেন বাবু

সাধ মিটে গেল ভগবানের কৃপায় আর দেবতাসম স্বামীর আগ্রহে। দ্যাখো, কিশোর প্রেম কত পবিত্র!
সাগর চেয়ার হতে উঠে চিনুর সামনে দাঁড়ায়। চিনু উঠে সাগরের মুখোমুখি দাঁড়ায়। সাগর চিনুর মুখের দিকে তাকিয়ে কি যেন খুঁজছে। চিনু টের পেয়েছে, সাগর কি খুঁজছে। যেটা সাগরের কাছে সবচেয়ে প্রিয় ছিলো। সুযোগ পেলেই বোকার মতো চিনুর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলতো,
──জানিস চিনু, তোর চোখ দুটো খুব সুন্দর কিন্তু একটু ট্যারা।
হালকা-পাতলা বয়সের তুলনায় একটু লম্বা চিনু হাসতে হাসতে ঝাউ গাছের মতো দুলতো আর সাগর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতো। সেই চিনু আজ তার সামনে। চিনু ভাবছে তার ডান পাশের চুলের গোছা কি সরিয়ে দিবে না-কি আর একটু মজা করবে। না, ভালোবাসার মানুষকে বেশি কষ্ট দিতে হয় না। এ যে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। যে চোখ দুটো সাগরের প্রিয় ছিলো শেষবারের মতো নতুন করে দেখলে দোষ কোথায়। চিনু জানে তার ডান চোখটা সামান্য ট্যারা। ধীরে ধীরে চিনু ডান হাত দিয়ে ডান চোখের সামনের এক গোছা চুল সরিয়ে বললো,
──এবার দেখতো সাগরদা, চিনু রানী ঘোষ না নকল কেউ?
সাগর আয়ত চোখ মেলে চিনুর মুখের দিকে এক নাগাড়ে কত সময় তাকিয়েছিল বুঝে উঠতে পারেনি। বাসন্তী বৌদির ডাকে হুঁশ ফিরে পায় সাগর। বৌদি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললো,
──হায়রে, একে বলে দেবদাস। প্রেমের মরা জলে ডোবে না। এ বার হলো তো সাগরদা তোমার ফেলে আসা অতীত কিশোর-কিশোরীর প্রেমের উপখ্যান। চল নাস্তা খেতে খেতে তোমাদের কথা শুনবো।

সেই বয়স ভালোবাসা কি জিনিস জানা ছিলো না। কৈশোরী অনুভূতি দু’জনকে কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিলো যা সবাই জানতো। দু’পরিবারের সবাই মজা করতো ওদের চুপিসারে কর্মকাণ্ডে। গোপনে ফুল দেয়া, চিনুর মার হাতে তৈরি নাড়ু-মোয়া আর কত কি। আবার চিনু তার বাবার সাথে সাগরদের বাড়িতে গেলে সাগরের মা কত রকমের খাবার দিতো। তিলের তৈরি নাড়ু,খঁইয়ের মোয়া আর গাছের পাকা সেরা পিয়ারা। সাগরের মা চিনুকে লক্ষ্মী ট্যারা বলতো। আরও বলতো, এ মেয়ে যার ঘরে যাবে সে ঘর লক্ষ্মীতে ভরে যাবে।

আরও পড়ুন গল্প প্রতীক্ষিত বৃষ্টি

বিমল আর চুপচাপ বসে থাকতে পারছে না। কিছু একটা বলার জন্য উসখুস করছে। বাসন্তী বৌদি বুঝতে পারছে তার স্বামী কিছু বলতে চাইছে এবং তা হবে নিশ্চিত মজার ঘটনা।
──বিমলদা মনে হয় কিছু বলতে চাইছেন? বললেন বৌদি।
──মজার কথা হলো আমরা পাঁচ বন্ধু ছিলাম এক আত্মার। সাগর-প্রদীপ সমবয়সী আর আমরা বাকী ক’জন ওদের দুজনের চেয়ে বয়সে দু-তিন বছরের মতো বড়। প্রদীপদের বাড়িতে সময় কাটতো এবং খেলাধুলা করতাম। বাড়ির উঠান অনেক বড় ছিলো। কিন্তু সাগরকে কাছে পেতাম খুব কম। সুযোগ পেলেই সাগর-চিনু আলাদা হয়ে কি যে কথা বলতো তার কোন মাথামুন্ড ছিলো না। কিন্তু বলেই বিমল সাগর-চিনুর মুখের দিকে তাকালো। বিমলের ধারণা দু’জন হয়ত অতীতের সেই দিনগুলো মন্থর করছে।
বৌদি মজা করে বললেন,
──এই বিমলদা, তারপর কি?
──তারপর, চিনু সাগরের হাত ধরে নিয়ে গেছে তার পুতুল খেলার ঘরে। সাগর একমাত্র তার পুতুলঘর পছন্দ করতো, তাই হয়তো সেই জন্য সাগরকে বেশি পছন্দ। কাকীমা খুব মজা পেতেন। স্কুলে বৃষ্টির দিনে চিনুসহ সবাই ভিজতো আর সাগর তার বাবার ছাতা নিয়ে চিনুর মাথার ওপর ধরে রাখতো।
──বলো কি? এ তো দেবদাস।
──দেবদাস নয়। এটা হলো কিশোর-কিশোরীর অনুভূতির শিহরণ। কারণ তখনো প্রেম ভালবাসার অনুভব হৃদয়ে জেগে উঠেনি। একান্ত একে অপরের প্রতি যাকে বলে টান। তবে পরবর্তীতে একটা কিছু ঘটতে চলেছিলো তা পাক-ভারত যুদ্ধের দামামা আর বোমার আঘাতে দু’জনের মধ্যে সীমারেখা টেনে দিয়েছিলো। সাগর-চিনু আমার কথা কি ভুল?

