একজন অনন্যা
একজন অনন্যা
মেয়েটার নাম অনন্যা। দারুণ চটপটে, সপ্রতিভ। কথা বলা যে একটা শিল্প, তা সে ভালো করেই জানে। একসময় চুটিয়ে মঞ্চনাটক করতো, গান গাইতো, আবৃত্তিতেও পারঙ্গমতা আছে তার। সাংস্কৃতিক অঙ্গনেই বিস্তর বর্ধন। এইসব করতে করতেই কখন যেন লগ্নটা হাতছাড়া হয়ে গেছে, বিয়ে করাটা আর হয়ে ওঠেনি। আমার ধারনা অবশ্য ভিন্ন। হৃদয় তন্ত্রীর তার একবার ছিড়ে গেলে তা আর সহজে জোড়া লাগানো যায় না। সবচেয়ে দুর্বহ ভালোবাসার আঘাত। অনেকে সে আঘাত সইতেও পারে না। মতিচ্ছন্ন, বেপথু হয়, কেউবা আত্মহননের পথ বেছে নেয়। আবার কেউ সব যন্ত্রনা হজম করে নীলকণ্ঠ হয়। ভেতরটা জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যায়, কিন্তু বাইরে থেকে কিছুই বোঝার উপায় নেই। অনির্বাণ তুষের আগুনের মতো হৃদয় পোড়ে, সে আগুন দেখা যায় না। বাইরের পারিপাট্য দিয়ে সাজানো থাকলেও অন্তরটা ক্ষতবিক্ষত।
অনন্যা সব সময় হাসি-খুশি উচ্ছ্বসিত থাকে, মনের কষ্ট তাকে কখনো ছুঁতে পারে না। ভীষণ প্রাণোচ্ছবল । কিন্তু তার মধ্যেও সকল উপরি কারুকার্য ভেদ করে কখনো কখনো বুকে বিঁধে থাকা কষ্টগুলো মুখে ভেসে ওঠে। তখন ওর জন্য খুব মায়া হয়। এতো প্রাণবন্ত একটা মেয়ের অন্তর দহন আমাকে স্পর্শ করে। বারবার কষ্টের কারণ জানতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আচার আর ঔচিত্যবোধ আমাকে বারিত করে। তাই কখনো আর জিজ্ঞাসা করা হয়নি। ‘কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে?
আরও পড়ুন গল্প হাইয়া আলাল ফালাহ
অনন্যা আমার স্ত্রীর বান্ধবী। কনিষ্ঠা বান্ধবী। ওদের যে মহিলা সমিতি, নারীবাদী সংগঠন, নারী উদ্যোগ কর্মসূচি, একটা ‘পর্যটন প্রিয় বলয়’ আছে, দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর, তারই সদস্য অনন্যা। সবার ছোট বলে আদর-লাই সে একটু বেশিই পায়। অবশ্য ওর স্বভাব গুনেই নিজের জায়গাটা পাকাপোক্ত করে নিয়েছে। হৈ হুল্লোড় গান আবৃতিতে একেবারে মাতিয়ে রাখে সবাইকে। অনন্যা মাঝেমধ্যে আসে আমাদের বাসায়। দুলাভাই বলে ডাকে আমাকে। ওর গুছিয়ে কথা বলাটা আমার খুব ভালো লাগে। আসলেই আমার সাথে বেশ জমে যায়। সাহিত্য, সংস্কৃতি কখনো সাম্প্রতিক ঘটনা রাজনীতি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
আমাদের এই লাগাতার আলোচনায় আমার গিন্নী কখনো কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
‘দ্যাখো, তোমাদের ভাবসাব কিন্তু ভালো ঠেকছে না আমার’।
আমি সুবোধের মতো বলি,
‘এই বয়সে আরসে ভয় নেই। তোমার জায়গাটা অটুট, অক্ষুন্ন’।
গিন্নি ফোড়ন কেটে বলে,
‘সুন্দরী মেয়ে দেখলে বুড়োদের আবার ভীমরতি ধরে, এ ব্যামো তোমার আগে থেকেই আছে’।
অনন্যা মুচকি হেসে আগুনে ধুপ দেয়,
‘আপা, আমি কিন্তু সুযোগ পেলে –
ওর কথা শেষ না হতেই হাসির ফোয়ারা বয়ে যায়।
আরও পড়ুন গল্প লালু
সেই অণুঢ়া অনন্যা সেদিন এক অনুষ্ঠানে একেবারে হতবাক করে দিয়েছে আমাকে। সঙ্গে পঞ্চাশোর্ধ সূদৰ্শন এক পৌঢ়। চেহারা, গায়ের রং আর জিন্সের সাথে টি-সার্ট, চোখে কালো সানগ্লাস অসাধারণ আকর্ষণীয় করে তুলেছে তাকে। পরিপাট অভিজাত। সঙ্গে ১০/১৫ বছরের দুটো ছেলে, অবিকল তাঁর মতো।
ওরা মা বলে সম্বোধন করছে অনন্যাকে। অনন্যা আদরে বুকে জড়িয়ে ধরছে।
আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে তার দিকে।
মিটিমিটি হাসছে অনন্যা। সেই-ই পরিচয় করিয়ে দিলো ভদ্রলোকের সাথে।
আমার দিকে ইঙ্গিত করে বললো,
‘ইনি আমার প্রিয় দুলাভাই, সাঈদা আপার পতি প্রবর’।
এক চিলতে পুষ্পিত হাসি ওর মুখ। ভদ্রলোকের একটা হাত নিজের হাতে
নিয়ে বললো,
‘আর ইনি হচ্ছেন আমার —-
কথা শেষ না করেই হাসিতে ভেঙ্গে পড়লো সে। ফলে রহস্যটা আরও ঘনীভূত হলো। আমাদের আনুষ্ঠানিক পরিচয় হলেও আলাপচারিতা তেমন প্রাণবন্ত হলো না।
আরও পড়ুন গল্প রাজামারা
আমার প্রতিভ আড্ডাবাজ স্বভাবের মধ্যে কেমন যেন একটা অস্বস্তি ঢুকে আছে। আমি কিছুতেই সেটাকে উপড়ে ফেলতে পারিনি।
ফিরতি পথে গাড়িতে আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘অনন্যা যে বিবাহিতা, দুই সন্তানের জননী তা তো কখনো বলনি’? গিন্নী আমার দিকে তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
‘তাতে তোমার অসুবিধা কি? ‘না না আমার কোন অসুবিধা নেই’।
ত্বরিত উত্তর দিয়ে মুখটা জানালার দিকে ঘুরিয়ে নিলাম আমি। কিন্তু এই বলার ধরনটা যে আমার স্বভাবসিদ্ধ প্রমিত নয়, সেটা বোধকরি আমাদের দু’জনের কাছেই স্পষ্ট হোল । অনেক্ষণ চুপচাপ থাকার পর আমার স্ত্রী বললো, ‘ছেলে দুটো অনন্যার বোনের, আর ওই ভদ্রলোক ওর দুলাভাই’।
“ও আচ্ছা’।
বলে গানের ভল্যুমটা মৃদু বাড়িয়ে দিলাম আমি। এতোক্ষণে বুকটা নির্ভার লাগছে।
ঘুরে আসুন আমাদের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে
একজন অনন্যা