আরও পড়ুন গল্প  তৃতীয় স্বাক্ষী

এ কথার জবাব দিতে পারলো না দু’জন। কিছু সময় চুপচাপ থেকে চিনু নিরবতা ভেঙে বললো,
──সাগরদা তোমার স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে গেছে। মা বলতো, সাগরের চেহারাটা কি মিষ্টি। তাই মা-র কথা শুনে সাগরদার প্রতি আমার মায়া হতো। সেটা প্রেম কিনা বুঝার বয়স তখনো হয়নি। আবার এটাও কারণ হতে পারে দিদি তার বান্ধবীদের নিয়ে খেলা করতো, গল্প করতো আর দাদা তাদের বন্ধুদের নিয়ে খেলা করতো। আমার কোন খেলার সাথী ছিলো না। থাকার মতো মাটির তৈরি বোবা ক’টা পুতুল। বোবাদের সাথে কত সময় একাকী খেলা যায়। হঠাৎ একদিন সাগরের দিকে নজর পরলো। দেখে কেন যেন মায়া হলো। মা সাগরদাকে খুব পছন্দ করতো আর বলতো বোকা বোকা মিষ্টি চেহারা। মাকে বলে আমার খেলার সাথী বানিয়ে নিয়েছিলাম। ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা অল্প বয়সে অনেক কিছু ভাবতে শেখে। মা বলতো মেয়েদের পিঠ চওড়া হতে থাকে, তখন বুঝতে হবে তার মনের ভেতরে মেয়েলীভাব শুরু হয়েছে। আসলেই তাই।

সাগরদা আমার চেয়ে চার-পাঁচ বছরের বড়ো হবে। কিন্তু মানসিক দিক দিয়ে তার চেয়ে আমি বড়। শুধু তাই নয় বুদ্ধিতে এগিয়েছিলাম। ও ক্লাসে ভাল ছাত্র ছিলো ঠিক। দাদা বলতো সাগরের প্রথম হওয়ার কথা কিন্তু তৃতীয় হতো। এটা ওর বাবার জন্য। সবাই ভাববে মাস্টারের ছেলে তাই প্রথম হয়েছে। বোকারামের ভেতরে কোন রকম প্রতিক্রিয়া ছিলো না। মনে হতো এটা কোন ঘটনা নয়।

আরও পড়ুন গল্প পরাজিত নাবিক

বাড়িতে বাবা-মা আর প্রদীপদা ওকে নিয়ে মজার মজার কথা বলতো আমি মন দিয়ে শুনতাম। তখন হতে ওর প্রতি দুর্বল হতে থাকি। মা টের পেয়ে চুপচাপ থেকেছে। হয়ত মনে মনে বলতো পাখা ঝাঁপটাতে থাকো সময় মতো সেঁটে ফেলা হবে। তাই হয়ত চুপচাপ থাকতো। তা তো বুঝতেই পারলাম ভরা বর্ষাকালে গভীর রাতে পরিবারের সবাইকে নিয়ে নাদের কাকার বড় নৌকায় যখন উঠে বসলাম। দেশ ছেড়ে চিরকালের জন্য চলে যাচ্ছি বলে বাবা-মা আর বড় দুই ভাইবোন কষ্টে কান্নাকাটি করছে আর আমি সাগরের জন্য কেঁদে চোখের পানিতে নতুন জামাকাপড় ভিজিয়ে ফেলেছিলাম। কেউ সেদিন কান্না থামাতে নিষেধ করেনি। যখন ঘুম ভাঙ্গলো দেখি একটা গাড়ি অপেক্ষা করছে।

এ যেন ফেলে আসা এক কিশোরীর মনের অব্যক্ত বেদনার কথা। দীর্ঘ বছর পর এক কিশোর বয়সী ভালোবাসার মানুষকে বেদনার কথা বলে অবুঝ মনকে শান্ত্বনা দিচ্ছে আর সাথে সাথে চোখ দুটো ছলছল করছে।

“আমায় থাকতে দে-না আপন মনে।
সেই চরণের পরশখানি মনে পড়ে ক্ষণে ক্ষণে।”

তাই হয়ত এত বছর পর দেখা হয়ে গেলো। নিয়তির কি খেলা!

আরও পড়ুন একজন কিশোরীর মন-
১ম পর্ব
শেষ পর্ব

 

 

ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলফেসবুক পেইজে

একজন কিশোরীর প্রেম (২য় পর্ব)

Facebook Comments Box

এ কে আজাদ দুলাল মূলত একজন গল্পকার। এছড়াও তিনি কবিতা ও উপন্যাস লিখছেন। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ: বিবর্ণ সন্ধ্যা, তুমি রবে নীরবে; উপন্যাস: জোছনায় ভেজা বর্ষা। তিনি ১৯৫১ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অন্তর্গত হাটখালী ইউনিয়নের নুরুদ্দীনপুর গ্রাম তাঁর পৈতৃক নিবাস ।

error: Content is protected !!